পাবনা প্রতিনিধি : দেশে লিচুর রাজধানী হিসেবে খ্যাত পাবনার ঈশ্বরদী। এবারের লিচু মৌসুমে খরায় ফলন বিপর্যয়ে হতাশার মধ্যে পড়েছেন চাষিরা। তবে ভালো দাম পাওয়ায় মুখে হাসি ফুটেছে। কিন্তু বাদ সেধেছে আশানুরূপ লাভ হবে না। মওসুমের শুরুতে ২০ শতাংশ গাছে মুকুলের দেখা মিললেও অধিকাংশ গাছ ছিল শুন্য। এমন ফলন বিপর্যয় এ অঞ্চলের চাষিদের মধ্যে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। এমনিতেই ফলন কম, তারপর তীব্র তাপদাহে অনেক গাছের ফলনই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, লিচুর এই রাজধানী জুড়ে বিদেশী হাইব্রিড বোম্বে লিচু ও দেশীয় আটি জাতের লিচুর বাগান করা হয়েছে। ইতোমধ্যে বাগান মালিক ও ব্যবসায়ীরা দেশীয় প্রজাতির আটির লিচু ভাঙএগ শুরু করেছেন। তাদের মতে, জুন মাসের প্রথম দিকেই বোম্বে লিচু ভাঙ্গা শুরু হবে।
ঈশ্বরদী উপজেলা কৃষি অফিসের ভাষ্যমতে, জেলার ঈশ্বরদী পৌরসভা ও সাতটি ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে ৩ হাজার ১৫০ হেক্টর জমিতে লিচু গাছ রয়েছে ২ লাখ ৮৩ হাজার ৫০০ টি। বিঘা প্রতি ২০টি থেকে ১৫টি গাছ অর্থাৎ ১ একর জমিতে ৪২টি, ১ হেক্টর জমিতে ৯০টি গাছ হয়। লিচু আবাদি কৃষকের সংখ্যা ৯ হাজার ৬২০ জন। বাণিজ্যিক আকারে বাগান ২ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে। বিচ্ছিন্নভাবে বসতবাড়িতে আবাদ রয়েছে ৫৫০ হেক্টর। ফলন্ত আবাদি জমির পরিমাণ ২ হাজার ৮৩৫ হেক্টর জমি। লিচু উৎপাদন জমির পরিমাণ ২ হাজার ৮৩৫ হেক্টর। অফলন গাছ রয়েছে ৫৫ হাজার ৫৫০টি।
জানা যায়, ঈশ্বরদী উপজেলার ছলিমপুর, মানিকনগর, জয়নগর, মিরকামারি, আওতাপাড়া, বাঁশেরবাদা, সদর উপজেলার চকউগ্রগড়, জোয়ারদহ, হামিদপুর, জয়কৃষ্ণপুর, উগ্রগড়, মৌগ্রাম, আটঘরিয়া উপজেলার গোপালপুর, ত্রিমোহন, পরানপুর, হিদাশকোল, চাচকিয়া, ষাটগাছা, ডেঙ্গারগ্রামসহ বিভিন্ন গ্রামে ঢুকলেই চোখে পড়বে সারিসারি এমন লিচুর বাগান। সারাদেশের লিচুর চাহিদার একটি বড় যোগান আসে এসব গ্রাম থেকে।
প্রতিবছর ৫ থেকে ৬শ’ কোটি টাকার লিচু বিক্রি হয় এই উপজেলা থেকে। প্রতিবছর লিচুর বাম্পার ফলন হলেও এবার দেখা দিয়েছে বিপরীত চিত্র। এবার ১০ ভাগের এক ভাগ লিচুও উৎপাদন হচ্ছে না। ফলে এই এলাকার লিচু চাষি এবং ব্যবসায়ীরা হতাশ হয়ে পড়েছেন। দেশী প্রজাতির আটির লিচু ভাঙ্গা শুরুতেই ভালো দাম মেলায় চাষিদের মুখে হাসির ঝিলিক দেখা যায়।
