বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যেও থেমে নেই গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রামবাসীর স্বপ্নের দ্বিতীয় তিস্তা সেতুর কাজ; যা এখন দৃশ্যমান। সেতুটির ২৯০টি পাইলের মধ্যে ১০১টি পাইল বসানোর কাজ শেষ হয়েছে। ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা জানিয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগ বা এলজিইডি। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার হরিপুর ঘাট থেকে তিস্তা নদীর ওপর দিয়ে কুড়িগ্রামের চিলমারী পর্যন্ত ১ হাজার ৪৯০ মিটার দৈর্ঘ্যের এ সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে।
বৃহৎ এ সেতুটি গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রামের বাসিন্দারা ছাড়াও কয়েক জেলার মানুষের ‘স্বপ্ন’ ও দীর্ঘদিনের ‘প্রাণের দাবি’ ছিল। সুন্দরগঞ্জের চণ্ডীপুর ইউনিয়নের উত্তর চণ্ডীপুর গ্রামের স্কুলশিক্ষক শরিয়ত উল্লা ১১ বছর আগে তিস্তা সেতু নির্মাণের দাবি তোলেন। সেই ২০০১ সালে শুরু হওয়া আন্দোলন-সংগ্রামের পর সেতু নির্মাণ আলোর মুখ দেখতে পায় ২০১২ সালে। শরিয়ত উল্লা মাস্টারের ডাকে সুন্দরগঞ্জের সবস্তরের মানুষ সেতুর দাবিতে সে সময় একটি কমিটিও গঠন করে। যার নাম দেয়া হয় ‘তিস্তা সেতু বাস্তবায়ন কমিটি’।
২০১৪ সালের ২৫ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভার্চুয়ালি নদীপারের লাখো মানুষের স্বপ্নের দ্বিতীয় এই তিস্তা সেতুর আনুষ্ঠানিক ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এই সেতু হলে ঢাকা-কুড়িগ্রাম ও ঢাকা-গাইবান্ধার যোগাযোগব্যবস্থা উন্নত হবে। তা ছাড়া এতে সড়কপথের দূরত্ব কমে আসবে প্রায় ১০০ কিলোমিটার। এলজিইডি অফিস সূত্রে জানা গেছে, সেতুটি নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৭৩০ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। এই বরাদ্দের ২৭৯ কোটি ৪৭ লাখ টাকা মূল সেতু নির্মাণে ব্যয় হবে। আর সড়ক নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ১০ কোটি ২৫ লাখ টাকা।
এ ছাড়া নদীশাসনে ৮ কোটি ৫৫ লাখ টাকা ও জমি অধিগ্রহণে ব্যয় হবে ৬ কোটি টাকা। এলজিইডির ব্যবস্থাপনায় নির্মিত সেতুটিতে পিলার স্থাপন হবে মোট ৩০টি। সেতুর উভয় পাশে নদীশাসন হবে ৩ দশমিক ১৫ কিলোমিটার করে। এ ছাড়া গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর-সুন্দরগঞ্জ-চিলমারী পর্যন্ত সংযোগ সড়ক নির্মাণ হবে ৮৬ কিলোমিটার। তিস্তাপারের বাসিন্দারা বলছেন, সেতুর কাজ শেষ হলে এটি হবে উত্তরাঞ্চলের নদীপারের মানুষের যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম। যোগাযোগের পথ সুগম হবে গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, লালমনিরহাট ও রংপুরের মানুষের।
