বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : প্রশাসনের জনবল কাঠামোর পদবিন্যাস পিরামিডের মতো হওয়ার কথা। কিন্তু দেশের প্রশাসনিক কাঠামোতে মেদভুঁড়ি তৈরি হয়েছে। পিরামিডের বদলে তা হয়েছে মটকার মতো। ওপরের পদে প্রয়োজনের চেয়ে লোক বেশি, নিচের পদে কম। পদোন্নতি পেলেও কাজ না থাকায় নিচের পদে বসে কাজ করছেন ওপরের পদের কর্মকর্তারা। ফলে আমলাতন্ত্রের কর্মক্ষেত্রে তৈরি হয়েছে বিশৃঙ্খলা।
বর্তমানে প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায় জ্যেষ্ঠ সচিব ও সচিব পদে রয়েছেন ৭৭ জন। এর পর গ্রেড-১ পদে ১৬ জন। তারপরই আকৃতিটা বেশ বড়। অতিরিক্ত সচিব পদে ৫০৪ জন। অথচ পদ ২১২টি। এরপর যুগ্ম সচিবের ৫০২টি পদে ৫৯৫ জন। উপসচিবের পদসংখ্যা ১৩২৪টি। সেখানে কর্মরত আছেন ৬৪৫ জন বেশি অর্থাৎ ১৯৬৯ জন। এর পরের পদে আবার সংখ্যাটা বেশ কম। সহকারী সচিব পদে কর্মরত আছেন মাত্র ১৬০৬ জন এবং জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব পদে এক হাজার ৫১৮ জন।
জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন সমকালকে বলেন, প্রশাসনের পিরামিড ঠিক রাখতে আমাদের পদোন্নতির বিষয়ে সংকোচন নীতি নিতে হচ্ছে। যেখানে জনবল কাঠামোর আকৃতি পিরামিডের মতো হওয়ার কথা, সেখানে মটকার মতো পেট মোটা হয়ে গেছে।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, কর্মীর চেয়ে নেতা বেশি হয়ে গেলে কাজে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। তাই গত বছর থেকে পদোন্নতির সংখ্যা কমানো হচ্ছে। হয়তো আরও কিছু সময় লাগবে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০০৮ সাল পর্যন্ত মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোতে অতিরিক্ত সচিবের পদ ছিল প্রায় ৫০টি। এখন একেকটি মন্ত্রণালয় বা বিভাগে কাজ করছেন ৮ থেকে ৯ জন অতিরিক্ত সচিব। যেমন- জনপ্রশাসনে কাজ করছেন ৯ জন, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে কাজ করছেন ১২ জন।
সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অনুবিভাগের প্রধান হলেন যুগ্ম সচিব পদের কর্মকর্তা; অধিশাখার প্রধান উপসচিব এবং শাখার প্রধান হিসেবে থাকার কথা সিনিয়র সহকারী সচিব বা সহকারী সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা। কিন্তু পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়ায় বর্তমানে প্রত্যেক মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সব অনুবিভাগে (যুগ্ম সচিবের পদে) কাজ করছেন অতিরিক্ত সচিব পদের কর্মকর্তারা। স্থানীয় সরকার বিভাগ, খাদ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয়সহ অনেক মন্ত্রণালয়ের বিভাগের অধিশাখায়ও (উপসচিবের পদে) কাজ করছেন অতিরিক্ত সচিবরা। আর অধিকাংশ যুগ্ম সচিব কাজ করছেন অধিশাখায় (উপসচিবের পদে)। অনেক যুগ্ম সচিব শাখাতেও (সিনিয়র সহকারী বা সহকারী সচিবের পদে) কাজ করছেন। একইভাবে বেশিরভাগ উপসচিব কাজ করছেন সিনিয়র সহকারী বা সহকারী সচিবের পদে। সচিবালয়ে অনেক কর্মকর্তার বসার জায়গাও নেই।
এমন পরিস্থিতিতে দীর্ঘ ৩৮ বছর পর সরকারি দপ্তরের জনবল কাঠামো হালনাগাদের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। প্রথমে শুধু মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর জনবল কাঠামো হালনাগাদ করা হবে। এরপর পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের অধীন দপ্তর,
অধিদপ্তর ও সংস্থা এবং সাংবিধানিক, স্বায়ত্তশাসিত বা আধা-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের জনবল কাঠামো হালনাগাদ করা হবে। আগামী ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে এ সংক্রান্ত প্রস্তাব পাঠাতে বলা হয়েছে। পদ ছাড়া আর পদোন্নতি না দেওয়ারও সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে সরকার। সংশ্নিষ্টরা জানান, এরই মধ্যে অতিরিক্ত সচিব পদে কম পদোন্নতি দিতে শুরু করেছে। বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের অষ্টম থেকে ১১তম ব্যাচ পর্যন্ত অতিরিক্ত সচিব পদে একেবারে সর্বনিম্ন পদোন্নতির সংখ্যা ১৩৪ জন থাকলেও গত বছর দেওয়া হয় ৯৮ জন। এরপর গত মঙ্গলবার ৯২ জনকে পদোন্নতি দেওয়া হয়।
