বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : বজ্রপাতে মৃত্যু ঠেকাতে তালগাছ লাগানোর পাশাপাশি এবার ‘লাইটার অ্যারেস্টার’ সংবলিত বজ্রপাত-নিরোধক কংক্রিটের ছাউনি (শেল্টার) নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। দেশের হাওরাঞ্চলসহ বজ্রপাতপ্রবণ ২৩ জেলায় এসব ছাউনি নির্মাণে ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্প নিতে যাচ্ছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। প্রাথমিকভাবে (পাইলট প্রকল্প) হাওর এলাকায় ১ কিলোমিটার পরপর ১ হাজার বজ্রপাত-নিরোধক কংক্রিটের ছাউনি নির্মাণ করা হবে। প্রতিটি ছাউনির সম্ভাব্য নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা। যুক্তরাষ্ট্র সফর শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে ফিরলে তার কাছে এ প্রকল্প প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে।
উল্লিখিত বিষয়ের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান। গতকাল সচিবালয়ের দফতরে তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, “দেশে প্রতি বছর গড়ে দুই শর বেশি মানুষ বজ্রপাতে মারা যাচ্ছেন। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মতামত নিতে একাধিক কর্মশালা করা হয়েছে। ওই সব কর্মশালার অংশীজনের মতামতের ভিত্তিতে ‘লাইটার অ্যারেস্টার’ সংবলিত বজ্রপাত-নিরোধক কংক্রিটের শেল্টার নির্মাণ করা হবে। এ জন্য ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প তৈরি করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র সফর শেষে প্রধানমন্ত্রী দেশে ফিরলেই প্রকল্পের অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে। পাইলট প্রকল্প হিসেবে হাওর এলাকায় এক হাজার শেল্টার নির্মাণ করা হবে। ১ কিলোমিটার অন্তর অন্তর নির্মাণ করা হবে একেকটি শেল্টার, যাতে মেঘের গুড়ুম গুড়ুম আওয়াজ পেলেই মাঠের কৃষকসহ মানুষজন শেল্টারে আশ্রয় নিতে পারেন। প্রতিটি শেল্টারে লাইটার অ্যারেস্টার বসানো হবে।
প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে বজ্রপাতে প্রাণহানির সংখ্যা কমে আসবে।” প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘বজ্রপাত ঠেকানো সম্ভব নয়। তবে এতে মৃত্যুর হার কমিয়ে আনতে আমরা তিনটি বিষয়কে অগ্রাধিকার দিচ্ছি। এর একটি হলো আরলি ওয়ার্নিং সিস্টেম। অর্থাৎ বজ্রপাতের ৪০ মিনিট আগেই সংকেত দেবে সেই যন্ত্র। দ্বিতীয়ত হলো, বজ্রপাত-নিরোধক কংক্রিটের শেল্টার নির্মাণ এবং তৃতীয়ত, জনসচেতনতা বাড়ানো।’ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গত ১০ বছরে বজ্রপাতে দেশে কমবেশি আড়াই হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। চলতি বছরের আট মাসে বজ্রপাতে মারা গেছে শতাধিক মানুষ। সর্বশেষ ৪ আগস্ট চাঁপাইনবাবগঞ্জে একটি বরযাত্রী দলের ওপর বজ্রপাত হলে ১৭ জনের প্রাণহানি ঘটে। এরা সবাই বৃষ্টির কারণে একটি ঘরে আশ্রয় নিয়েছিল। মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বজ্রপাতে ২০১১ সালে মারা গেছেন ১৭৯ জন, ২০১২ সালে ২০১ জন, ২০১৩ সালে ১৮৫ জন, ২০১৪ সালে ১৭০ জন, ২০১৫ সালে ১৬০ জন, ২০১৬ সালে ২০৫ জন, ২০১৭ সালে ৩০১ জন, ২০১৮ সালে ৩৫৯ জন, ২০১৯ সালে ১৯৮ জন, ২০২০ সালে ২১১ জন এবং ২০২১ সালের আগস্ট পর্যন্ত মারা গেছেন ১০৯ জন।
যদিও বেসরকারি হিসাবে এই সাড়ে আট মাসে মারা গেছেন দুই শর বেশি মানুষ। পরিসংখ্যান বলছে, বজ্রপাতে প্রতি বছর গড়ে দুই শতাধিক মানুষ মারা যান। এর মধ্যে ২০১৮ সালে সবচেয়ে বেশি ৩৫৯ জন মারা গেছেন। এর ৭৫ শতাংশই কৃষক। গবেষকরা বলছেন, নাসার তথ্য অনুযায়ী বজ্রপাতের অন্যতম হটস্পট বাংলাদেশ। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, হাওরাঞ্চলের পাশাপাশি যেসব এলাকায় সবচেয়ে বেশি মানুষ বজ্রপাতে মারা গেছেন, সেসব এলাকায় ছাউনি নির্মাণে প্রাধান্য দেওয়া হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, মার্চ-এপ্রিল-মে মাসে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয় হাওরাঞ্চল নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সিলেটে। মৌসুমে বজ্রপাত বেশি হয় সুনামগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইল, গোপালগঞ্জ, বরিশাল এবং উত্তরবঙ্গের রংপুর, পঞ্চগড় ও কুড়িগ্রামে। অক্টোবর-নভেম্বর মাসে পার্বত্য চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও কক্সবাজারে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয়।
সাতক্ষীরা, খুলনা, পটুয়াখালী এসব অঞ্চলে বেশি হয় শীতকালে। বজ্রপাত কিংবা বজ্রঝড়ের স্থায়িত্ব সর্বোচ্চ ৩০ মিনিট। তাই ছাউনি নির্মাণ করে মানুষের প্রাণহানি কমানো সম্ভব। অর্থাৎ কংক্রিটের ছাউনি তৈরি করা হবে। ঝড় শুরু হলে পশু নিয়ে কৃষকেরা সে ছাউনিতে আশ্রয় নেবেন। ঝড় থেমে গেলে মাঠে ফিরে যাবেন। এমন পরিকল্পনা থাকছে প্রকল্পে। ছাউনি নির্মাণের পাশাপাশি বজ্রপাতে প্রাণহানি ঠেকাতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করারও চিন্তা করা হচ্ছে। দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় অ্যারেস্টার বসানো হবে। এ যন্ত্র বজ্রপাত শোষণ করে নেবে। স্পেনের এ প্রযুক্তি বজ্রপাতের ৪০ মিনিট আগেই পূর্বাভাসও দিতে পারে। এটি স্থাপন করা গেলে এতে মৃত্যুর হার কমবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মাহবুবা নাসরীন বলেন, ‘বাংলাদেশসহ আমাদের উপমহাদেশে বজ্রপাতে মৃত্যুর হার দিন দিনই বাড়ছে। এ রকম একটি প্রকল্পের কথা আমিও শুনেছি। যেহেতু বজ্রপাতের সঠিক কারণ এখন পর্যন্ত নির্ণয় হয়নি তাই আমি মনে করি প্রথমে পাইলট প্রকল্প হিসাবে সফল হলে পূর্ণাঙ্গ প্রকল্প বাস্তবায়নে যাওয়া উচিত। আশা করি সরকারের উদ্দেশ্য সফল হবে।’