বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : সাগরের কোল ঘেঁষে ক্রমেই মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছে মাতারবাড়ী ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার আলট্রা সুপার ক্রিটিকাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এ বিদ্যুৎ প্রকল্প ঘিরে কক্সবাজারের মাতারবাড়ী ও ধলঘাটা ইউনিয়নের ১ হাজার ৬০৫ একর জমির ওপর এখন চলছে বিশাল কর্মযজ্ঞ। সাড়ে ৭ হাজার কর্মীর দিন-রাত কাজে দ্রুত এগিয়ে চলছে এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণকাজ। প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে সম্প্রতি প্রকল্প এলাকা পরিদর্শনে গেলে জানান, ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে এর প্রথম ইউনিট উৎপাদনে যাবে। আর দ্বিতীয় ইউনিটটি একই বছরের জুলাই মাসে যাবে উৎপাদনে। এরই মধ্যে প্রকল্পের ৫৭.৩৮ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। কয়েক বছর আগেও এ দ্বীপ উপজেলার বাসিন্দারা যেখানে উন্নত জীবনের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না, সেই এলাকার লোকজনই এখন এ প্রকল্পের জন্য নির্মিত যোগাযোগব্যবস্থার সুফল পাচ্ছেন।
আবার স্থানীয় বাসিন্দাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হওয়ায় দ্রুত বদলে যাচ্ছে এ এলাকার মানুষের জীবনমান। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমানে প্রকল্প এলাকায় ২ হাজার ১০০ জন স্থানীয় লোক ব্যবসা-বাণিজ্যসহ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণশ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন। আর দেশি-বিদেশি মিলিয়ে এখানে কাজ করছেন সাড়ে ৭ হাজার কর্মী। প্রকল্প এলাকা সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, মহেশখালী উপজেলার দুই ইউনিয়ন মাতারবাড়ী ও ধলঘাটায় চলছে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ। দেশের বাইরে থেকে জাহাজে প্রকল্পের মালামাল নিয়ে আসার জন্য তৈরি করা হয়েছে একটি স্থায়ী জেটি। আরও একটি স্থায়ী জেটির কাজ চলমান আছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লা পোড়ানোর জন্য দুটি বয়লারের কাজও দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। এরই মধ্যে এক নম্বর বয়লারের পাইলিং কাজ শেষে বেজমেন্ট ঢালাই দেওয়া হয়েছে। দুই নম্বর বয়লারের পাইলিং কাজও শেষ। এর বেজমেন্ট ঢালাইয়ের কাজ প্রক্রিয়াধীন। কয়লা পোড়ানোর ধোঁয়া যেন পরিবেশের কম ক্ষতি করে এ জন্য তৈরি হচ্ছে ২৭৫ মিটার উঁচু চিমনি। বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লা পোড়ানোর ফলে যে ছাই তৈরি হবে তা মজুদের জন্য ২৫৫ হেক্টর জমিতে কূপ খনন করা হয়েছে। এই কূপে ২৫ বছর ধরে পোড়ানো কয়লার ছাই মজুদ করে রাখা যাবে।
এ ছাড়া কয়লা গুঁড়া করার কোলমিল, কনভেয়ার বেল্ট (বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কয়লা নিয়ে আসার বেল্ট), ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট, ওয়াটার প্লান্ট, কেমিক্যাল লুজিংসহ সব প্লান্টের পাইলিংয়ের কাজ শেষের পথে। জাহাজ থেকে পণ্য খালাস ও প্রকল্পের বিভিন্ন অংশে নিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে ৯৬ চাকার চালকবিহীন ট্রাক। বিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ, আড়াই শ মিটার প্রস্থ এবং ১৮ দশমিক ৫ মিটার গভীর সমুদ্রবন্দরের চ্যানেল তৈরি করা হয়েছে। প্রকল্পের সীমানাবাঁধ ঘেঁষে সমুদ্রের পাড়ে চ্যানেলের বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের পাশাপাশি এ দ্বীপেই নির্মিত হচ্ছে দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর। এতে মাতারবাড়ীর উন্নয়নের গতি আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। এত দিন যেখানে সাগরপথই যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল, এখন সেখানে অন্য এলাকার সঙ্গে সহজ যোগাযোগে তৈরি হচ্ছে চার লেনের রাস্তা। দুর্গম এ অঞ্চলে ৮০ হাজার লোকের বসবাস। লবণ ও মাছ চাষই এ এলাকার মানুষের আয়ের প্রধান উৎস। কিন্তু এ প্রকল্পের কারণে এরই মধ্যে ভিন্ন পেশায় কাজ শুরু করেছেন এখানকার মানুষ। কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেডের তথ্যমতে, এরই মধ্যে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণকালে মালামাল আনার জন্য একটি অস্থায়ী চ্যানেল খনন করা হয়েছে।
বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের সময় বিদ্যুৎ সরবরাহ ও স্থায়ী গ্রামীণ জনপদ বিদ্যুতায়নের লক্ষ্যে চকোরিয়া-মাতারবাড়ী ১৩২ কেভি সাব-স্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দরে ৩০০ ও ৪৬০ মিটার দৈর্ঘ্যরে দুটি টার্মিনাল থাকবে। এসব টার্মিনালে ১৬ মিটার ড্রাফটের ৮ হাজার টিইইউএস কনটেইনারবাহী জাহাজ ভিড়তে পারবে। চট্টগ্রাম বন্দরে ১৯০ মিটার দৈর্ঘ্যরে এবং ৯ দশমিক ৫ মিটার ড্রাফটের বেশি জাহাজ ভিড়তে পারে না। ফলে মাদার ভ্যাসেলগুলো এ বন্দরে আসতে পারে না। ফিডার জাহাজে করে কনটেইনার আনা-নেওয়া করতে হয়। সেখানে প্রতিদিন ৩৫০০-৩৮০০ টিইইউএস আমদানি পণ্য কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়ে থাকে। আর মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দরে ১৬ মিটার গভীরতার জন্য মাদার ভ্যাসেল ভেড়ার সুযোগ থাকায় একসঙ্গে ৮ হাজার কনটেইনারবাহী জাহাজ ভিড়তে পারবে। ফলে মাতারবাড়ীর এ বন্দর থেকে ফিডার ভ্যাসেলের মাধ্যমে দেশের অনান্য বন্দরে কনটেইনার পরিবহনের সুযোগ সৃষ্টি হবে। প্রকল্পের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. মনোয়ার হোসেন মজুমদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, করোনার কারণে এ প্রকল্পের কাজ এক দিনের জন্যও থামেনি। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতেই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট উৎপাদনে আসবে।
মাতারবাড়ীর এ প্রকল্পের ফলে স্থানীয় ২ হাজার মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়ন হয়েছে। এরই মধ্যে শেষ হয়েছে ৮৫ শতাংশ সঞ্চালন লাইন নির্মাণের কাজ। গভীর সমুদ্রবন্দর ও বিদ্যুৎ কেন্দ্র ছাড়াও এ প্রকল্প ঘিরে আরও ৩৭টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এ ছাড়া বিদ্যুৎ প্রকল্প এলাকায় কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ব্যবস্থা করা হচ্ছে টাউনশিপ ডেভেলপমেন্টের। আর স্থানীয় বাসিন্দা, যাদের জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল, তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ ছাড়া ভবিষ্যতে এখানে ৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণেরও পরিকল্পনা রয়েছে। তিনি বলেন, এ বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য যে কয়লা লাগবে তা আনার জন্য সার্ভে করা হয়েছে। প্রাথমিক সার্ভেতে ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, মোজাম্বিক ও দক্ষিণ আফ্রিকা- এ চার দেশের সম্ভ্যাবতা যাচাই চলছে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এ প্রকল্প ঘিরে মাতারবাড়ীতে যোগাযোগব্যবস্থার অভূতপূর্ব উন্নয়ন ঘটছে। এটি বাস্তবায়নের ফলে এ এলাকার মানুষের জীবনমান ও আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটবে।
বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি তৈরিতে মোট খরচ ধরা হয়েছে ৩৫ হাজার ৯৮৪ কোটি টাকা। আর মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়নের খরচ ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি ১৬ লাখ ১৩ হাজার টাকা। প্রসঙ্গত, জাপানের সুমিতোমো করপোরেশন, তোশিবা করপোরেশন ও আইএইচআই করপোরেশনের কনসোর্টিয়ামকে মাতারবাড়ী আলট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের ইপিসি ঠিকাদার হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে। তাদের অধীনে ১৫টির অধিক সাব-ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। মূলত মাতারবাড়ীর এ উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে জাপান সরকার। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) স্বল্প সুদে এ বিদ্যুৎ প্রকল্পে ২৮ হাজার ৯৩ কোটি ৩ লাখ টাকা এবং বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পে ১২ হাজার ৮৯২ কোটি ৭৬ লাখ ৫ হাজার টাকা ঋণ দিচ্ছে।