বিশেষজ্ঞ ও সাবেক আমলারা বলেছেন, একটি আদর্শ কার্যকরী আমলাতন্ত্রের কাঠামো পিরামিডের মতো হওয়া উচিত, যেখানে নিচের দিকে বেশি সংখ্যক জনবল ও ওপরের দিকে কম জনবল থাকবে। ফলে দেশের আমলাতন্ত্রের বর্তমান কাঠামো ঠিক নেই। তাদের মতে, এতে কর্মক্ষমতার পাশাপাশি বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তার মধ্যে সম্প্রীতি নষ্ট হয়। ২০০৬ সালের আগে ভবিষ্যতের শূন্য পদ বিবেচনা করে পদোন্নতি দেওয়া হতো। সংখ্যাটি খুবই কম ছিল। ২০০৬ সালের পর থেকে এর সংখ্যা বাড়তে থাকায় প্রশাসন এখন পেটমোটা প্রশাসনে পরিণত হয়েছে।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার সমকালকে বলেন, একটি আদর্শ কার্যকরী আমলাতন্ত্রের কাঠামো পিরামিডের মতো হওয়া উচিত। কিন্তু প্রশাসনের পিরামিড ঠিক করার উদ্যোগের সঙ্গে সরকারের কার্যক্রমের কোনো মিল দেখছি না। কারণ, অতিরিক্ত সচিব পদে পদের চেয়ে প্রায় তিনশ বেশি কর্মকর্তা রয়েছেন। এর মধ্যে মঙ্গলবার আবার প্রায় একশ কর্মকর্তাকে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী পদোন্নতি-সংক্রান্ত (এসএসবি) কমিটির কেউ নন। এসএসবির (সুপিরিয়র সিলেশন বোর্ড) চেয়ারম্যান হলেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব, আর সদস্য হলেন গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের সচিবরা। পদোন্নতির জন্য তারা যে সুপারিশ করে, সেটাই দেখে অনুমোদন করেন প্রধানমন্ত্রী।
বাদ পড়েছেন অনেকে :বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য ও যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর কবীর বিসিএস দশম ব্যাচের মেধা তালিকায় আছেন ১০ জনের মধ্যে। এই কর্মকর্তা পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে। ২০১৪ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার ডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। উপসচিব ও যুগ্ম সচিব পদে নিয়মিত পদোন্নতি পেয়েছেন জাহাঙ্গীর কবীর। অতিরিক্ত সচিব পদে চারবার বঞ্চিত হওয়ার পর এবারও তিনি পদোন্নতি পাননি।
একইভাবে ১১তম ব্যাচের কর্মকর্তা মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের যুগ্ম সচিব মুকেশ চন্দ্র বিশ্বাসের বাড়ি গোপালগঞ্জ জেলার সদরে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাকাউন্টিং বিভাগে পড়াশোনা করেছেন। ২০১২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত চার বছর ঠাকুরগাঁও জেলার জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। মেধা তালিকায়ও তিনি প্রথম দিকে রয়েছেন। এর পরও অতিরিক্ত সচিব পদে তৃতীয়বার বঞ্চিত হলেন।
১১তম ব্যাচের কর্মকর্তা যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব বদরে মুনির ফেরদৌস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে মাস্টার্স করেছেন। তিনি নোয়াখালীতে ২০১৪ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ডিসির দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনিও অতিরিক্ত সচিব পদোন্নতিতে তিনবার বঞ্চিত হলেন। নির্বাচন কমিশনের যুগ্ম সচিব কামাল উদ্দীন বিশ্বাস জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন। তিনি মাদারীপুর জেলার জেলা প্রশাসক ছিলেন। তিনি দুইবার বঞ্চিত হলেন। পদোন্নতি তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, নবম, দশম ও ১১তম ব্যাচের শতাধিক ‘যোগ্য’ কর্মকর্তার মধ্যে মাত্র ১৫ জন পদোন্নতি পেয়েছেন। সব মিলে ৩৭২ জন যোগ্য কর্মকর্তার মধ্যে এবার মাত্র ৯২ জন পদোন্নতি পেয়েছেন।
বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য ও যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর কবীর সমকালকে বলেন, কর্মজীবনে তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। সুনামের সঙ্গে দিনরাত সরকারের দায়িত্ব পালন করেছেন। এর পরও চাকরিজীবনের শেষে বারবার বঞ্চিত হওয়ায় তার বৃদ্ধ মা বাসায় বসে কান্না করছেন।
একাধিক বঞ্চিত কর্মকর্তা বলেন, কেন তারা বঞ্চিত হলেন তার কারণ কেউ বলছে না। বরং এসএসবির (সুপিরিয়র সিলেশন বোর্ড) একাধিক কর্মকর্তা তাদের বলেছেন, তাদের তারা ভালো কর্মকর্তা হিসেবে চেনেন। অনেকের পরিবার সম্পর্কেও তারা অবগত। এর পরও তাদের পদোন্নতি না হওয়ায় তারা হতাশা ও কষ্টে দিন পার করছেন। নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে পদোন্নতিবঞ্চিত কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, পদ শূন্য না থাকলে কেউ পদোন্নতি পাবেন না। কিন্তু পদ না থাকার পরও কেউ পদোন্নতি পেলেন, আর কেউ পেলেন না- এটি অন্যায্য।