বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : মাদক বা নেশাজাতীয় দ্রব্য-শব্দটি শুনলেই যে কারোর মধ্যে ঘৃণার উদ্রেক হয়। মাদক সেবন করছে যে ব্যক্তি সে কারো না কারো ভাই, বোন, বন্ধু, পিতা বা মাতা অথবা আত্মীয়। অন্যরা তাকে ত্যাগ করলেও পরিবারের সদস্যরা তাকে ফেলে দিতে পারে না। পরিবারের সদস্যদের মতো মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের চিকিত্সা দিতে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের পরিচালনায় ‘ওয়েসিস মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র’ নামে একটি আধুনিক মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। ৬০ বেডের এই প্রতিষ্ঠানটি কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদে রিভারভিউ আবাসিক এলাকায় অবস্থিত। পুলিশের আইজি ড. বেনজীর আহমেদের প্রচেষ্টায় একদল দক্ষ কর্মী বাহিনী এবং স্বনামধন্য টেকনিশিয়ান ও বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকবৃন্দের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে এ কেন্দ্র। যেখানে তুলনামূলক কম খরচে বিশ্বমানের চিকিত্সা প্রদান করা হবে।
আগামী পহেলা অক্টোবর থেকে সেখানে রোগী ভর্তি শুরু হবে। এর পাশাপাশি মানিকগঞ্জে নির্মাণ করা হবে একই মানের ৩০০ বেডের হাসপাতাল। সরকারি হিসেবে দেশে ৩৬ লাখ মানুষ মাদকাসক্ত। তবে সরকারি ও বেসরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশের ৮০ লাখ মানুষ মাদকে আসক্ত। দেশে মাদকাসক্তদের সরকারিভাবে চিকিত্সা ব্যবস্থা খুবই সীমিত। মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অধীনে তেজগাঁও মাদক নিরাময় কেন্দ্রে বেড আছে ১২৪টি। পাবনায় মানসিক হাসপাতালে মাদকাসক্তদের জন্য বেড আছে ২৫টি। শ্যামলীর মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে বেড আছে ২০০টি। এরমধ্যে মাদকাসক্তদের জন্য বরাদ্দ আছে ৫০টি বেড। সব মিলিয়ে মোট বেড আছে ২৪৯টি। যদিও কোনো কোনো মহল মাদকাসক্তকে সামাজিক সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তবে সাইকোলজিস্ট, সাইকিয়াট্রিকদের মতে, এটি একটি রোগ। এর চিকিত্সা সেবা অবহেলিত।
ওয়েসিস মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্রটি চলবে পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হাবিবুর রহমানের তত্ত্বাবধানে। এর পরিচালকের দায়িত্ব পালন করবেন পুলিশ সুপার (এসপি) ডা. এস এম শহীদুল ইসলাম। নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্রটি সাত তলা বিশিষ্ট। প্রতিটি ফ্লোরে রয়েছে নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এমন ব্যবস্থা করা হয়েছে যাতে কোনো রোগী আত্মহত্যা করতে না পারে। এসি ও নন-এসি রুম আছে। দুই, তিন ও চার বেডের কেবিন রয়েছে। রয়েছে পুরুষ ও মহিলাদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা। প্রতিটি তলায় ডিউটি ডাক্তার ও নার্স থাকবেন। এখানে থাকবে অত্যাধুকি ডোপ টেস্ট মেশিন ‘গ্যাস প্রমোটো গ্রাফি’। বর্তমানে শুধু প্রস্রাব পরীক্ষা করে ডোপ টেস্ট করা হয়। কিন্তু ‘গ্যাস প্রমোটো গ্রাফি’ তে চুল ও নাক থেকেও পরীক্ষা করা যাবে। বর্তমানে মাদক গ্রহণের তিন দিনের মধ্যে পরীক্ষা করতে হয়। কিন্তু আধুনিক এই মেশিনে মাদক গ্রহণ থেকে ১২০ দিনের মধ্যে পরীক্ষা করলে ধরা পড়বে।
