বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : করোনা মহামারীর মধ্যেও সরকারের মেগা প্রকল্পে (ফাস্ট ট্র্যাক) কাজের অগ্রগতি বেড়েছে। সরকারের বিশেষ অগ্রাধিকারভুক্ত (ফাস্ট ট্র্যাক) প্রকল্পগুলোর মধ্যে বহুল আলোচিত পদ্মা সেতুর কাজ ৯৪ দশমিক ২৫ শতাংশ শেষ হয়েছে। মাত্র ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হলেই পূর্ণতা পাবে স্বপ্নের এ সেতু। এছাড়া চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত পদ্মা সেতুর রেলসংযোগ ও বহুল প্রত্যাশিত মেট্রোরেল প্রকল্পের অগ্রগতি হয়েছে ৪৩ শতাংশ। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্রের সার্বিক অগ্রগতি ৩৭ দশমিক ২৯ শতাংশ, মাতারবাড়ী বিদ্যুতকেন্দ্রের অগ্রগতি ৪৮ দশমিক ৫৩ শতাংশ, রামপাল বিদ্যুতকেন্দ্রের অগ্রগতি ৬৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ এবং দোহাজারী-ঘুমধুম ডুয়েলগেজ ট্র্যাক প্রকল্পের অগ্রগতি হয়েছে ৬১ শতাংশের মতো। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব প্রকল্পে কাজের গতি স্বাভাবিক রাখতে মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করার বিকল্প নেই। এ লক্ষ্যে শীঘ্রই প্রকল্প পরিচালকদের (পিডি) সঙ্গে বৈঠকে বসবে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, মূল্যায়ন ও পরিবীক্ষণ বিভাগ (আইএমইডি) তথ্য মতে, বর্তমান সরকারের বিশেষ অগ্রাধিকারভুক্ত (ফাস্ট ট্র্যাক) প্রকল্পগুলোর মধ্যে বহুল আলোচিত পদ্মা সেতুর কাজ ৯৪ দশমিক ২৫ শতাংশ শেষ হয়েছে। অর্থাৎ মূল সেতুর কাজের আর বাকি মাত্র ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ। মূল সেতুর কাজের চুক্তিমূল্য প্রায় ১২ হাজার ৪৯৪ কোটি টাকা। যার মধ্যে চলতি বছরের ৩১ জুলাই পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে প্রায় ১১ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা। সেতুর বাকি কাজে প্রায় ১ হাজার ২২৭ কোটি টাকা ব্যয় করতে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত সময় রয়েছে। আর পদ্মা সেতুর রেলসংযোগ প্রকল্পের নক্সা জটিলতা কেটেছে। এই প্রকল্পের অগ্রগতি ৪৩ শতাংশ। এছাড়া মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র, দোহাজারী-রামু হয়ে ঘুমধুম পর্যন্ত ডুয়েলগেজ রেললাইন ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্পসহ ফাস্ট ট্র্যাকভুক্ত অন্য মেগা প্রকল্পগুলোতে কাজের গতি ফিরেছে। পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, ‘করোনার প্রভাব সারা বিশ্বেই পড়েছে। মহামারীর পরিস্থিতির মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ ও সাহসী নেতৃত্বের কারণে আমরা এগিয়ে চলছি। জীবন ও জীবিকা স্বাভাবিক রয়েছে। তবে সার্বিক উন্নয়ন কর্মকা-ের গতিতে কিছুটা ব্যাঘাত ঘটেছিল। কিন্তু কাজের গতি স্বাভাবিক করতে সরকার বেশ আন্তরিক। আমরা শীঘ্রই প্রকল্প পরিচালকদের (পিডি) সঙ্গে বৈঠকে বসব। কাজের খোঁজখবর নেব। সমস্যা থাকলে সমাধানে পদক্ষেপ নেয়া হবে।’
পদ্মা সেতু ॥ নানা চড়াই-উতরাই পার করে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে সেতুটি চলাচলের জন্য উদ্বোধন করার কথা ছিল। তবে করোনার কারণে দুই বছর মেয়াদ বাড়াতে হয়েছে। ইতোমধ্যে কাজ শেষ হয়েছে ৯৪.২৫ শতাংশ। গত সোমবার সেতুটির সব রোডওয়ে স্ল্যাব বসানোর কাজ শেষ হয়েছে। মূল সেতুর মোট ২ হাজার ৯১৭টি রোডওয়ে স্ল্যাবের সর্বশেষটি বসানো হয়। এখন পিচঢালাই হয়ে গেলেই ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সেতুর সড়কপথ যান চলাচলের উপযোগী হয়ে যাবে। সেতুর বুকে সব রোডওয়ে স্ল্যাব বসাতে সময় লেগেছে প্রায় ৩ বছর ৫ মাস। এ প্রসঙ্গে পদ্মা সেতুর প্রকল্প পরিচালক মোঃ শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘করোনার কারণে কাজে একটু ব্যাঘাত ঘটেছিল। চীনা পরামর্শক ও প্রকৌশলীরা কাজ করতে পারেননি। তবে এখন পুরোদমে কাজ চলছে।’
