বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : সময় পাল্টে গেছে। এক সময় বিশ্বব্যাংকের অর্থ সহায়তার ওপর নির্ভরশীল ছিল বাংলাদেশ। এখন তাদের ঋণ এবং শর্ত পূরণের জন্য বাংলাদেশ বসে থাকতে চায় না। আলোচনার টেবিলে বিশ্বব্যাংকই নরম সুরে কথা বলে। কয়েকটি প্রকল্পে দীর্ঘসূত্রতার কারণে আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নিকারী এই প্রতিষ্ঠানটিকে বাদ দিয়ে বিকল্প অর্থায়নের কথা ভাবছে সরকার। মন্ত্রীরা বলছেন, বাংলাদেশ এখন আর বিশ্বব্যাংকের মুখাপেক্ষী নয়। নিজস্ব অর্থায়নেই বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে।
সড়ক নিরাপত্তা প্রকল্প এবং চট্টগ্রামে বে টার্মিনালের একটি অংশে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন করতে চায়। তবে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তারা দীর্ঘসূত্রতা করলে বিকল্প উৎসের অর্থায়নে প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে।
এ বিষয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সময়ের আলোকে বলেন, বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু থেকে সরে যাওয়ার পর বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পরে বিশ্বব্যাংক নিজেরাই ভুল স্বীকার করে। তারা সড়ক নিরাপত্তায় অর্থায়ন করবে বলে বারবার আগ্রহ প্রকাশ করে। আমরা এক পর্যায়ে তাদের স্বাগত জানাই। কিন্তু আবারও তারা সময়ক্ষেপণ করছে। তাদের কথার সঙ্গে কাজের মিল নেই। যদি তারা বিলম্ব করে, কালক্ষেপণ করে, তা হলে আমাদের নিজস্ব অর্থায়নে সড়ক নিরাপত্তা প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্দেশনাও দিয়েছেন বলে জানান তিনি।
চট্টগ্রামে নির্মিতব্য বে টার্মিনাল প্রকল্পের ব্রেক ওয়াটার কাজেও বিশ্বব্যাংক দীর্ঘসূত্রতা করলে সরকার বিকল্প অর্থায়নের পথে যাবে। প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে উচ্চ পর্যায়ের এক বৈঠকে এমন সিদ্ধান্ত হয়।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান সময়ের আলোকে বলেন, বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বিভিন্ন পয়েন্টে আলাপ-আলোচনা চলছে। যদি বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন করতে বিলম্ব করে তা হলে আমরা বিকল্প অর্থায়নের পথে যাব। মন্ত্রণালয়, ইআরডি মিলে সিদ্ধান্ত নেবে। গত আগস্টে এক আলোচনা সভায় নৌ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশকে ঋণ দেওয়ার জন্য বিশ্বব্যাংক আমাদের পেছনে ঘোরে। বাংলাদেশ আজ বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের দিকে অর্থঋণের জন্য তাকিয়ে থাকে না। বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নে বড় বড় মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন অনেক শক্তিশালী।
তবে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে মতপার্থক্য কমিয়ে আনার বিষয়ে মত দিয়েছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম হোসেন। সময়ের আলোকে তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে উভয়পক্ষের পার্থক্য কমিয়ে আনার সুযোগ আছে এবং এর যৌক্তিকতাও রয়েছে। বিকল্প অর্থায়ন সমস্যার সমাধান নয়। বিশ্বব্যাংকের ঋণে তুলনামূলক কম ব্যয় হয়। অর্থায়নের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক যেসব পরিবেশগত এবং কারিগরি দিক বিবেচনা করে বিকল্প অর্থায়নেও সেগুলো বিবেচনায় আসবে।
সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী, চট্টগ্রামে বে টার্মিনালে তিনটি টার্মিনাল হবে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজস্ব অর্থায়নে চারটি জেটি সংবলিত একটি টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনা করবে। অন্য দুটি বিল্ড-অপারেট অ্যান্ড ট্রান্সফার (বিওটি) ভিত্তিতে নির্মিত হবে। টার্মিনাল দুটি নির্মাণ ও পরিচালনার দায়িত্ব পেতে পারে সিঙ্গাপুর ও সংযুক্ত আরব আমিরাত।
বে টার্মিনাল প্রকল্পের অংশ হিসেবে ১১ কিমি প্রাকৃতিক আইল্যান্ডে ব্রেক ওয়াটার নির্মাণ করবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। চলতি বছরের ১৫ এপ্রিল বিশ্বব্যাংক বে টার্মিনাল প্রকল্পের ব্রেক ওয়াটার (সমুদ্র উপকূলে নির্মিত দেয়াল) ও নেভিগেশনাল অ্যাকসেস চ্যানেলে অর্থায়নে সম্মতিপত্র পাঠায় ইআরডিতে (অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ)। কিন্তু দীর্ঘ চিঠি চালাচালির পর, বিশ্বব্যাংক তাদের অর্থায়নে যেসব শর্তারোপ করেছে তাতে প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা হবে বলে মনে করছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক)। তাই গত ৩ আগস্ট চট্টগ্রাম বন্দরের বিশেষ বোর্ড সভায় সিদ্ধান্ত হয়, চবকের প্রস্তাব অনুযায়ী বিশ্বব্যাংক অর্থায়নে সম্মত না হলে বিকল্প অর্থায়নের উৎস বিবেচনা করতে হবে। মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুপারিশ করে বন্দর কর্তৃপক্ষ।
