বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : পদ্মা সেতুর পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে আজ রোববার দুই হাজার ৯৬৫ পরিবার স্থায়ী ঠিকানার দলিল পাচ্ছে। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের প্রধান অতিথি থেকে এই দলিল হস্তান্তর করবেন। অনুষ্ঠানে মুন্সীগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য অধ্যাপক সাগুফতা ইয়সমিন এমিলি বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে। এছাড়া পদ্মা সেতু প্রকল্প পরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী ও কর্মকর্তারা এতে অংশগ্রহণ করবেন।
জানা গেছে, প্লট বরাদ্দ নিয়ে বাড়িঘর করে পরিবারগুলো বসবাস শুরু করলেও দলিল পায়নি। স্কুল, মসজিদ ও হাসপাতালসহ নানা সুবিধা সংবলিত প্লটের দলিল পেতে যাচ্ছে পুনর্বাসিত পরিবারগুলো। এই খবরে আনন্দে উদ্বেলিত তারা। এদিকে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মূল সেতুর নির্মাণ কাজের অগ্রগতি ৯৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ এবং পুরো প্রকল্পের ৮৮ শতাংশ সামগ্রিক অগ্রগতি।
প্রকল্প সূত্র জানায়, পদ্মা সেতু নির্মাণের ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার ৭৫৫টি। ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন, আয় ও জীবনযাত্রা পুনরুদ্ধারে পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় ‘ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর আয় ও জীবনযাত্রা পুনরুদ্ধারে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন এবং ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর জন্য গৃহীত পুনর্বাসন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন’ কার্যক্রমের পাশাপাশি শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রমও বাস্তবায়িত হচ্ছে। কার্যক্রমের মূল লক্ষ্য হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারসমূহের আর্থ-সামাজিক অবস্থা অধিগ্রহণের সময়ের তুলনায় ভালো অবস্থানে নিয়ে যাওয়া অথবা পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়া এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারসমূহের সদস্যদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ। প্রকল্পের সহযোগী এনজিও হিসেবে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন এবং আয় ও জীবনযাত্রা পুনরুদ্ধারে ইএসডিও বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে আসছে।
অন্যদিকে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য কার্যক্রম বাস্তবায়নে সহযোগী এনজিও হিসেবে সমাহার ও স্বাবলম্বী সমাজ উন্নয়ন সংস্থা যৌথভাবে কাজ করছে। এছাড়াও প্রকল্পের সরাসরি তত্ত্বাবধায়নে বনায়ন, জীববৈচিত্র সংরক্ষণ ও স্বেচ্ছায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো যেসব গ্রামে পুনর্বাসিত হয়েছে সেখানকার অবকাঠামোগত উন্নয়ন কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
প্রকল্পের পুনর্বাসন কার্যক্রমের অংশ হিসেবে বসতগৃহ হারানো পরিবারসমূহের জন্য ১৬৫ দশমিক ৬২ কোটি টাকা ব্যয়ে পদ্মা নদীর উভয় পাড়ের তিন জেলায় ৭টি পুনর্বাসন সাইট তৈরি করা হয়েছে। এসব পুনর্বাসন সাইটে ৩ হাজার ১১টি আবাসিক প্লট, ১০০টি বাণিজ্যিক প্লট ও ১২০টি উন্মুক্ত বাণিজ্যিক স্পেস রয়েছে। পুনর্বাসন সাইটসমূহে প্রাথমিক বিদ্যালয়, মসজিদ, বাজার, স্বাস্থ্য কেন্দ্র, বিদ্যুৎ, আর্সেনিকমুক্ত বিশুদ্ধ পানি, ওভারহেড ট্যাঙ্ক, ডাস্টবিন, পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা, মিশ্র ফলদ ও বনজ বাগান, খেলার মাঠ, পাকা রাস্তা ও নিরাপত্তাবেষ্টনীসহ সকল নাগরিক সুবিধা রয়েছে।