এদিকে ঈশ্বরদী আবহাওয়া অফিসে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এবার লিচুর ভরা মৌসুমে প্রায় প্রতিদিন সকাল ১১টা বাজতে না বাজতেই ঈশ্বরদীর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৪ ডিগ্রি অতিক্রম করে, দুপুর নাগাদ ৩৬ থেকে ৩৮-৪০ ডিগ্রির মধ্যে ওঠা-নামা করেছে। ফলে এই আবহাওয়া লিচুর জন্য প্রতিকুল ছিল। কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে কাঙ্খিত মুকুল আসেনি। আবার যেটুকু এসেছে বৈরী আবহাওয়ার কারনে তা ঝড়ে পড়েছে।
আওতাপাড়া লিচু চাষী আব্দুল গাফুর জানান, তার ২০ বিঘার উপরে একটি লিচু বাগান আছে। প্রতি বছর ২০ থেকে ৩০ লাখ টাকার লিচু বিক্রি করেন তিনি। কিন্ত এ বছর তার বিঘা দুই জমিতে লিচু এসেছে। তাও প্রচন্ড খড়ায় ঝড়ে পড়েছে। এ বছর তিনি দুই থেকে তিন লাখ টাকার লিচু বিক্রি করতে পারবেন। তার পরিচর্যার সব টাকাই লোকসানের খাতায় গুনতে হচ্ছে।
ঈশ্বরদীর ছলিমপুরের লিচু চাষি শামসুল বলেন, তার ৫০ বিঘার উপর লিচু বাগান, এবার তার আতœীয় স্বজনের দেয়ার মতো লিচুও গাছে আসেনি।
ঢাকার পাইকারি লিচু ব্যবসায়ী মহিরুল ইসলাম জানান, প্রতি বছর মে মাসের মাঝামাঝিতে ট্রাক ট্রাক লিচু তিনি ক্রয় করতেন। কিন্ত এবছর তার ব্যবসায় চরম মন্দা। বাগানে লিচু নেই। হাটেও লিচুর দেখা মিলছে না। যা মিলছে অনেক দামে। প্রতি বছর তিনি শুধু লিচুর ব্যবসা করেই লাখ লাখ টাকা লাভ করেন।
লিচু ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রতি বছর একটি বড়গাছ থেকে প্রায় ১৫ থেকে ২০ হাজার লিচু পাওয়া গেলেও ফলন বিপর্যয়ের কারনে এ বছর বড়গাছ থেকে ১০ থেকে ১২ হাজারের বেশি লিচু পাচ্ছেন না। ফলন বিপর্যয় হয়েছে ছোটগাছ গুলোতেও। ১ থেকে ১.৫ হাজারের বেশি লিচু এ বছর পাওয়া যাচ্ছে না। প্রায় আড়াই লাখ টাকা দিয়ে তিন টি লিচু বাগান কিনে ৩.৫ থেকে ৪ লাখ টাকার লিচু বিক্রির টার্গেট থাকলেও ফলন বিপর্যয়ের কারনে এখন খরচ তুলতে হিমশিম খেতে হচ্ছে বলে জানান লিচু ব্যবসায়ী আব্দুস সালাম।
আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক ড. দেবাশীষ সরকার বলেন, সাধারণত জানুয়ারি মাসের শেষে এবং ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমে বোম্বাই লিচু গাছে মুকুল আসে। কিন্তু এবারে মধ্য জানুয়ারি থেকে হঠাৎ করে শীতের প্রকোপ কমে যাওয়ায় মুকুল কম অঙ্কুরিত এবং বেশি পরিমাণ পাতা গজিয়েছে। ফলে লিচু গাছে কম ধরেছে।
ঈশ্বরদী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল লতিফ জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কাঙ্খিত মুকুল আসেনি। এটি প্রাকৃতিক কারণ। এখানে কৃষক বা কৃষি বিভাগের কিছু করার নেই। এ বছর ঈশ্বরদীতে প্রায় ৩ হাজার হেক্টর জমিতে লিচুর আবাদ হয়েছে। কিন্ত এবার ফলন হয়েছে অনেক কম।