বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : কক্সবাজার জেলার মহেশখালী ঘিরে এগিয়ে চলছে দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের ‘মেগা হাব’ তৈরির বিশাল কর্মযজ্ঞ। স্বপ্নের এ হাব নির্মাণের জন্য ইতোমধ্যে এখানে গড়ে তোলা হয়েছে পরিকল্পিত একটি দ্বীপ। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৪ মিটার উচ্চতার এ দ্বীপটির আয়তন ১৬০৪ একর। পরিকল্পিত এ হাবের মধ্যে থাকবে ১৪ কিলোমিটার সমুদ্র চ্যানেল ও দুটি জেটিসহ সমুদ্রবন্দর, বিদ্যুৎ কেন্দ্র, তেল সংরক্ষণাগার ও বিদেশ থেকে আমদানি করা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের টার্মিনাল, সোলার পাওয়ার প্ল্যান্টসহ ৩৭টি প্রকল্প। এছাড়া এ প্রকল্প ঘিরে মাতারবাড়ীতে হতে যাচ্ছে দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর। হাবটি ঘিরে সড়ক ও রেলপথ তৈরিরও পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। বঙ্গোপসাগরের উপকূলে চারটি দ্বীপ নিয়ে গঠিত এ উপজেলার দুটি দ্বীপ মাতারবাড়ি ও ধলঘাটার বেশিরভাগ জায়গা নিয়ে এ প্রকল্পের অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে।
সরেজমিন ঘুরে এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে দেখা গেছে, সাগরের কোল ঘেঁষে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মূল অবকাঠামো। মূলত মাতারবাড়ী কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি ও সমুদ্রবন্দরকে ঘিরেই সরকারের মাথায় আসে এ বিশাল হাব তৈরির পরিকল্পনা। এখানে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কয়লা আনতে সমুদ্র খনন করে তৈরি করা হযেছে প্রশস্ত ও গভীর সামুদ্রিক চ্যানেল। নীতিনির্ধারক ও সংশ্লিষ্ট সেক্টরের বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, মহেশখালীতে পরিকল্পনাধীন সব প্রকল্পের কাজ শেষ হলে বদলে যাবে এই অঞ্চলসহ পুরো দেশের চেহারা। যা দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে।
জানা গেছে, শুরুতে এখানে ৩২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ১২০০ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও ১৪ কিলোমিটার চ্যানেলসহ সমুদ্রবন্দর নির্মাণের জন্য প্রকল্প অনুমোদন দেয় সরকার। কিন্তু দ্বীপটিতে মাটি ভরাট এবং ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ চ্যানেল তৈরির পর পাল্টে যায় পুরো চিত্র। এরপর একের পর এক প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়। ধারণা করা হচ্ছে, দ্বীপটি ঘিরে আরও কয়েক হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হবে। মোট ৫ হাজার বিঘা জমিতে প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ৪ বছর আগে। বিদ্যুৎ বিভাগের সঙ্গে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে জাপান। পরিকল্পনা আছে প্রথম ধাপে ৬০০ ইউনিটের দুটি ইউনিট চালুর। পরে একই ক্ষমতার আরও ২টি ইউনিট চালু করা হবে।
জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ‘এ দ্বীপটিকে ঘিরে বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তার বড় বলয় গড়ে তোলা হচ্ছে। সেখানে এলএনজি, এলপিজি ও কয়লা আসবে। এ জ্বালানির ওপর ভর করেই বাংলাদেশ একটি উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশে পরিণত হবে। গোটা মাতারবাড়ী বাংলাদেশের অর্থনীতির ইতিবাচক পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে চলেছে।’
সোমবার কক্সবাজার থেকে স্পিডবোটে প্রকল্প এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে সর্বত্র চলছে হাজার হাজার মানুষের বিশাল কর্মযজ্ঞ। শুধু কোল পাওয়ার কোম্পানি আর জেটির চ্যানেল নির্মাণে কাজ করছেন দেশি-বিদেশি ৭ হাজার লোক। এর মধ্যে ৫৯০ জন বিদেশি এবং ২ হাজারের মতো স্থানীয় বাসিন্দা রয়েছেন। চট্টগ্রাম থেকে ৬৭ কিলোমিটার, চকোরিয়া থেকে ২০, কক্সবাজার শহর থেকে ৩৩ এবং সোনাদিয়া দ্বীপ থেকে ২৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত প্রকল্পটির অবস্থান। দ্বীপটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এতই উঁচু করা হয়েছে ৬-৭ মিটার উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হলেও এখানে পানি উঠবে না। যদিও গত ১০০ বছরের ডাটাতে দেখা গেছে এ এলাকায় ৬-৭ মিটারের বেশি জ্বলোচ্ছ্বাস হয়নি।