২০০৯ সালের জানুয়ারিতে পদ্মা সেতু প্রকল্পের অনুমোদন হলেও ২০১৪ সালের ডিসেম্বর পদ্মা সেতুর মূল নির্মাণকাজ শুরু হয়। ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর খুঁটিতে প্রথম স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান হয় সেতুর অবকাঠামো। এরপর একে একে ৪২টি পিলারে ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যরে ৪১টি স্প্যান বসিয়ে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু পুরোপুরি দৃশ্যমান হয়েছিল ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর। একই সঙ্গে চলতে থাকে রোডওয়ে ও রেলওয়ে সø্যাব বসানোসহ অন্যান্য কাজ। ২০২২ সালের জুন মাসের মধ্যেই এ সেতু যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়ার কথা রয়েছে। তবে প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। ২০০৯ সালে প্রকল্পটির মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার কোটি টাকা। এরপর তিন দফা সংশোধনের মাধ্যমে প্রকল্পের ব্যয় বাড়ানো হয়। এখন প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। সম্পূর্ণ জিওবি অর্থায়ন থেকে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
পদ্মা সেতু রেল লিংক ॥ পদ্মা সেতুর বুক চিরে চলে যাবে ট্রেন। সেজন্য আলাদাভাবে তৈরি করা হচ্ছে পদ্মা সেতু রেলসংযোগ প্রকল্প। গত জুলাই পর্যন্ত এর অগ্রগতি ৪৩ শতাংশ। নক্সা জটিলতার কারণে প্রকল্পটির কাজে সমস্যা হচ্ছিল। তবে এখন সে সমস্যা কেটে গেছে। এ প্রসঙ্গে রেলসংযোগ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) গোলাম ফখরুদ্দীন এ চৌধুরী বলেন ‘কাজে কোন সমস্যা নেই, এখন পুরোদমে কাজ চলছে।’
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের যোগাযোগ বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে পদ্মা সেতু রেলসংযোগ প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। এতে পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত ১৭৩ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রকল্পে সংশোধিত ব্যয় ধরা হয় ৩৯ হাজার ২৫৮ কোটি ১৩ লাখ টাকা। এতে চীন সরকারের বিনিয়োগের পরিমাণ ২১ হাজার ৩৬ কোটি টাকা। বাকি ১৮ হাজার ২১০ কোটি টাকা সরকার নিজে জোগান দিচ্ছে। ২০১৬ সালে প্রকল্পটি অনুমোদনের সময় ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩৪ হাজার ৯৮৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। মেয়াদ ধরা হয়েছিল ২০২২ সালের ডিসেম্বর; কিন্তু ২০১৮ সালের এপ্রিলে প্রকল্পের ব্যয় আরও ৪ হাজার ২৬৯ কোটি ২৭ লাখ টাকা বাড়িয়ে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়।
মেট্রোরেল ॥ বহুল প্রত্যাশিত মেট্রোরেল প্রকল্পের গতি করোনার কারণে কিছুটা কমে গিয়েছিল। এখনও ঝিমিয়ে পড়া ভাব থেকে পুরোপুরি বের হয়ে আসতে পারেনি প্রকল্পটি। চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত ৪৩ শতাংশ কাজ হয়েছে। জাপানের সহায়তায় মেট্রোরেল প্রকল্পের নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে ২০১২ সালের জুলাইয়ে। শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৯ সালের জুনে। তবে প্রকল্পের আশানুরূপ অগ্রগতি না থাকায় স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে ২০২১ সালের বিজয় দিবসে দেশের প্রথম মেট্রোরেল প্রকল্প উদ্বোধনের সংশোধিত তারিখ নির্ধারণ করা হয়। ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকার প্রকল্পে জাপান সরকারের উন্নয়ন সংস্থা জাইকা ঋণ দিচ্ছে ১৬ হাজার ৫৯৪ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। প্রথম পর্যায়ের জন্য নির্ধারিত উত্তরা তৃতীয় পর্ব হতে আগারগাঁও অংশে পূর্তকাজের অগ্রগতি ৬৮ শতাংশ। দ্বিতীয় পর্যায়ের জন্য নির্ধারিত আগারগাঁও থেকে কাওরানবাজার পর্যন্ত অংশের পূর্তকাজের অগ্রগতি ৪০ দশমিক ৩০ শতাংশ। কাওরানবাজার থেকে মতিঝিল পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি ৪২ দশমিক ৩৮ শতাংশ। আলোচিত এ তিন প্রকল্প ছাড়াও অন্যান্য মেগা প্রকল্পের অগ্রগতি নিয়েও আইএমইডি সন্তুষ্ট নয়। আইএমইডি বলেছে, ফাস্ট ট্র্যাকভুক্ত জাতীয় অতি গুরুত্বপূর্ণ বিশাল এসব প্রকল্পে যে ধরনের গতি থাকা প্রয়োজন কার্যত তা নেই। নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ করতে, অসম্পূর্ণ কাজ সম্পন্ন করতে বাস্তবসম্মত সময়ভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা করার সুপারিশ করেছে সংস্থাটি। এছাড়া মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে বলা হয়েছে। এর আগেই একই ধরনের সুপারিশ করা হয়েছিল।
