নিজস্ব প্রতিনিধি : ইছামতী নদীর ধারে দাঁড়িয়ে কথাগুলি বলতে-বলতে স্মৃতিভারে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন বছর বাষট্টির জ্যোতির্ময় সরস্বতী। “কি ছিল সে দিনের ইছামতী! জল থইথই করত। নৌকায় কত মানুষ যাতায়াত করতেন! বড়-বড় পালতোলা নৌকায় মালপত্র স্থানান্তর করা হতো। আজ সে সব গল্প ছাড়া আর কিছুই নয়।”
শহরের শান্তিনগর এলাকার সুশীল তরফদার কাছ থেকে জানা যায়, আগে এই ইছামতী নদীর দু’পাশে কয়েক হাজার মৎসজীবী বসবাস করতেন। বছরের পর বছর তাঁরা এই নদী থেকে মাছ ধরে জীবন অতিবাহিত করেছেন। সন্তানদেও লালন,পালন করে তাদের বিয়েও দিয়েছেন। নদীর ক্রমশ হারিয়ে যেতে বসায় তাঁরাও সঙ্কটে। অনেকেই মৎস্যজীবীর পেশা থেকে দূরে সরে গিয়েছেন। দু-চার জন অন্য জায়গা থেকে মাছ কিনে এনে বিক্রি করেন।
একটু থেমেই মাত্র আঠারো বয়সী শিশিরের মন্তব্য করেন : এই ইছামতি নদী দেখে দুঃখ হয় । বাবার মুখে শুনেছি এই নদীর গল্প। যে নদীতে সব সময় পানি প্রবাহ ছিলো। চলতো বিভিন্ন ধরনের পালতোলা নৌকা। আর আজ এই নদীতে আবর্জনায় ভরপুর। অধিকাংশ নদীই যেন দখল আর দূষণে ভরে গেছে। যে দিকেই তাকাই সে দিকেই ময়লা আর আবর্জনার স্তুপ। এই হারানো নদী আর কী ফিরে পাব?’
এমন পরিস্থিতিতে ২০১৬ সালের ১৬ই সেপ্টেম্বর পাবনার সুশিল সমাজ,সাংবাদিক ও অন্যান্য ব্যক্তিদের নিয়ে একটি সংগঠন গড়ে তোলা হয়। যার নাম দেওয়া হয় “ইছামতি নদী উদ্ধার আন্দোলন কমিটি”।এই সংগঠনটি একাধারে ৫০ বার মানববন্ধন.সেমিনার ও মাইকিং করেন। সংগঠনটির সভাপতি এস এম মাহবুব জানান, ঐতিহ্যবাহী এই ইছামতি নদী দখল ও দূষণমুক্ত করার লক্ষে আমরা তথা পাবনার আপামর জনসাধারন কাজ করে যাচ্ছি ।এই নদী দখল ও দূষণমুক্ত হলে পাবনার চেহারাই পালটে যাবে। নদী দিয়ে চলবে নৌকা ,জেলে আবার মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করবে।এই প্রত্যাশা আমাদের সকলের । তবে ইছামতি নদী দখল ও দূষণ মুক্ত এখন আর স্বপ্ন বাস্তবে রুপ নিয়েছে।
পাবনাবাসীর প্রাণের দাবি ছিল শহরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ইছামতি নদীর দু’পাড়ের অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ করে খননের পর নদীর প্রবাহ ফিরিয়ে আনা। এ নিয়ে সরকারের সঙ্গে নদীর দু’পাড়ের দখলদারদের দীর্ঘদিনের আইনি লড়াইয়ের পর সম্প্রতি হাইকোর্ট থেকে সরকার পক্ষে রায় আসে।রায়ের পরপরই পাবনা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বেশ কিছুদিন সময় বেঁধে দিয়ে ইছামতি নদীর দু’পাড়ে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা বসত বাড়িসহ সকল স্থাপনা সরিয়ে নিতে মাইকিং করা হয়। প্রচারণায় ৩০ মার্চ নদীতে খনন কাজ ও ৩১ মার্চ থেকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হবে বলে জানানো হয়।পাবনাবাসীর দীর্ঘদিনের দাবির প্রেক্ষিতে অবশেষে ৩০ মার্চ মঙ্গলবার দুপুরে আনুষ্ঠানিকভাবে ইছামতি নদীর পুন:খনন কাজের উদ্বোধন করা হয়েছে। শহরের হাউজপাড়া থেকে নদী খনন কাজের উদ্বোধন করা হয়।