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দরের ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার লম্বা, ২৫০ মিটার প্রস্থ চ্যানেল তৈরির ৯০ শতাংশ কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। বর্তমানে চ্যানেলটির গভীরতা রয়েছে ১৬ মিটার। এটি আরও আড়াই মিটার বাড়িয়ে সাড়ে ১৮ মিটারে উন্নীত করা হবে। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এ মুহূর্তে এই চ্যানেল দিয়ে ১৫ মিটার গভীরতার জাহাজ ভেড়ানো সম্ভব হবে। বিদ্যুৎ প্রকল্পের যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম খালাসের জন্য আগেভাগে চ্যানেল তৈরির কাজ শেষ করা হচ্ছে বলে জানান কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মনোয়ার হোসেন মজুমদার। তিনি বলেন, বর্তমানে চ্যানেলের প্রশস্ততা আছে দেড়শ মিটার। আর মূল সমুদ্রবন্দর নির্মাণ শেষ হলে তখন চ্যানেলের প্রশস্ততা হবে আড়াইশ মিটার। তিনি বলেন, প্রকল্পের পাশাপাশি এ বন্দর দিয়ে গোটা দেশের পণ্য আমদানি-রপ্তানি করা যাবে। সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২৬ সালে এ বন্দরটি চালুর পরিকল্পনা রয়েছে। বন্দরের সঙ্গেই গড়ে তোলা হবে কইটেইনার রাখার অবকাঠামো। ইনল্যান্ড কইটেইনার ডিপো (আইসিডি) গড়ে তোলা হবে বন্দরের পাশে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, গভীর সমুদ্রবন্দরের পণ্য আনা-নেওয়ার জন্য রেল ও সড়কপথ নির্মাণের পরিকল্পনা করেছে সরকার। গভীর সমুদ্রবন্দরে ৩০০ ও ৪৬০ মিটার দীর্ঘ দুটি টার্মিনাল নির্মাণ করা হবে। এতে বিশাল জাহাজ থেকে সরাসরি পণ্য ওঠানামা সহজ হবে। প্রথম ধাপের কাজ শেষ হতে সময় লাগবে ২০২৬ সাল। দ্বিতীয় ধাপে নির্মিত হবে তিনটি কনটেইনার টার্মিনাল। এভাবে পর্যায়ক্রমে বাড়ানো হবে টার্মিনাল। গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে খরচ পড়বে ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা। এই প্রকল্পে ১২ হাজার ৮৯২ কোটি ৭৬ লাখ টাকা ঋণ দিচ্ছে জাপান। বাকি অর্থের মধ্যে সরকার দিচ্ছে ২ হাজার ৬৭১ কোটি ১৫ লাখ টাকা, পাশাপাশি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ দিচ্ছে ২ হাজার ২১৩ কোটি ২৪ লাখ টাকা। বন্দরটির দায়িত্ব থাকবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।
নির্মাণকাজ শেষ হলে দেশের একমাত্র এ গভীর সমুদ্রবন্দরে ১৪-১৫ হাজার একক কনটেইনারবাহী জাহাজ ভেড়ানো যাবে। সেখানে চট্টগ্রাম বন্দরে বর্তমানে গড়ে প্রতিটি জাহাজে পণ্যবাহী ১ হাজার ৮৭৮টি কনটেইনার আনা-নেওয়া হয়।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) মাতারবাড়ীর এই হাবে একটি এলপিজি টার্মিনাল নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ ব্যাপারে অনেকদূর এগিয়ে গেছে জ্বালানি বিভাগ। বিপিসি সূত্রে জানা গেছে, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের সঙ্গেই ডেডিকেডেট এলপিজি টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, এলপিজির বড় সমস্যা হলো পরিবহণ ব্যয়। পরিবহণ ব্যয়ের কারণে গ্রাহকদের বেশি দাম দিয়ে এ গ্যাস কিনতে হয়। টার্মিনাল নির্মাণ হলে পরিবহণ ব্যয় কমে যাবে। এছাড়া এতে সরকারের একটা নিয়ন্ত্রণ থাকবে। ফলে ভোক্তা কম দামে এলপি গ্যাস কিনতে পারবেন। এছাড়া প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ধলঘাটের স্থলভাগে দুটি এলএনজি টার্মিনাল হবে। পাশাপাশি আরও একটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল করবে সরকার। তিনটি টার্মিনালের সম্মিলিত ক্ষমতা হবে দৈনিক ৩৫০ কোটি ঘনফুট। দেশে গ্যাসের চাহিদার বড় অংশই এখানকার এলএনজি দিয়ে পূরণ হবে। স্থলভাগের একটি টার্মিনাল নির্মাণে ইতোমধ্যে দরপত্রও আহ্বান করা হয়েছে। এর জন্য জমি অধিগ্রহণের কাজ চলছে।
