বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা প্রস্তাবিত বাজেট বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ আরও একধাপ এগিয়ে যাবে উল্লেখ করে বলেছেন, ‘আমি দৃঢ়ভাবে আশাবাদী, আমরা মানুষের জীবন-জীবিকা রক্ষার এই বাজেট বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হব। এতে বাংলাদেশ আরও একধাপ এগিয়ে যাবে। তাঁর সরকার ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সব সময় দেশের জনগণের পাশে রয়েছে এবং থাকবে। দেশের জনগণকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি যে, এই সঙ্কটে মানুষের জীবন ও জীবিকা রক্ষায় এবং অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের যে কোন প্রয়োজনে দ্রæততার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াব। সকল ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে আজকের বাংলাদেশ মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে, আরও এগিয়ে যাবে।’
যত টাকাই প্রয়োজন হোক না কেন সরকার প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিন সংগ্রহ করবে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা দেশের সকল নাগরিককে বিনামূল্যে ভ্যাকসিন দেব বলে ঘোষণা করেছি। এজন্য ভ্যাকসিন সংগ্রহের জন্য যত টাকাই লাগুক না কেন আমরা সেই টাকা দেব। পর্যায়ক্রমে ৮০ শতাংশ মানুষকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনা হবে। আশা করছি জুলাই মাস থেকে আরও ভ্যাকসিন আসবে। ব্যাপকভাবে ভ্যাকসিন প্রদান শুরু করব। করোনা সঙ্কটের মধ্যেও আমরা দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল রাখতে সক্ষম হয়েছি। এই মহামারী মোকাবেলা করে জনজীবন সুরক্ষায় আমরা সফল হব ইনশাল্লাহ। আমি শুধু এইটুকু বলব, এই মহামারী কাটিয়ে উঠে উন্নয়নের অভিযাত্রায় আমরা পুনরায় শামিল হতে পারব।
স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে মঙ্গলবার জাতীয় সংসদ অধিবেশনে প্রস্তাবিত ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনার সমাপনী বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী তাঁর সমাপনী দীর্ঘ বক্তব্যে করোনার সঙ্কটকালে দেশের মানুষের জীবন-জীবিকা রক্ষা এবং অর্থনীতির চাকাকে সচল রেখে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর সরকারের গৃহীত সকল পদক্ষেপ জাতির সামনে তুলে ধরেন। প্রধানমন্ত্রীর সমাপনী বক্তব্যের মাধ্যমে প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনা শেষ হয়েছে। আজ বুধবার প্রস্তাবিত এই অর্থবছরের বাজেট পাস হবে।
প্রস্তাবিত বাজেটকে ‘মানুষের জীবন-জীবিকা রক্ষার বাজেট’ আখ্যায়িত করে সংসদ নেতা বলেন, আমাদের দেশের মানুষের জীবন-জীবিকা রক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের যে বাজেট অর্থমন্ত্রী সংসদে পেশ করেছেন- আমি মনে করি সেই বাজেট বাস্তবায়ন করতে আমরা সক্ষম হব। বাংলাদেশ আরও একধাপ সামনে এগিয়ে যাবে এবং জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ ইনশাল্লাহ আমরা গড়ে তুলব।
লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই দেশে শহীদের রক্ত বৃথা যেতে পারে না উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই দেশের জনগণের ভাগ্য পরিবর্তন করতে গিয়েই জাতির পিতা জীবন দিয়ে গেছেন। সেই আমি আমার মা, তিন ভাই এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের হারিয়েছি। স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশ যেন সাফল্য অর্জন করতে না পারে, কোনদিন মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে সেই ষড়যন্ত্র নিয়েই এই আঘাত এসেছে। তবে, আজকের বাংলাদেশ মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে এবং এগিয়ে যাবে। অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্যে বাজেট দিলেও এই বাজেট নিয়ে বিরোধীদলীয় উপনেতা এবং সংসদ সদস্যদের সমালোচনার উত্তরে প্রধানমন্ত্রী তাদের বর্তমান বিশ^ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে তারপর মতামত দেয়ার আহŸান জানান।