ফাস্ট ট্র্যাকের আওতাভুক্ত অন্য প্রকল্পগুলো হলো রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র, রামপাল বিদ্যুতকেন্দ্র, মাতারবাড়ী বিদ্যুতকেন্দ্র, পদ্মা সেতুতে রেলসংযোগ, মেট্রোরেল প্রকল্প, দোহাজারী-রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু-মিয়ানমারের কাছে ঘুমধুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্প ও পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্প।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র ॥ দেশের প্রথম পারমাণবিক এ বিদ্যুতকেন্দ্রটি অর্থের বিবেচনায় সবচেয়ে বড় প্রকল্প। এ প্রকল্পের ব্যয় ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন হবে। গত জুলাই পর্যন্ত সার্বিক অগ্রগতি ৩৮ দশমিক ৬৭ শতাংশ। এ পর্যন্ত ব্যয় করা হয়েছে ৪২ হাজার ১৭৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ সার্বিক কাজে গতি খুব একটা নেই। ২০২৫ সালের ডিসেম্বর নাগাদ প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার কথা। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়।
মাতারবাড়ী বিদ্যুতকেন্দ্র ॥ গত জুলাই পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে ৪৮ দশমিক ৫৩ শতাংশ। ৩৫ হাজার ৯৮৪ কোটি টাকার প্রকল্পে এ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ১৭ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে জিওবি অংশে ২ হাজার ৪১০ কোটি টাকা, প্রকল্প সাহায্য অংশে ১৪ হাজার ৭৯৭ কোটি টাকা এবং সংস্থার নিজস্ব অর্থায়ন থেকে ২৫৮ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। কক্সবাজারের মহেশখালীতে ১২০০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপনের প্রকল্পটি নেয়া হয় ২০১৪ সালের জুলাই মাসে। জাপান সরকারের সহযোগিতায় এ প্রকল্পটি ২০২৩ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা।
রামপাল বিদ্যুতকেন্দ্র ॥ বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ উদ্যোগে এ বিদ্যুতকেন্দ্রটি নির্মিত হচ্ছে। বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি (বিআইএফপিসিএল) প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। এ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৬ হাজার কোটি টাকা। ২০০৯ সালের জুলাই থেকে এর কাজ শুরু হয়েছে। ২০২০ সালের জুনে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এক বছর মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। গত জুলাই পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতি ৬৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ। প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি সন্তোষজনক নয় বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
দোহাজারী-ঘুমধুম ডুয়েলগেজ ট্র্যাক ॥ মিয়ানমারের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ স্থাপনে দোহাজারী-রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু-মিয়ানমারের কাছে ঘুমধুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্প শুরু হয় ২০১০ সালের জুলাই মাসে। ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্পটি জুলাই পর্যন্ত অগ্রগতি ৬১ শতাংশ। রেলপথ সৃষ্টিতে মাটি ভরাট শেষ করে এখন চলছে লাইন স্থাপনের কাজ। সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্পের অন্যতম এই প্রকল্পের শ্রমিকরা প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা কাজ করছেন। ফলে দোহাজারী-কক্সবাজার ১০০ কিলোমিটার রেলপথের বাস্তবায়ন কাজ এখন দৃশ্যমান।