জাপানি সাহায্য সংস্থা জাইকার অর্থায়নে ইতোমধ্যে এখানে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের চুক্তি করেছে সরকার। এ বন্দরটিতে শুধু কয়লা ও তেল খালাসের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। বন্দরটিতে ১৮ মিটার গভীরতা থাকায় বড় জাহাজ এসে সোজা জেটিতে পণ্য খালাস করতে পারবে। প্রকল্পটির বাস্তবায়নকাজ ২০২৩ সালে শেষ হওয়ার কথা। ইতোমধ্যে বন্দর নির্মাণের কাজ অনেক দূর এগিয়েছে। সরেজমিন দেখা গেছে, বন্দরের জন্য আলাদা চ্যানেল তৈরি করা হয়েছে। আর চ্যানেলের ডান পাশে ১০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে কংক্রিটের একটি বাঁধ দেওয়া হয়েছে। এতে চ্যানেলে পলি জমতে পারবে না।
এ হাবটি ঘিরে সরকার মহেশখালীর কালামারছড়াতে তেল মজুদের বিশাল অবকাঠামো গড়ে তুলছে। এ প্রকল্পের নাম দেওয়া হয়েছে সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিংয়ের (এসপিএম)। সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, প্রকল্পটির অবকাঠামো হিসাবে গভীর সমুদ্রে স্থাপন করা হচ্ছে বিশেষ এক ধরনের বয়া, যার ভেতর থাকবে পাইপলাইন। এ পাইপলাইনের মাধ্যমে সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে স্থলভাগের তেল সংরক্ষণাগারে আসবে তেল। এই প্রকল্পের পিডি প্রকৌশলী মো. শারীফ হাসনাত যুগান্তরকে বলেন, এসপিএমের মাধ্যমে তেল খালাস করতে ২২০ কিলোমিটার পাইপলাইন স্থাপন করতে হবে। এর মধ্যে সমুদ্রের তলদেশে ১৩৫ কিলোমিটার পাইপলাইন স্থাপনের কাজ শেষ হয়েছে। দুটো পাইপলাইন থাকছে, একটি দিয়ে অপরিশোধিত তেল অন্যটি দিয়ে পরিশোধিত তেল পরিবহণ করা হবে। এতে করে বছরে কমপক্ষে ৮০০ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে বলে মনে করছে সরকারের জ্বালানি বিভাগ। এ অঞ্চলে থাকছে তিনটি অর্থনৈতিক জোন (ইজেড)। এ তিনটি ইজেড করা হবে মহেশখালীতে। এ ছাড়া বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় এখানে গড়ে উঠবে খাদ্যগুদাম। গোটা অঞ্চলের জন্য একটি ইকোপাকের্রও পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। সোনাদিয়া দ্বীপে ইকোপার্কটি নির্মাণ করা হবে। এটি ৯ হাজার ৪৬৬ একর জায়গায় গড়ে উঠবে।
যোগাযোগ অবকাঠামো : বন্দরের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ করতে বেশ কিছু পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। এর মধ্যে রয়েছে সেতু নির্মাণ। ধলঘাটের বন্দর এলাকায় সড়কপথে যেতে হলে বেশ কিছু নদী পার হতে হয়। কক্সবাজার থেকে ধলঘাট পর্যন্ত উন্নত সড়ক ও সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। ২৭ কিলোমিটার সড়ক ও ১৭টি সেতু নির্মাণের কথা ভাবছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। ২০২৪ সালের মধ্যে এসব অবকাঠামো গড়ে তুলতে চায় প্রতিষ্ঠানটি। এ ছাড়া বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ঢাকা-কক্সবাজার রেলপথকে ধলঘাটায় বন্দরের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত করবে। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণের কাজ অনেক দূর এগিয়ে গেছে। এর আগে সরকার চট্টগ্রাম থেকে বান্দরবানের ঘুমধুম পর্যন্ত রেলপথ স্থাপনের কাজ শুরু করেছে। বন্দরের মালামাল আনা-নেওয়ার কাজে ব্যবহার এর মূল লক্ষ্য।
বিদ্যুৎ কেন্দ্র : মাতারবাড়ী ইউনিয়নের ধলঘাটে প্রতিটি ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াটের দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। সরেজমিন দেখা গেছে প্রথম কেন্দ্রের ৬০০ মেগাওয়াটের একটি ইউনিটের নির্মাণকাজ অর্ধেকের বেশি (৫৭.৩৮ শতাংশ) এগিয়েছে। প্রকল্প এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত ৯৫.৮২ শতাংশ মানুষকে ইতোমধ্যে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। এ প্রকল্পের জন্য কয়লা আনা হবে ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে। বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে আসার পর থেকে ২ বছর জাপানিরা এখানে থেকে কেন্দ্র পরিচালনা করবে। দুটি ইউনিটের কাজ সম্পন্ন হবে যথাক্রমে ২০২৪ সালের জানুয়ারি ও জুলাইয়ে।