বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : দুর্নীতি ও পারিবারিক রাজনীতির জন্য যতটা না ক্ষতি হয়েছে, তার চেয়ে বেশি হয়েছে ভুল নীতির জন্য। পরিণামে পাকিস্তানের অর্থনীতি একরকম স্থবির হয়ে আছে, যদিও প্রতিবেশী বাংলাদেশ ও ভারত তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তানি অর্থনীতিবিদ নিয়াজ মুর্তজা সম্প্রতি দ্য ডন পত্রিকায় লিখিত এক নিবন্ধে এসব কথা বলেছেন।
নিবন্ধে তিনি বলেছেন, পাকিস্তানের ক্রমবর্ধমান তরুণ জনগোষ্ঠীর বাস্তবতায় প্রবৃদ্ধির হার ৬ থেকে ৭ শতাংশ হওয়া উচিত। কিন্তু চলতি একবিংশ শতকে মাত্র দুবার পাকিস্তানের প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশ ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে আবার মূল্যস্ফীতির হার গত ১২ বছরে ৬-৭-এর ঘরেই আছে। তাতে গরিবদের দুঃখ কেবল বাড়ছে।
বিকাশমান অর্থনীতিতে ক্রমবর্ধমান তরুণ জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের প্রধান ক্ষেত্র হচ্ছে শিল্পকারখানা। কিন্তু পাকিস্তান বড়ই দুর্ভাগা, দেশটির শিল্প খাত কয়েক দশক ধরেই জিডিপির ২০ শতাংশের মধ্যে আটকে আছে। এর মধ্যে অবশ্য সেবা খাতের পরিসর ৫০ শতাংশ থেকে বেড়ে ৬০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অথচ অনেক গরিব দেশ রপ্তানির বদৌলতে এগিয়ে গেছে। পাকিস্তানের রপ্তানি ২০০৩ সালে যেখানে জিডিপির ১৫ শতাংশ ছিল, এখন তা নেমে এসেছে ১০ শতাংশে। প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগও কমেছে—জিডিপির ৩ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে তা নেমে এসেছে ১ শতাংশে।
পদ্মা সেতুতে স্প্যান বসানোর কাজ শেষ হয়েছে। নিয়াজ মুর্তজা বলছেন, পাকিস্তানে এফডিআই আসে বড় শক্তির লেজুড় হয়ে, যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। যার সঙ্গে যখন সম্পর্ক ভালো, তখন তার হাত ধরেই আসে বিনিয়োগ। কিন্তু প্রতিবেশী ভারত ও বাংলাদেশে তেমনটা হয় না। সেখানে সরাসরি বিনিয়োগ আসে। এ ছাড়া ২০০০ সালের পর পাকিস্তানে যত এফডিআই এসেছে তার ৮০ শতাংশ বিনিয়োগ হয়েছে অ-রপ্তানি খাতে, যেখান থেকে সরাসরি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয় না। সামগ্রিকভাবে জিডিপির অনুপাতে বিনিয়োগ কমেছে। পাকিস্তানে ২০০৫-০৬ সালে যা ছিল জিডিপির ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ, এখন তা নেমে এসেছে ১৩ শতাংশে। কিন্তু দেশটিতে সামগ্রিক ভোগের পরিমাণ জিডিপির ৭৫ শতাংশ, এশিয়ার টাইগার খ্যাত দেশগুলোতেও যা এত বেশি নয়।
রাজস্ব ঘাটতিও দিনকে দিন বাড়ছে পাকিস্তানে। চলতি শতকে দেশটিতে মাত্র তিনবার চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত থেকেছে, যদিও ঘাটতি জিডিপির ৩ শতাংশ ছাড়িয়েছে ছয়বার। তবে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়ের কল্যাণে বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি অতটা বাড়বাড়ন্ত হয়নি, ২০০০ সালে যা ছিল জিডিপির ২ শতাংশের কম, এখন যা ৮ শতাংশে উঠে এসেছে। কিন্তু রেমিট্যান্স ও এফডিআই তো আর এক জিনিস নয়। এফডিআই এলে রপ্তানিমুখী শিল্পের প্রবৃদ্ধি হয়, যেখানে রেমিট্যান্স মূলত ভোগেই ব্যয় হয়। আর তাতে বোঝা যায়, পাকিস্তানের গ্রামাঞ্চলে বড় পরিবার ভেঙে পড়ছে।
প্রতিবছরই পাকিস্তানে রাজস্ব ঘাটতি হচ্ছে। ২০০০ সালের পর প্রায় প্রতিবছরই তা জিডিপির ৫ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। ১৯৯০-এর দশকে ট্যাক্স-জিডিপির অনুপাত ছিল ১৩ শতাংশ, এখন যা নেমে এসেছে ১০ শতাংশে। স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ব্যয় জিডিপির ৩ থেকে ১ শতাংশের মধ্যে আটকে আছে। ঋণের দায় মেটাতে প্রতিবছর বড় অঙ্কের টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে। প্রতিরক্ষা বাজেট কিছুটা কমেছে, তবে এখনো বিশ্বের সর্বোচ্চ বরাদ্দের কাতারে আছে। ২০১০ সালে সরকারি ঋণ ছিল জিডিপির ৬০ শতাংশের মতো, এখন যা ৯০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।
কেন পারল না পাকিস্তান
লেখক বলছেন, ভারত ও বাংলাদেশের মতো একই ইতিহাসের উত্তরাধিকারী হয়ে পাকিস্তান কেন পারল না, তার কারণ হিসেবে অনেকে হয়তো দুর্নীতি ও বংশগত রাজনীতির কথা বলবেন, কিন্তু ভারত-বাংলাদেশেও এই ধারা আছে। সে জন্য লেখক মনে করেন, ভুল নীতির কারণেই পাকিস্তানের আজ এই দুর্দশা। ভালো নীতি যে হয় না তা নয়, কিন্তু সেগুলোতে ধুলার আস্তরণ পড়ে যায়। বাংলাদেশ-ভারতে যার অনেকটাই বাস্তবায়িত হয়। তাই লেখকের অভিমত, পাকিস্তানের সমাজ, সরকার ও বেসরকারি খাতের সামগ্রিক অদক্ষতাই প্রধান সমস্যা।
গভীর রাষ্ট্রের করতলগত হয়ে নিরাপত্তা রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে ওঠাই সব নষ্টের গোড়া। এতে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়েছে। বেসামরিক প্রধানমন্ত্রী মেয়াদ পূর্ণ করতে পেরেছেন, এমন নজির বেশি নেই। সাবেক সেনাশাসক জিয়াউল হক রাজনীতিতে নিয়ন্ত্রণ সৃষ্টির অপচেষ্টায় এই ধারার সূত্রপাত করেন। মৌলবাদের বিস্তার আরেকটি বড় কারণ। এ ছাড়া লেখক বলছেন, পাকিস্তানের সেনা উদ্যোগগুলোর মতো বেসরকারি উদ্যোগগুলোও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার ওপর নির্ভরশীল। উদ্ভাবনের প্রয়োজন পড়ে না তাদের। তাই বাধাগ্রস্ত হচ্ছে স্বাভাবিক বিকাশ। সে জন্য এখন বলা হচ্ছে, পাকিস্তানকে ভূ-নিরাপত্তা থেকে ভূ-অর্থনীতিতে যেতে হবে।