বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : অ্যামাজন, আলিবাবার মতো ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো যেখানে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করে সারা দুনিয়ায় নিজেদের প্রসার ঘটাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশের ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো চাতুর্যপূর্ণ অফার দিয়ে ক্রেতাদের সঙ্গে করছে প্রতারণা। এতে দেশের সম্ভাবনাময় এই ব্যবসাটি নিয়ে ভোক্তাদের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি হচ্ছে। ইভ্যালির পর এখন ই-অরেঞ্জ নামে আরেক প্রতিষ্ঠানের প্রতারণার বিষয়টি উঠে এসেছে। গ্রাহকদের অভিযোগ : ভোক্তাদের কাছ থেকে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকার অগ্রিম অর্থ নিয়ে এখন ই-অরেঞ্জ না দিচ্ছে কোনো পণ্য, না ফেরত দিচ্ছে টাকা। অভিযোগের প্রেক্ষিতে ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে গুলশান থানায় মামলা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির মালিক সোনিয়া মেহজাবিন ও তার স্বামী মাসুকুর রহমানকে জামিন নামঞ্জুর করে জেলহাজতে পাঠিয়েছে আদালত। অপরদিকে সাত দিনের মধ্যে সম্পদ ও লেনদেনের তথ্য জানতে চেয়ে প্রতিষ্ঠানটিকে শোকজ নোটিস দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া গতকাল দালালপ্লাস এবং শ্রেষ্ঠ ডটকম নামে আরও দুটি ইকমার্স প্রতিষ্ঠানকে বিধিবহির্ভূত অফার দেওয়ায় মৌখকভাবে সতর্ক করে দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেল।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধু ইভ্যালি বা ই-অরেঞ্জ নয়, বাংলাদেশে ব্যবসারত বেশির ভাগ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের কোনো টেকসই ব্যবসায়িক প্ল্যান নেই। তারা দেশের তরুণ ভোক্তাদের টার্গেট করে লোভনীয় ছাড় দিয়ে আকর্ষণীয় পণ্য ছাড়ে, যেটিতে স্বল্প সময়ে লাভবান হওয়া যায়। দেশের ই-কমার্সগুলোর ক্যাম্পেইন পর্যালোচনা করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দেখতে পেয়েছে, বেশিরভাগ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান মোটরবাইক, মোবাইল ফোনের মতো আকর্ষণীয় পণ্যগুলোতে অতিমাত্রায় ডিসকাউন্ট দিয়ে তরুণ প্রজন্মের ভোক্তাদের টেনে নিচ্ছে। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর এ ধরনের একের পর এক প্রতারণার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো। যে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসবে, সে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেই অ্যাকশনে যাবে বলে ঘোষণা দিয়েছে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো। সরকারের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এরই মধ্যে ই-অরেঞ্জের নামে মামলা হয়েছে। মালিকদেরও গ্রেফতার করা হয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকেও প্রতিষ্ঠানটির কোম্পানির খুঁটিনাটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেলের প্রধান বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. হাফিজুর রহমান বলেন, প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান বিষয়ে ভোক্তাদের অভিযোগ আসছে। আজও (গতকাল) দুটি প্রতিষ্ঠানকে সতর্ক করা হয়েছে।
তিনি বলেন, দালালপ্লাস নামে একটি প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের কাছ থেকে অগ্রিম অর্থ নিয়ে ৪০ থেকে ৪৫ দিন পর পণ্য সরবরাহের ক্যাম্পেইন করছে। প্রতিষ্ঠানটির সিইও জানিয়েছেন, তারা ৩০ দিন পর পর্যন্ত পণ্যটির ক্যাম্পেইন করবেন, ক্যাম্পেইন শেষে পরবর্তী ১০ দিনে পণ্য সরবরাহ করবেন। কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেলের প্রধান বলেন, এটি দালালপ্লাস কোম্পানির একটি চাতুর্যপূর্ণ পলিসি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে ই-কমার্স পরিচালনায় যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে তার পরিপন্থী। ওই নির্দেশনা অনুসারে অগ্রিম অর্থ গ্রহণ করার পরবর্তী ১০ দিনের মধ্যে পণ্য সরবরাহ করতে হবে। এখানে ক্যাম্পেইনের জন্য পৃথক কোনো সময় দেওয়া হবে না। এ বিষয়ে আমরা তাদের মৌখিকভাবে সতর্ক করে ওই ক্যাম্পেইনটি ওয়েবসাইট থেকে সরিয়ে নিতে বলেছি।
ই-কমার্সভিত্তিক উদ্যোক্তাদের অ্যাসোসিয়েশন ই-ক্যাবের হিসাবে, গত বছর তাদের সদস্যসংখ্যা ছিল ১ হাজারের ওপরে। বার্ষিক বিক্রির পরিমাণ ছিল ৮ হাজার কোটি টাকার মতো। এটি এখন আরও বেড়েছে। জার্মান ওয়েব পোর্টাল স্ট্যাটিস্টা গত বছর বৈশ্বিক ই-কমার্স ব্যবসা নিয়ে একটি প্রতিবেদন বলেছিল ওই বছর বাজারের আকার দাঁড়াবে ২ লাখ কোটি ডলার। প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশের বিষয়ে পূর্বাভাসে বলেছিল, ২০২০ সালে ই-কমার্সের আকার হতে পারে ১৯৫ কোটি ডলারের বেশি, যা স্থানীয় মুদ্রায় প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা। ভোক্তাদের আস্থার অভাবে এখন এই হাজার হাজার কোটি টাকার ই-কমার্সের ব্যবসা সংকটের মুখে।
এ পরিস্থিতিতে শুধু মামলা-মোকাদ্দমা আর চিঠি দিয়ে দিয়ে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, অন্যান্য দেশে কোনো একটি ব্যবসায়িক উদ্যোগ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সরকার সেই উদ্যোগটি সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য আইনি বিধি তৈরি করে। আমাদের দেশে নীতিকাঠামোগুলো তৈরি থাকে না। বাংলাদেশে পলিসি হয় সমস্যায় পড়ার পর। সিপিডির এই গবেষক বলেন, দেশের সম্ভাবনাময় ব্যবসায়িক খাত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে পরিচালিত হবে সে সম্পর্কে এখনো কোনো সমন্বিত আইন বা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো নেই। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য পৃথক কোনো কর্তৃপক্ষও নেই। জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অব ফার্মসের পরিদফতর থেকে নিবন্ধন নেওয়ার কারণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় একটা পলিসি বা নির্দেশিকা করেছে। আর্থিক লেনদেনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক হয়তো একটি গাইডলাইন দেবে। কিন্তু এর সঙ্গে জড়িত অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো নিয়ে একটি সমন্বিত আইনি কাঠামো এখনো করা হয়নি।