এর আগে চলতি বছরের গত ৭ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে উচ্চ পর্যায়ের এক বৈঠকেও সিদ্ধান্ত হয় ঋণপ্রাপ্তি ও প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব হলে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বাদ দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজস্ব অর্থায়নে তা বাস্তবায়ন করবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বে টার্মিনালের ব্রেক ওয়াটার কাজে অর্থায়নের শর্ত হিসেবে বিশ্বব্যাংক নতুন করে সম্ভাব্যতা যাচাই, পরিবেশগত ও সামাজিক প্রভাব সমীক্ষা (ইএসআইএ) করতে বলে; কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা হবে জানিয়ে বিশ্বব্যাংককে ২০১৭ সালের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের রিপোর্টটি গ্রহণ করতে বলা হয়। এ প্রস্তাবে বিশ্বব্যাংক সম্মত না হলে বিকল্প অর্থায়নের উৎস অর্থাৎ দক্ষিণ কোরিয়া সরকারের ইডিসিএফ (ইকোনোমিক ডেভেলপমেন্ট কোঅপারেশন ফান্ড) ঋণ সহায়তার বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। দক্ষিণ কোরিয়া সরকার এ প্রকল্পের জন্য ঋণ সহায়তা দিতে আগ্রহ দেখিয়েছিল। এ ঋণ পেতে বিলম্ব হলে বা পাওয়া না গেলে বন্দরের নিজস্ব অর্থায়নে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। ইতোমধ্যে বে টার্মিনাল নির্মাণে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে দেওয়া হয়েছে।
মন্ত্রণালয়ে পাঠানো সুপারিশে আরও বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাংকের ঋণ নিলে আরও কিছু সমস্যা হতে পারে মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। সেখানে বলা হয়েছে, বে টার্মিনাল প্রকল্পের ব্রেক ওয়াটার ও নেভিগেশনাল অ্যাক্সেস চ্যানেল নির্মাণে বিশ্বব্যাংক সম্পৃক্ত হলে ঋণের কমপ্লায়েন্স হিসেবে বর্ণিত পরামর্শ সেবাগুলো পুনঃপরিচালনা করতে হবে। এতে কালক্ষেপণ হবে, তাই ওই প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতার সৃষ্টি হতে পারে।
এ ছাড়া বিশ্বব্যাংকের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান আইএফসি সিঙ্গাপুরের বেসরকারি অপারেটর পিএসএ-কে বে টার্মিনালে অর্থায়ন করছে। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংক পিপিপি অথরিটির ট্রানজেকশন অ্যাডভাইজর হিসেবে এবং চট্টগ্রাম বন্দরের ব্রেক ওয়াটার ও নেভিগেশনাল অ্যাক্সেস চ্যানেল নির্মাণে সম্পৃক্ত হতে চাচ্ছে। এতে কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট হতে পারে মর্মে প্রতীয়মান এবং বে টার্মিনাল প্রকল্পটি বিশ্বব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে।
বিশ্বব্যাংকের শর্ত, চবকের জবাব : বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরের মেইল চালাচালিতে বিশ্বব্যাংক ও চবকের প্রস্তাব ও জবাবের বিষয়টি উঠে এসেছে। এতে দেখা যায়, বিশ্বব্যাংকের বিভিন্ন প্রস্তাবে শক্তিশালী মতামত দিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। মূলত সমীক্ষার প্রশ্নেই যত আপত্তি।
বিশ্বব্যাংক বলছে, তাদের নিয়মানুযায়ী, নতুনভাবে পরিবেশগত ও সামাজিক প্রভাব সমীক্ষা (ইএসআইএ) প্রণয়ন করতে হবে। চবকের মতামত হচ্ছে, ২০১৬ সালে পরিবেশ অধিদফতর বে টার্মিনালের পরিবেশ প্রভাব মূল্যায়ন অনুমোদন দেয় এবং সে অনুযায়ী ২০১৭ সালে চট্টগ্রাম বন্দর নিয়োজিত পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এ প্রকল্পের পরিবেশ ও সামাজিক প্রভাব মূল্যায়ন সম্পন্ন করেছে।
বিশ্বব্যাংক বলছে, প্রকল্পের স্থানে ৬৬টি বিপন্ন প্রজাতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এর জবাবে চবকের মতামত হচ্ছে, ২০১৭ সালে চট্টগ্রাম বন্দর নিয়োজিত পরামর্শক প্রতিষ্ঠান প্রকল্পের পরিবেশ প্রতিবেদনে এ ধরনের কোনো কথা উল্লেখ করেনি।
বিশ্বব্যাংক নতুন করে স্বনামধন্য একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করতে বলেছে। চবকের মতামত হচ্ছে আগে সম্পাদিত কার্যক্রম পুনরায় শুরু করতে হলে প্রকল্প বাস্তবায়ন কার্যক্রম উল্লেখযোগ্য সময় পিছিয়ে যাবে।
বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাব হচ্ছে, চবকের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও বিশ্বব্যাংক এবং পরামর্শকের সঙ্গে সমন্বয়ের জন্য বিভিন্ন পদে ছয়জন সামাজিক ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দিতে হবে এবং বন্দর কর্তৃপক্ষ তাদের সম্মানী দেবে। এর জবাবে বন্দর কর্তৃপক্ষের মতামত হচ্ছে, বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাব অনুযায়ী এ ধরনের ব্যক্তি পরামর্শকের জনমাস এবং বাজেট সংস্থান বিষয়ে আলোচনার প্রয়োজন। বিশ্বব্যাংক এ প্রকল্পে বন্দর কর্তৃপক্ষের বাইরে আরও একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করতে চায়। চবক বলছে, এ ধরনের আর কোনো পরামর্শকের প্রয়োজনীয়তা নেই।