ওয়েসিস মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে মেডিক্যাল উইংয়ে আছে আরএমও, মেডিক্যাল অফিসার, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, সাইকিয়াট্রিক কনসালটেন্ট, এডিকশন কাউন্সেলর (ইকো ট্রেনিং প্রাপ্ত), ফ্যামিলি কাউন্সেলর, ফার্মাসিস্ট ও টেকনোলজিস্ট। এখানে রয়েছে ব্যায়াম করার অত্যাধুনিক সব যন্ত্রপাতি। ভবনের উপরে ছাদে একাংশে ফুলের বাগান, অন্যপাশে ব্যায়ামাগার। ওয়েসিস মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে যেসব ব্যবস্থা থাকবে তার মধ্যে অন্যতম হলো কাউন্সেলিং। কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে মাদকে আসক্ত ব্যক্তির আচার-আচরণে পরিবর্তন ঘটিয়ে তাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা হবে।
চীন, ইংল্যান্ড, আমেরিকা, কানাডাসহ বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে মাদক নিরাময়ে আকুপাংচার চিকিত্সা বেশ জনপ্রিয় ও কার্যকরী। এখানে সেই ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। অপরদিকে মেডিটেশন হলো সচেতনভাবে দেহ, মন এবং মস্তিস্কে শিথিল করার আধুনিক বৈজ্ঞানিক এবং সহজ প্রক্রিয়া। মেডিটেশনের মাধ্যমে মনের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে মাদকে আসক্তি ছাড়ানো হবে। ওয়েসিস মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্রটি যে সাত তলা ভবনে অবস্থিত সেটির মালিক আদ-দ্বীন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। তাদের কাছ থেকে ভবনটি ভাড়া নিয়ে মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্রটি করেছে পুলিশ।
আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ বলেন, মাদকাসক্তদের চিকিত্সা সেবা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যেই ওয়েসিস মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সুন্দর ও নান্দনিক পরিবেশে মাদকাসক্তদের চিকিত্সা সেবা দিতে ৬০ বেডের হাসপাতালে আগামী পহেলা অক্টোবর থেকে রোগী ভর্তি শুরু হবে। এছাড়া মানিকগঞ্জে নদীর পাশে ১০ বিঘা জমিতে মাদকাসক্তদের জন্য ৩০০ থেকে ৪০০ বেডের বিশ্বমানের অত্যাধুনিক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হবে। মাদকাসক্তদের চিকিত্সার জন্য আর বিদেশে যেতে হবে না।
প্রখ্যাত নিউরোলজিস্ট, নিউরো সায়েন্সেস ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. দীন মোহাম্মদ বলেন, যারা মাদকাসক্ত তাদের শরীরে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। কমে যায় স্মরণশক্তি, স্নায়ু দুর্বল হয়ে পড়ে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। কোভিডের মতো সংক্রামক ব্যাধি হতে পারে খুব সহজে।
প্রখ্যাত মনরোগ বিশেষজ্ঞ ও জাতীয় মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল বলেন, মাদকাসক্তদের চিকিত্সা ও পুনর্বাসনের জন্য পুলিশ যে উদ্যোগ নিয়েছে তা সত্যিই ভালো উদ্যোগ। আমরা এই উদ্যোগকে স্যালুট জানই। ওয়েসিস মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে যে ডোপ টেস্ট মেশিন আনা হয়েছে সেটি অত্যাধুনিক। তিনি বলেন, মাদকাসক্তের কারণে সমাজে অপরাধ বাড়ছে, নারী নির্যাতন বেড়েছে। এখন থেকে বিয়ের আগে অবশ্যই ডোপ টেস্ট করা উচিত। তিনি বলেন, পুলিশে ডোপ টেস্ট করা শুরু হয়েছে। এটা ভালো উদ্যোগ। কিন্তু শুধু পুলিশে কেন? সব প্রতিষ্ঠানেই এটি থাকা উচিত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জিয়া রহমান বলেন, মাদকাসক্ত একটি মানসিক রোগ। মাদকে আসক্তরা এক পর্যায়ে চুরি-ডাকাতি করে। এক সময় পেশাদার খুনি হয়ে যায়। স্বাভাবিক আচরণ করেনা। এ কারণে সমাজে খুন-ধর্ষণসহ নানা ধরনের অপরাধ বাড়ছে। যৌন বিকৃতির ঘটনা ঘটছে। এটা রুখতে হলে আগে মাদকের ডিলারদের রুখতে হবে। একই সঙ্গে মাদসকাক্তদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিতে হবে। এক্ষেত্রে পুলিশ যে উদ্যোগ নিয়েছে তাকে সাধুবাদ জানাই।