প্রথম পর্যায়ে প্রায় ৯ কোটি টাকা ব্যয়ে ৭.৬৭ কিলোমিটার. নদীর পাড়ের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ ও নদী খনন এবং পায়ে হাটা পথ তৈরির কাজ করা হবে।সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে জানা গেছে, সারাদেশের ন্যায় অভ্যন্তরস্থ ছোট নদী, খাল ও জলাশয় পুনঃখনন প্রকল্পের আওতায় পাবনার ইছামতি নদী পুনঃখনন কাজের উদ্বোধন করা হলো। পাবনা সদর উপজেলার দোগাছি ইউনিয়নের বাংলাবাজার লঞ্চঘাট থেকে শহরের পৌর এলাকার সিংগা শ্মশানঘাট পর্যন্ত নদীর দু’পাড়ের অবৈধ দখলদার মুক্ত করে নদী খনন ও পায়ে হাটা পথ তৈরি করা হবে।পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ও পাবনা সদর আসনের সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক প্রিন্স প্রধান অতিথি হিসেবে খনন কাজের উদ্বোধন করেন। এসময় পাবনা-সিরাজগঞ্জ সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি নাদিরা ইয়াসমিন জলি, পাবনা জেলা প্রশাসক কবীর মাহমুদ, পুলিশ সুপার মহিবুল ইসলাম খান, পাবনা পৌরসভার মেয়র শরীফ উদ্দিন প্রধান, পাবনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. সাইফুল্লাহ, নির্বাহী প্রকৌশলী রফিকুল আলম চৌধুরী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে বেলা ১১ টা থেকে ঘণ্টাব্যাপী মানববন্ধন করে পাবনার ইছামতি নদী উদ্ধার আন্দোলন নামের একটি সংগঠন। সংগঠনের সভাপতি এসএম মাহবুব আলম জানান, মহামান্য হাইকোর্টের আদেশ মোতাবেক সিএস ম্যাপ অনুযায়ী ইছামতি নদী পুনঃখনন ও প্রবাহমান করার দাবি জানিয়ে আমরা দীর্ঘদিন ধরেই আন্দোলন চালিয়ে আসছি। কিছু স্বার্থন্বেষী মহল ইছামতি নদীর জায়গা অবৈধ ভাবে দখল নিয়ে ভুলভাল কাগজপত্র তৈরি করে মালিক সেজে ইছামতি নদীর খনন কাজ বাঁধাগ্রস্থ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। কিন্তু তারা এই কাজে সফল হতে পারেনি। আমরা চাই দ্রুত সময়ের মধ্যেই হাইকোর্টের আদেশ বাস্তায়ন করে ইছামতি নদীতে পূর্বের রূপে ফিরিয়ে আনা হোক।
অপরদিকে একই দিন সকাল ১০ টা থেকে শহরের আব্দুল হামিদ সড়কের এআর কর্নার মার্কেটের সামনে আমরণ অনশনের ডাক দিয়ে অবস্থান নেয় ইছামতি নদীপাড়ের বৈধ বসতিদের স্বার্থসংরক্ষণ কমিটি। তারা কয়েকটি ব্যানার ঝুলিয়ে নারী-পুরুষরা সেখানে অবস্থান নেন। মঙ্গলবার বিকেল ৪ টায় পাবনা সদর আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সম্পাদক গোলাম ফারুক প্রিন্স উপস্থিত হয়ে বিষয়টি তিনি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাসে নশনকারীদের অনশন ভঙ্গ করে নিজ নিজ বাড়িতে চলে যাওয়ার জন্য অনুরোধ জানান। তার পরপর অনশনকারীদের সহমর্মিতা জানাতে আসেন পাবনা-সিরাজগঞ্জ সংরক্ষিত আসনের নারী সংসদ সদস্য নাদিরা ইয়াসমিন জলি।
সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পাবনা সদর আসনের সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক প্রিন্স বলেন, নদীটা খননের উদ্দেশ্য শহরকে আবর্জনা থেকে মুক্ত করা। সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি করা। দুবেলা মানুষ সুন্দর ভাবে নদীর পাড় দিয়ে হাটতে পারবে। তিনি বলেন, অনেক মানুষ নদী পাড়ে বসবাস করছেন। হয়তো তারা ভুল করে জায়গা জমি ক্রয় করেছেন। তারাই আজকে ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছেন। তাদের বিষয়গুলো জেলা প্রশাসককে খতিয়ে দেখার জন্য বলা হয়েছে। তিনি বলেন, যেহেতু করোনা পরিস্থিতি আবার ভয়াবহ অবস্থা ধারণের পথে। তাই আপাতত তাদের উচ্ছেদ না করে আরও কিছুদিন সময় দেয়া হবে। অন্তত তারা ঈদ পর্যন্ত নির্বিঘ্নে বসবাস করতে পারবেন বলে অনশনকারীদের আশ্বস্ত করা হয়েছে।