যত টাকাই লাগুক ভ্যাকসিন দেয়া হবে ॥ দেশের ৮০ ভাগ মানুষকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনতে যত অর্থ প্রয়োজন হয় তা দিতে সরকার প্রস্তুত উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা দেশের সকল নাগরিককে বিনামূল্যে ভ্যাকসিন দেব বলে ঘোষণা করেছি। এজন্য ভ্যাকসিন সংগ্রহ করতে যত টাকাই লাগুক না কেন আমরা সেই টাকা দেব।
ভ্যাকসিন সঙ্কট কেটে যাওয়ার কথা জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, ভারতে করোনা ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করায় দেশটি ভ্যাকসিন রফতানি বন্ধ করে দেয়ায় আমরা সাময়িকভাবে সমস্যায় পড়ে গেছি। কিন্তু আল্লাহর রহমতে বর্তমানে আমাদের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। এখন আর কোন সমস্যা হবে না। চীন, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্রসহ ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী সব কোম্পানির সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ অব্যাহত আছে। আশা করছি জুলাই মাস থেকে আরও ভ্যাকসিন আসবে। ব্যাপকভাবে ভ্যাকসিন প্রদান শুরু করব। স্বাস্থ্য খাতকে সর্বাপেক্ষা অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, গত বছর আমরা করোনার প্রথম ঢেউ সফলভাবে মোকাবেলা করেছি। সেই অভিজ্ঞতায় দ্বিতীয় ঢেউয়ে আমরা দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে করেছি। মহামারী মোকাবেলা করে জনস্বাস্থ্য ও জনজীবন সুরক্ষা করতে আমরা সফল হব ইনশাল্লাহ।
করোনা নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য খাতে অতিরিক্ত বরাদ্দ, প্রণোদনা ও ক্ষতিপূরণ দেয়ার ব্যবস্থার কথা জানান সংসদ নেতা শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, করোনা মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউ এখনও বিদ্যমান থাকায় যেকোন জরুরী চাহিদা মোকাবেলায় আমরা এ বাজেটে ১০ হাজার কোটি টাকার বিশেষ বরাদ্দ রেখেছি। দ্রুততম সময় স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ১০ হাজার চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগসহ প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সংগ্রহ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। ভবিষ্যতে স্বাস্থ্য খাতে অভিঘাত থেকে মুক্তি পেতে সমন্বিত বিজ্ঞান গবেষণা উন্নয়ন তহবিল গঠন করা হয়েছে। বাজেটে এ খাতে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে।
ভ্যাকসিন প্রসঙ্গে সংসদে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, যখন ভ্যাকসিন নিয়ে গবেষণা চলছিল তখন পৃথিবীর সব জায়গায় আমরা যোগাযোগ করি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদন দেয়ার আগেই আমরা টাকা পাঠিয়ে ভ্যাকসিন বুক করেছি। ভাকসিন কেনার জন্য বাজেটে আমরা ১৪ হাজার ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছি। বিভিন্ন উৎস হতে ইতোমধ্যে এক কোটি ১৪ লাখ ৬ হাজার ডোজ ভ্যাকসিন সংগ্রহ করেছি।
ভ্যাকসিন প্রয়োগে প্রবাসী কর্মীদের অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, যারা বিদেশ যাচ্ছে তাদের আগে ভ্যাকসিন দেয়ার পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। যাতে বিদেশে গিয়ে তাদের কোয়ারেন্টাইন করতে না হয়। কর্মস্থলে যেতে পারে সেই ব্যবস্থা নিয়েছি। তিনি বলেন, পর্যায়ক্রমে দেশের ৮০ শতাংশ মানুষকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। কোন ভ্যাকসিন কোন বয়স পর্যন্ত দেয়া যাবে তার সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তা বিবেচনায় রেখে আমরা স্কুল থেকে শুরু করে সকলে যাতে ভ্যাকসিন পায় সেই পদক্ষেপ নিয়েছি। এর মাধ্যমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলতে পারে সেই ব্যবস্থা নেব
