বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : দেশে শিশুদের চিকিৎসার সবচেয়ে বড় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান রাজধানীর ‘ঢাকা শিশু হাসপাতাল’ ইনস্টিটিউটে রূপান্তর হচ্ছে। এ জন্য ‘বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট আইন ২০২১’ তৈরির কাজ চলছে। প্রয়োজনীয় সংশোধন শেষে আইনটি বিল আকারে জাতীয় সংসদে উত্থাপনের অপেক্ষায় রয়েছে। আগামী ১ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া একাদশ জাতীয় সংসদের চতুর্দশ (২০২১ সালের চতুর্থ) অধিবেশনে আইনটি বিল আকারে উত্থাপনের কথা রয়েছে। এ ব্যাপারে স্থায়ী কমিটির সদস্য সিরাজগঞ্জ-৩ আসনের সাংসদ ও ঢাকা শিশু হাসপাতালের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. আব্দুল আজিজ বলেন, প্রয়োজনীয় সংশোধন শেষে আইনটি জাতীয় সংসদের আগামী অধিবেশনেই বিল আকারে ওঠার কথা রয়েছে। স্থায়ী কমিটি কাজ শেষ করেছে।
এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত আওয়ামী লীগ সমর্থিত চিকিৎসকদের পেশাজীবী সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সভাপতি অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান বলেন, ঢাকা শিশু হাসপাতাল ইনস্টিটিউটে রূপান্তর হচ্ছে। এর জন্য প্রস্তাবিত আইনটি স্থায়ী কমিটিতে গেছে। সেখানে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় সংশোধনীসহ বিল আকারে সংসদে উপস্থাপনের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। আগামী সংসদ অধিবেশনেই উত্থাপনের জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে। আইনটি হয়ে গেলে সেই আইন অনুযায়ী হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট চলবে।
বর্তমানে ঢাকা শিশু হাসপাতাল ও এর একাডেমিক ভবন হিসেবে ‘বাংলাদেশ শিশু স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট’ একই প্রশাসনের অধীনে পৃথকভাবে চলছে। দুটিই স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। নিজেদের আয়ের পাশাপাশি সরকারি অনুদানে পরিচালিত হয়। এর আগে গত ৯ মার্চ এ-সংক্রান্ত আইনের খসড়ায় চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। খসড়া আইনটি হচ্ছে ‘বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট আইন ২০২১’। ২০২০ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি এটি প্রাথমিকভাবে অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল।
পরে গত ২৮ জুন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক এ-সংক্রান্ত ‘বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট বিল-২০২১’ সংসদে উত্থাপন করেন। পরে বিলটি পরীক্ষা করে সংসদে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়। কমিটি প্রস্তাবিত আইনের খসড়ায় প্রয়োজনীয় সংশোধনী এনে আগামী সংসদ অধিবেশনে উত্থাপনের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে।
এ ব্যাপারে ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. সৈয়দ শাফি আহমেদ বলেন, ইনস্টিটিউট এখনো আছে, ‘বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথ’। এটা ঢাকা শিশু হাসপাতালের একাডেমিক উইং। দুটি প্রতিষ্ঠান এক হয়ে এখন ঢাকা শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট হচ্ছে। এত দিন আইন না থাকায় দুটি আলাদাভাবে পরিচালিত হয়েছে। এখন দুই প্রতিষ্ঠান একসঙ্গে পরিচালনার জন্য নতুন আইন হচ্ছে। এত দিন একটা অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে চলছিল। এই সংসদে বিল আকারে আইনটা উত্থাপন করার কথা রয়েছে। সেখানে পাস হলে আইনে রূপ নেবে।
হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট একসঙ্গে হলে চিকিৎসাসেবা ও চিকিৎসা শিক্ষার পরিধি বাড়বে বলে মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। তিনি বলেন, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে সরকারের অনুদানও বাড়বে। দুটি প্রতিষ্ঠান একসঙ্গে নির্দিষ্ট আইনের অধীনে চলবে। একীভূত হলে একটা বড় প্রতিষ্ঠানে রূপ নেবে, একসঙ্গে কাজ করবে।
হাসপাতালের পরিচালক বলেন, হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট এক হলে সুবিধা অনেক। একটা আইন হলো, আগে আইন ছিল না। একটা শৃঙ্খলার মধ্যে চলে আসবে। বিদেশি কোনো ইউনিভার্সিটি বা সংস্থা থেকে সরকারের অনুমোদন নিয়ে এখান থেকে ডিগ্রি দেওয়া যাবে, এটা বিরাট ব্যাপার হবে। উচ্চশিক্ষার কলেবরও বাড়বে। তখন উচ্চশিক্ষার বিভিন্ন কোর্সে আরও বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থী পড়ালেখার সুযোগ পাবেন।
হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট একীভূত হলে যেসব সুবিধা : ঢাকা শিশু হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানান, দক্ষ ব্যবস্থাপনা, শিক্ষার মানোন্নয়ন ও উন্নত সেবা নিশ্চিতের জন্য দুটি প্রতিষ্ঠান একীভূত হচ্ছে। এটি এই প্রতিষ্ঠানে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক সেবা নিশ্চিত করা যাবে। গবেষণাসহ উচ্চশিক্ষার বিষয়টি থাকবে। শিশুর জন্য পুষ্টিমূলক শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও গবেষণামূলক কার্যক্রম এবং শিশুর শারীরিক ও মানসিক উন্নয়নে বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষাগার, ব্যায়ামাগার ও শিশুকর্নার থাকবে।
চিকিৎসকরা আরও জানান, আইন হলে এই প্রতিষ্ঠান বিশ্বের বিভিন্ন স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থেকে বিশেষায়িত শিশু চিকিৎসার ওপর স্নাতকোত্তর বা স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা ও মেডিকেল টেকনোলজির বিষয়ে স্নাতক ও ডিপ্লোমা কোর্স পরিচালনা করতে পারবে। এ ছাড়া কোনো বিদেশি বিশ^বিদ্যালয়ের অনুমোদন নিয়ে বিভিন্ন কোর্স পরিচালনা করতে পারবে। এ ছাড়া শিশু স্বাস্থ্য বা মাতৃস্বাস্থ্য এ-সংক্রান্ত সার্টিফিকেট বা প্রশিক্ষণ পরিচালনা করতে পারবে।
প্রস্তাবিত আইনে বলা হয়েছে, এই আইন কার্যকর হওয়ার পর ঢাকা শিশু হাসপাতাল ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথ এই আইনের অধীনে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট নামে গণ্য হবে। শিশুদের শারীরিক ও মানসিক সেবা নিশ্চিতকরণ ও মানোন্নয়ের উদ্দেশ্যে সংবিধিবদ্ধ একটি হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা লাভ করবে। এখানে গবেষণাসহ সব ধরনের লেখাপড়া হবে। খসড়া আইনে বলা হয়েছে, ইনস্টিটিউট পরিচালনা বোর্ডের সভাপতি সরকার নিয়োগ দেবে। জাতীয়ভাবে সুনাম অর্জনকারী শিশু চিকিৎসা বিষয়ে একজন জ্যেষ্ঠ অধ্যাপককে সভাপতি নিয়োগ দেওয়া হবে। এখনকার মতো হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের প্রধান থাকবেন পরিচালক।
শিশুদের সবচেয়ে বড় হাসপাতাল : হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ঢাকা শিশু হাসপাতালে ৬৭০ শয্যা রয়েছে। এর মধ্যে প্রি-আইসিইউ (নিবিড় পরিচযা কেন্দ্র) ১৬ বেড, এনআইসিইউ (নবজাতক নিবিড় যত্ন ইউনিট) ১৬ বেড, সিসিএনবি ৮ বেড, কার্ডিয়াক আইসিইউ ৮ বেড ও এইচডিও (হাই ডিপেন্ডেনসি ইউনিট) ২০ বেড। এখানে পাঁচটি বিভাগ রয়েছে পেডিয়াট্রিক মেডিসিন, পেডিয়াট্রিক সার্জারি ও অ্যানথেসিয়া এবং ডায়াগনস্টিক বিভাগ।
অন্যদিকে, একাডেমিক ভবন ‘বাংলাদেশ শিশু স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট’-এ বিভিন্ন শিশু রোগের স্নাতকোত্তর কোর্স, যেমন এফসিপিএস, এমডি, এমএস, ডিসিএ, ডিপ্লোমা ইন পেডিয়াট্রিক নার্সিং এবং বিএসসি হেলথ টেকনোলজি ইত্যাদি রয়েছে। এই প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ান অ্যান্ড সার্জনসের (বিসিপিএস) সঙ্গে যুক্ত। এই ইনস্টিটিউট যুক্তরাজ্যের লন্ডনের শিশু স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, যুক্তরাজ্যের এডিনবরার শিশু স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট এবং যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটির সঙ্গে গবেষণার কাজ করে।
উচ্চশিক্ষায় কাজ করছে ইনস্টিটিউট : ঢাকা শিশু হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানান, এখন যে ইনস্টিটিউট সেখানে চিকিৎসা উচ্চশিক্ষার ওপর ১৫টি কোর্স আছে। নার্সিংসহ বিভিন্ন কোর্স চলছে। শিশু চিকিৎসা বিভাগের যত বিষয় আছে, সবগুলোর এমডি, এমএস (সার্জারি), এফসিপিএসসহ বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ কোর্স আছে। এখন পর্যন্ত এখান থেকে ৭০০ জন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট চিকিৎসক ও নার্স স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তারা সারা দেশে শিশু বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করছেন। বাংলাদেশে যত শিশু সার্জারি বিশেষজ্ঞ আছেন, তাদের বেশির ভাগই এখান থেকে পাস করা। তারা এখন বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে কর্মরত রয়েছেন।