একই সঙ্গে এসব জেলার তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র ও করতোয়া নদীপারের হাজারও মানুষের ব্যবসার প্রসার ঘটবে। চিকিৎসা, শিক্ষাসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধাও বৃদ্ধি পাবে। এদিকে নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার আগেই গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রাম জেলার মানুষ সেতুর দুই পাশে অসংখ্য দোকানপাট, খাবার হোটেল ও রেস্টুরেন্ট গড়ে তুলেছে। হরিপুর ঘাট এলাকার কৃষক আজগর আলী বলেন, ‘নদীর ওই পাড় যাই সোতরিয়ে (সাঁতার)। নৌকে ভড়া (ভাড়া) ঘাটের ভড়া বাঁচপার তেকনে (জন্য)। ব্রিজ হইলে আর নদী সোতরার নাগবে নয়; আস্তা (রাস্তা) দিই (দিয়ে) যাতায়াত করতি পারমু।’
একই এলাকার ফয়জার রহমান বলেন, ‘এই সেতুটে হবি হবি (হবে) কতে কতে (বলা) বহু লোক চলি গেছি, তাও দেখপার পায় নাই। হামার বাপ-দাদা; আরও বহু গ্রামবাসিও চলি গেছি। এই সেতুটে যে হলি; হামার জেবনের (জীবনের) সাধনা পালন হলো। মনের আশা পূরণ হলো।’
কাশেম বাজারের ব্যবসায়ী আইজল হক ব্যাপারি বলেন, ‘নদীভাঙন থেকে বাঁচতিচি। আবার নদী যখন শাসন হবে; তখন এই এলাকার সব অকেজো (পতিত) জমি কৃষিকাজে ব্যবহার হবে। দেশের উন্নয়ন হবে।’ পাশের উজান বোচাগাড়ি গ্রামের সোহেল মিয়া জানান, তিস্তা সেতু নির্মাণের দাবি ছিল স্বপ্নের কাঙ্ক্ষিদ দাবি। দীর্ঘ প্রায় এক যুগ পর সেই দাবি বাস্তবায়ন হওয়ায় আনন্দে ভাসছেন তিস্তাপারের বাসিন্দাসহ গোটা গাইবান্ধাবাসী। অনেকেই আবার সেতু ঘিরে নতুন ‘স্বপ্ন’ বুনছেন। কেউ বা আবার অধিগ্রহণে জমির কাঙিক্ষত দাম পেয়ে খুশি।
সোহেল মিয়া বলেন, ‘গাইবান্ধা একটা অবহেলিত এলাকা। সেতুটা হলে এখানে অনেক উন্নয়ন হবে। সবদিকে সুযোগসুবিধা বাড়বে। হঠাৎ করি একজন অসুস্থ রোগীকে তড়িঘড়ি করে হসপিটালে নিয়ে যেতে পারি না। কাঁধে করে বাড়ি থেকে ঘাট পর্যন্ত আনতে হয়। এরপর নৌকায় করে ওপর পৌঁছাতেই রোগী মারা যায়।’ সুন্দরগঞ্জ উপজেলা প্রকৌশলী আবুল মুনছুর আহম্মেদ জানান, সেতুটিতে ২৯০টি পাইল ও ৩০টি পিলার স্থাপন হবে। এর মধ্যে ১০১টি পাইল বসানোর কাজ শেষ হয়েছে। আগামী মাসেই পিলারের কাজ শুরু হওয়ার কথা রয়েছে।
তিনি জানান, সেতুর উভয় পাশে নদীশাসন হবে ৩ দশমিক ১৫ কিলোমিটার ও সড়কের নির্মাণকাজ হবে ৮৬ কিলোমিটার। সেতুটির নির্মাণকাজের সঙ্গে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে অ্যাপ্রোস রোডের কাজও। এ ছাড়া একটি অ্যাপার্টমেন্টের কাজও শেষ করেছে বাস্তবায়নকারী এলজিইডি কর্তৃপক্ষ।
মুনছুর আহমেদ বলেন, ‘সেতুটির দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৫০০ মিটারের কম হওয়ায় এটি বাস্তবায়ন করছে এলজিইডি। এটি এলজিইডির একটি বিরাট অর্জন। আমরা আশা করছি, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই কাজ শেষ হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘‘গাইবান্ধা জেলা শহরকে আমরা ‘পকেট’ শহর বলে থাকি। এখন আর আমরা এটাকে পকেট শহর বলতে পারব না। কেননা, সেতুটি কাজ শেষ হলে গাইবান্ধার সঙ্গে অন্য জেলা-উপজেলার নতুন সংযোগ স্থাপন হবে।’’