তিনটি গৌরবময় অধ্যায় করোনায় জর্জরিত ॥ বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, করোনাভাইরাসে সারা বিশ্ব ক্ষতিগ্রস্ত, এমন সময় আমরা বাজেট দিয়েছি। একদিকে সারা বিশ্ব করোনায় আক্রান্ত অপরদিকে আমাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। আমরা জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন করছি। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীও দ্যাপন করছি। একই সময় বাংলাদেশকে আমরা উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত করতে পেরেছি। এই তিনটি গৌরবময় অধ্যায়ের মাঝে করোনায় জর্জরিত।
তিনি বলেন, মহামারী দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাব সত্তে¡ও সরকারের পদক্ষেপে আমাদের অর্থনীতি পূর্ণাঙ্গভাবে পুনরুদ্ধারের পথে রয়েছে। আমাদের সরকার সঙ্কটকালে দেশের মানুষের পাশে আছে। মানুষের পাশে থাকবে। জনগণকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি যে, জীবন-জীবিকার সুরক্ষা দেয়া এবং অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে যেকোন উদ্যোগ নেয়ার প্রয়োজন হলে দ্রুততার সঙ্গে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করব। মানুষের পাশে আমরা দাঁড়াব।
করোনা সঙ্কটকালেও দেশ এগিয়ে যাওয়ার চিত্র তুলে ধরে সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেন, দেশবাসীর মাথাপিছু আয় এই করোনার মধ্যে বৃদ্ধি পেয়ে দুই হাজার ২২৭ মার্কিন ডলার হয়েছে। যা অনেক দেশকে ছাড়িয়ে গেছে। এই ধারাটা আমাদের অব্যাহত রাখতে হবে। এই সময়ে আমাদের রেমিটেন্স এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়টিও স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, আমাদের অর্থনীতি যথেষ্ট শক্তিশালী এবং এর মধ্যে শ্রীলঙ্কা ২৫০ মিলিয়ন ডলার ঋণ চাওয়ায় তাদের সেই ঋণ প্রদানের মাধ্যমে বাংলাদেশ সবসময় আঞ্চলিক সহযোগিতার বিষয়ে যে আন্তরিক সেটা প্রমাণ করেছে।
তিনি বলেন, তাছাড়া ঋণ মওকুফের মাধ্যমে সুদান ও সোমালিয়ার ঋণ মওকুফ তহবিলে বাংলাদেশ অংশ নিয়েছে। ফলে বাংলাদেশ যে অর্থনৈতিকভাবে সক্ষম আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সেটাই প্রমাণিত হয়েছে। এর ফলে বহির্বিশ্বে যেমন বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বেড়েছে, তেমনি জনগণের সম্মানও বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সামাজিক সূচক সমূহে আমাদের শক্ত অবস্থান বিশ্ব মহলে প্রশংসিত হয়েছে। জাতিসংঘ টেকসই উন্নয়ন প্রতিবেদন ২০২১-এর তথ্য অনুযায়ী এসডিজি বাস্তবায়সের অগ্রগতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্র্ষস্থানীয় তিনটি দেশের একটির স্বীকৃতি পেয়েছে এবং বৈশ্বিক শান্তিসূচকে বাংলাদেশের অবস্থান সাত ধাপ এগিয়েছে।
দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পথে ॥ মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাব সত্ত্বেও সরকারের বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজের ফলে দেশের অর্থনীতি পূর্ণাঙ্গ পুনরুদ্ধারের পথে রয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, কোভিড-১৯ এ সৃষ্ট অর্থনৈতিক সঙ্কট মোকাবেলা করতে আমরা আগেই একটি বিস্তারিত পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। আমরা সরকারী ব্যয় বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ব্যাংক ব্যবস্থাপনা থেকে স্বল্প সুদে ঋণ সুবিধা প্রদান, সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম বৃদ্ধি ও বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি করার উদ্যোগ নিয়েছি। আমরা আশু করণীয়, স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী এসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। আমাদের অন্যতম লক্ষ্য পুনরুদ্ধার কার্যক্রমের মাধ্যমে জনগণকে সুরক্ষা দেয়া। সব শ্রেণীর মানুষ যাতে সুবিধা পায় সেই ব্যবস্থা করা। সব পরিকল্পনা সফলভাবে বাস্তবায়নের কাজ আমরা গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেছি।
সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজের কথা উল্লেখ করে সংসদ নেতা বলেন, আমাদের প্রণোদনা প্যাকেজগুলোর অত্যন্ত সন্তোষজনকভাবে এগিয়ে চলছে। ২৩ প্যাকেজের এক লাখ ২৮ হাজার ৪৪১ কোটি টাকার বিপরীতে ২০২১ সালের মে পর্যন্ত বাস্তবায়ন হার ৭১ দশমিক ৫০ শতাংশ। এ পর্যন্ত ৬ কোটি ৫ লাখ ব্যক্তি এবং এক লাখ ৬ হাজার প্রতিষ্ঠান সরকারের এসব উদ্যোগের মাধ্যমে প্রত্যক্ষভাবে উপকৃত হয়েছে। প্যাকেজ কার্যক্রম থাকায় এই সংখ্যা সামনে আরও বাড়বে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সেবা খাতের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে ৪১ হাজার কোটি স্বল্প সুদে ঋণ সুবিধা প্রদান করা হয়েছে। এর মধ্যে গত মে পর্যন্ত তিন হাজার ২৮৮ হাজার প্রতিষ্ঠানকে ৩২ হাজার ৫৩৬ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। কুটির ও মাঝারি শিল্পের মধ্যে ২০ হাজার কোটি টাকার তহবিলের মধ্যে মে মাস পর্যন্ত ৯৬ হাজার ৬৭৫টি এসএমই প্রতিষ্ঠানের অনুক‚লে ১৪ হাজার ৭৭২ কোটি টাকা স্বল্প সুদে ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। প্রাপ্তদের মধ্যে নারী উদ্যোক্তা রয়েছেন ৫ হাজার ২৫৩ জন।
তিনি বলেন, করোনা আক্রান্তদের সেবায় সরাসরি নিয়োজিত চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের দুই মাসের বেতনের সমপরিমাণ বিশেষ সম্মানী দেয়া হয়েছে। এতে সাড়ে বিশ হাজার স্বাস্থ্যকর্মীকে ১০৪ কোটি টাকা সম্মানী প্রদান করা হয়েছে। তিনি বলেন, করোনা সেবায় সরাসরি সম্পৃক্ত বিভিন্ন সেক্টরের কর্মচারীদের মধ্যে করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণকারী ১৭৩ জনের পরিবারকে ৬৯ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়েছে। বাণিজ্যিক ব্যাংকে ঋণের বিপরীতে এক হাজার ২৯০ কোটি টাকা সুদ ভর্তুকি প্রদান করা হয়েছে। অতীতে দেশে কখনও সুদ ভর্তুকি দেয়া হয়নি। এতে ৭২ লাখ ৮০ হাজার ঋণ গ্রহীতা সুবিধা পেয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী এ প্রসঙ্গে আরও বলেন, সরকারের সময়োচিত ও সাহসী পদক্ষেপের ফলে এই দুর্যোগের সময় জীবন ও জীবিকা যেমন রক্ষা করা গেছে। তেমনি অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ও সচল রাখা সম্ভব হয়েছে। ফলে দেশের ও অর্থনীতি সার্বিকভাবে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাব সত্তেও সরকারের বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজের ফলে দেশের অর্থনীতি ূর্ণাঙ্গ পুনরুদ্ধারের পথে রয়েছে।
করোনায় দেশের ক্ষতি ১৭ বিলিয়ন ডলার ॥ করোনার কারণে দেশের অর্থনীতির ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বলে জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, অর্থনৈতিক অভিঘাত থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে আমরা ১৫ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ ২৩টি প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন করছি। এই প্যাকেজসমূহ বাস্তবায়নে করোনাভাইরাস ভ্যাকসিন ক্রয় ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যয় নির্বাহ করতে আমাদের সকল দ্বিপাক্ষিক ও বহু পাক্ষিক উন্নয়ন সহযোগীদের আমরা পাশে পেয়েছি।
