একটি আনন্দযাত্রা।
কাজী মাহমুদুর রহমান
আমি ছিলাম ঘুমন্ত–
কেমন যেন একটা স্বপ্নহীন ঘুমে।
কেউ যেন আমাকে কোমল কন্ঠে ডাকল,
মাহমুদ ওঠ, বেলা তো অনেক হল।
আমি চোখ মেলে তাকালাম, দেখলাম,
আশ্বিনের শাদা শাদা মেঘের মতো
আমার মায়ের মুখ, হাসি হাসি,
ঠোঁট দুটো আগের মতই পান রসে লাল টুক টুক।
পরণে পাড়হীন শাদা শাড়ি
মধ্যাহ্নের সূর্যের মতো আরো উজ্জ্বল ।
আমি বললাম, মা… মাগো… মা!
মা আমার দিকে হাত বাড়ালেন
এবং আমিও ।
আমায় বুকে জড়িয়ে , কপালে চুমু দিয়ে মা বললেন,
আয়রে সোনা আয়,
এখন যে তোর যাবার সময় ।
আমি যেন দেহের আগল খুলে
অচেনা অন্ধকার ঘর থেকে বাইরে এলাম
মায়ের হাত ধরে।
অবাক চোখে দেখি — এ কোথায়! এ তো
আমাদের সেই চেনা বাড়ির বারান্দা, উঠোন নয়, আমতলা, জামতলা নয় — এ কোথায় ?
এখানে আমরা কী এক গভীর নির্জনতায়
বনভূমির বিষণ্ণ ছায়ায় দাঁড়িয়ে —
যেখানে পাখির শব্দ নেই, বাতাসের গন্ধ নেই,
পাতা ঝরার শব্দ নেই, শুধু ঘাসের উপরে ঘাস,
কোনো পথরেখা নেই।
আছে শুধু এক চিলতে বিবর্ণ মাটির উপরে
শববাহী খাটিয়া — শুয়ে আছে শাদা কফিন মোড়া কোনো এক মৃতজন।
ওর কেউ কি নেই এই খাটিয়া বহনে আর
শেষ প্রার্থনায় ?
আমার অস্থির হাত মায়ের শান্ত হাতের মুঠোয়।
চারিদিকে তাকাই, আবছায়া দেখা যায়,
দূরে — বহুদূরে শাদা পোশাকের চারজন মানুষ
অথবা অলৌকিক দেবদূত অপেক্ষমান।
প্রথম একজন এগিয়ে এলেন, বললেন,
হে পুত্র — আমি তোর পিতা, অতীতের সেই মানুষ
দরিদ্র, সাধারণ, যার পরণে আমৃত্য ছিল শাদা পিরহান,
সিদেসাদা টুপির ইমাম কাজী মতিয়ার রহমান।
আমি এসেছি তোর শেষ জানাজায়, আত্মার প্রার্থনায়, এই শবাধার বহনে হাত আর কাঁধ দিতে
যেমনটি জড়ায়ে নিতাম তোরে আমার বুকে, কাঁধে
তোর শৈশব কিংবা বালক বয়সে –ও আমার বাপজান।
দ্বিতীয়জন এগিয়ে এলেন, বললেন, ওহে আমি মহীরুহ,
তোমার পিতামহ কাজী মহিউদ্দীন,
জীবদ্দশায় কেউ কাউরে দেখি নাই, তবুও নদীর স্রোতের মতো রক্তের টানে
এইখানেই ছুটে আসা এক গর্বিত পিতামহের,
তোমার আত্মার প্রার্থনায় আর রক্তের ঋণ শোধে, খাটিয়া বহনে কিছু দায়ভার কাঁধে নিতে।
তৃতীয়জন এগিয়ে এলেন, হেসে বললেন, শুধু রক্ত নয়,
বৃক্ষের গভীরতম শেকড়েরও টান আছে, সেই টানে
আমি সৈয়দ লুত্ফর খন্দকার — এক দুঃখী মাতামহ,
তোমার – আমার সম্পর্ক সে এক প্রাচীন ইতিহাস।
এই যে তোমার মাতা আপ্তাবোন নেসা, সেও স্মৃতিশূন্য।
কারণ, সে অকালেই পিতৃহারা যখন তার বয়সমাত্র
তিন কিংবা চার। আমার হাড়-পাঁজর কোনকালে মাটিতে মিশে গেছে, শুধু সর্পিল দাগের মতো স্মৃতিটুকু
রয়ে গেছে অলিখিত ইতিহাসের জীর্ণ পাতায়।
তাই মাটির গভীর থেকে অন্ধকার অনুভবে আমারও
উঠে আসা — একটি ইচ্ছেপূরণ —
তোমার মা’য়ের সাথে দু জনারে দ্যাখা,
আদরের হাতে দু জনারে ছুঁয়ে থাকা
আর দু জনারে সাথে নিয়ে
ফিরে যেতে চাওয়া আমার স্বপ্নময় অনন্ত সংসারে।
চতুর্থজন এগিয়ে এলেন , আর্তকন্ঠ তার। বললেন,
বাবারে আমি তোর সেই গেঁয়ো কাকা কাজী মছুমিয়া,
মনে কয় কতকাল তোর কন্ঠে” কাকা” ডাক শুনি নাই। আজ মনে হল তুই যেন সেই কুমোর নদীর ওইপার হতে আমাগের ভিটে বাড়ির গোরোস্তান তালতলা হতে ‘কাকা গো ‘ বলে অবিরাম দিতেছিস ডাক।
সেই ডাকে আমার পরাণ উথালপাতাল, এই ছুটে আসা,
তাই তোর জন্যিই কাকা, আমি তোর জানাজায়, তোর সগল ভার কান্ধে নিতি চাই।
এখন আমার অসীম আনন্দ, কোনো দুঃখভার নাই। আমার সকল ভার, সকল পাপ, পূণ্য, দুঃখ, বিষাদ
আমার চার পুরুষের কান্ধে কান্ধে। আমার হাত আমার মায়ের হাতের মুঠায়। চার বেহারার সুরেলা ধ্বনিতে অলৌকিক পালকিটা দুলতেছে.. চলতেছে অনন্ত
আনন্দ যাত্রায়। ঠিকানা জানা নাই — তবু চলে যাওয়া
হয়তো পিতৃপুরুষের সেই পুরাতন ছায়াঢাকা অন্ধকার তালতলায়।