তিনি বলেন, মহামারী নিয়ন্ত্রণে সরকারের দেয়া বিভিন্ন উদ্যোগ অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে ২০১৯-২০২০ এবং ২০২০-২০২১ অর্থবছরের ২ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলারের বাজেট সহায়তা ঋণ পেয়েছি। আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরে আরও প্রায় ২ বিলিয়ন ডলারের বাজেট সহায়তা পেতে যাচ্ছি। ভ্যাকসিন সাপোর্ট বাবদ আরও ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সহায়তা পাওয়ার আশ্বাস পেয়েছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের ব্যাপ্তি বাড়িয়েছি, যার ফলে করোনাকালে আয়ের সুযোগ সংক্ষিপ্ত হয়ে সাধারণ মানুষের দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাওয়ার ঝুঁকি হ্রাস পাবে। আগামী অর্থবছর হতে করোনাভাইরাসের গণটিকা কার্যক্রম পুনরায় শুরু করতে যাচ্ছি, যার ফলে অর্থনীতি দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে। কর্মসংস্থানের সুযোগ আবার বৃদ্ধি পাবে। এ সকল কার্যক্রম বাস্তবায়ন করলে দারিদ্র্য বিমোচনসহ অন্যান্য উন্নয়নের যে লক্ষ্য আমরা সেটা অর্জন করতে সক্ষম হব।
উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন আমাদের অর্থনীতির মূল লক্ষ্য উল্লেখ করে সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা বলেন, উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন সম্ভব। আমরা সমাজের অবহেলিত দরিদ্র মানুষের উন্নয়ন ঘটাতে চাই। প্রবৃদ্ধির সুফলটা যেন তৃণমূলের মানুষ পায় আমরা সেটাই করতে চাই। সেভাবেই সামাজিক নিরাপত্তা খাতকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছি। সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ২৭২ উপজেলায় এই কার্যক্রম চলবে। ২৫ হাজার নতুন উপকারভোগী যুক্ত হবে। অর্থাৎ ৫৭ লাখ বয়স্ক, ২৪ লাখ ৭৫ হাজার নারী এবং ২২ লাখ প্রতিবন্ধী ভাতা পাবে। এত লোককে একসঙ্গে ভাতা প্রাপ্তির উপযুক্ত করে দিচ্ছি। আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা যারা মাত্র ১২ হাজার টাকা করে মাসে পেত, তাঁদের ভাতা ২০ হাজার টাকায় উন্নীত করেছি। তার জন্য অতিরিক্ত ১ হাজার ৯২০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে।
শিক্ষার্থীদের খুবই কষ্ট হচ্ছে জানি ॥ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু না থাকায় শিক্ষার্থীদের খুবই কষ্ট হচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের টিকাদান ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। এই কার্যক্রম সম্পন্ন হলে আমরা কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দিতে সক্ষম হব। কোভিড-১৯ সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুল ও মাদ্রাসা খুলে দেয়া হবে।
তিনি বলেন, করোনা মহামারী প্রাদুর্ভাবের শুরু থেকেই শিক্ষার্থীদের পাঠ্যক্রমের ধারাবাহিকতা রক্ষায় ঘরে বসে টেলিভিশনের মাধ্যমে দূরশিক্ষণের কার্যক্রম চলছে। বাংলাদেশ বেতার, কমিউনিটি রেডিও এবং অনলাইনের মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখা হয়েছে। এতে প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থীদের দীর্ঘ এক বছর শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত রাখা সম্ভবপর হয়েছে। এই করোনা সঙ্কটের মধ্যেও চলতি বছরের ১ জানুয়ারি তাঁর সরকার স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করেছে এবং বৃত্তি ও উপবৃত্তি প্রদানও অব্যাহত রয়েছে।
ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করেই দেশ এগিয়ে যাচ্ছে ॥ জীবন-জীবিকা রক্ষায় সরকারের পদক্ষেপ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কোভিড-১৯ মহামারীর সময় উৎপাদনশীলতা বজায় রেখে অধিকাংশ কলকারখানা চালু রাখার ব্যবস্থা করি। একাধিক প্রণোদনা প্যাকেজের মাধ্যমে রফতানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকের বেতন ভাতা প্রদানের ফলে বিপুল সংখ্যক শ্রমিক কর্মচারীর কর্মসংস্থান টিকে রাখা সম্ভব হয়েছে। তিনি বলেন, বাজেটে মানুষের জীবন-জীবিকা সমন্বয়ের মাধ্যমে রাজস্ব নীতি প্রণয়নের চেষ্টা করা হয়েছে। সে লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রস্তাব করা হয়েছে। সাধারণ জনগণের বর্তমান অবস্থা বিবেচনা করে নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রধান প্রধান খাদ্য দ্রব্য ও অন্যান্য নিত্যসামগ্রী আমদানিতে শুল্ক কর অপরিবর্তিত রাখা, কৃষি খাতে বিশেষ প্রণোদনা বরাদ্দ। আরটিপিসিআর’র কাঁচামাল শুল্কমুক্তভাবে আমদানি করার সুযোগ প্রদান এবং উৎপাদনে ভ্যাট প্রত্যাহার সুবিধা দেয়া হয়েছে।
সংসদ নেতা বলেন, দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য ২ দশমিক ৫ শতাংশ কর্পোরেট কর হ্রাস করা হয়েছে। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশকে ব্রান্ড করার উদ্দেশ্যে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ এই ধারণা বিকাশে বিশেষ কর অবকাশ সুবিধা প্রদান করা হয়েছে। দেশীয় শিল্প বিকাশের লক্ষ্যে অটোমোবাইল মোটরসাইকেল ফ্রিজ মোবাইল ফোন ও তথ্যপ্রযুক্তির ডিভাইস উৎপাদনে ভ্যাট অব্যাহতি সম্প্রসারণ ও দশ বছরের কর অব্যাহত রাখা এবং শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে আগাম কর হ্রাস জরিমানা ও সুদের হার হ্রাসের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
সারাবিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি বিশ্বে অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেন, আমরা ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ দেশে উন্নীত এবং বাংলাদেশকে একটি সুখী সমৃদ্ধ উন্নত দেশে পরিণত করার লক্ষ্য রেখেই আমাদের সকল কার্যক্রম। আমরা যখন এই কাজগুলো করে যাচ্ছি তখন প্রাণঘাতী কোভিড-১৯ আক্রমণ। আগামী অর্থবছর হতে করোনাভাইরাসের গণটিকা কার্যক্রম পুনরায় শুরু করতে যাচ্ছি, যার ফলে অর্থনীতি দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে। আমি শুধু এইটুকু বলব, এই মহামারী কাটিয়ে উঠে উন্নয়নের অভিযাত্রায় আমরা পুনরায় শামিল হতে পারব।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের প্রবাস আয়, আমদানি-রফতানি, রাজস্ব আয় উর্ধগতি, সহনশীল মাত্রায় মুদ্রাস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, সহনীয় চলতি হিসাব ভারসাম্য ইত্যাদি সূচক নির্দেশ করে মহামারী করোনাভাইরাস মোকাবেলায় আমাদের গৃহীত প্রণোদনা প্যাকেজসমূহ দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখতে সফল হয়েছে। আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতি যথেষ্ট শক্তিশালী। বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বৃদ্ধি পেয়েছে, বাংলাদেশের জনগণের সম্মান বৃদ্ধি পেয়েছে। আমি দৃঢ়ভাবে আশাবাদী, লাখো শহীদের রক্তের বিনিময় এই দেশ অর্জন করেছি, এই অর্জন বৃথা যেতে পারে না। আমাদের দেশের মানুষের জীবন-জীবিকা রক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরের বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হব।
বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতার পরিবারের ওপর নির্মম আঘাতের কথা উল্লেখ করে বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া তাঁর জ্যেষ্ঠ সন্তান শেখ হাসিনা বলেন, আঘাতগুলো এসেছিল বাংলাদেশ যেন কোনমতে এগোতে না পারে। বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ হিসেবে যেন সাফল্য অর্জন করতে না পারে। সেই ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার আদর্শ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, আরও এগিয়ে যাবে।