প্লট বরাদ্দের জন্য মাঠ পর্যায়ে ও প্রকল্প পর্যায়ে ২টি কমিটি রয়েছে। একজন নির্বাহী প্রকৌশলী (পুনর্বাসন) এর নেতৃত্বে ৪ সদস্যবিশিষ্ট মাঠ পর্যায়ের প্লট বরাদ্দ কমিটি ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির আবেদনের ভিত্তিতে পুনর্বাসন নীতিমালা অনুযায়ী প্লট পাওয়ার যোগ্য হলে আবেদনপত্র সরেজমিন যাচাই-বাছাই সাপেক্ষে কত শতাংশের প্লট পাওয়ার উপযুক্ত তার পরিমাণ ও ক্ষতিগ্রস্ততার প্রমাণস্বরুপ প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টসহ প্লট/ভিটা উন্নয়ন সহায়তা বরাদ্দের জন্য সুপারিশ প্রকল্প পর্যায়ের প্লট বরাদ্দ কমিটিতে প্রেরণ করে। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের পরিচালক (পি অ্যান্ড ডি) এর নেতৃত্বে ৬ সদস্যবিশিষ্ট প্রকল্প পর্যায়ের প্লট বরাদ্দ কমিটি প্রতিটি আবেদন পুনরায় যাচাই-বাছাই করে, প্রয়োজনে পুনঃতদন্তপূর্বক প্লট বরাদ্দ অথবা ভিটা উন্নয়ন সহায়তার চূড়ান্ত সুপারিশ করে এবং তা অনুমোদনের জন্য প্রকল্প পরিচালকের মাধ্যমে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের নির্বাহী পরিচালক বরাবর প্রেরণ করে। এসব তথ্য দিয়ে পদ্মা সেতু প্রকল্পের একজন নির্বাহী প্রকৌশলী জানান, অধিগ্রহণের ফলে যে সকল ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার বসতগৃহ হারিয়েছেন কিন্তু বসবাসের বিকল্প জায়গার নেই এমন পরিবারসমূহকে পুনর্বাসন নীতিমালার প্রাপ্যতা অনুসারে ২.৫, ৫.০ ও ৭.৫ শতক আয়তনের প্লট বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে যারা ভূমিহীন, উথুলি, নদীভাসী, দুঃস্থ তাদেরকে ভূমিহীনতার প্রমাণপত্র সাপেক্ষে বিনামূল্যে ২.৫ শতাংশের প্লট বরাদ্দ করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া সমাপ্তিকরণের শেষ ধাপ হিসেবে প্লটের ৯৯ বছর মেয়াদী লীজ দলিল রেজিস্ট্রেশন ও দলিল হস্তান্তর কার্যক্রম গত সেপ্টেম্বর ২০২০ থেকে শুরু হয়েছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৮২৩টি লিজ দলিল রেজিস্ট্রেশন সম্পাদন হয়েছে। প্লট বরাদ্দ প্রাপ্তির পর ঘরবাড়ি নির্মাণ করে তিন বছর নিরবচ্ছিন্নভাবে বসবাসের পর একজন প্লটধারী রেজিস্ট্রেশনের জন্য উপযুক্ত বলে বিবেচিত হন। অবৈধভাবে প্লট বিক্রি রোধে লিজ দলিল সম্পাদনের পরও ১০ বছর পর্যন্ত কোন ধরনের বিক্রয়/হস্তান্তর/ বন্ধক প্রদানে নিষেধাজ্ঞার শর্ত প্লট রেজিস্ট্রেশন নীতিমালার সংযুক্ত করা হয়েছে।
পদ্মা সেতুর প্রকল্প পরিচালক সফিকুল ইসলাম জানান, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো বাস্তচ্যুত হয়ে নতুন স্থানে (পুনর্বাসন সাইটে) পুনর্বাসিত হলেও তাদের সন্তানদের লেখাপড়া কার্যক্রম যেন ব্যাহত না হয় সেদিকে লক্ষ্যে রেখে প্রকল্পের ৪টি পুনর্বাসন সাইটে আধুনিক মানের মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। অন্য তিনটি পুনর্বাসন সাইটের অভ্যন্তরে বা নিকটে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকায় সেখানে বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়নি, তবে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের ছেলে-মেয়েরা যেন সহজে ঐসব বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে সেজন্য প্রকল্পের পক্ষ থেকে স্কুলের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তিতে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করা হয়। স্থাপিত প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহে ২০১৭ সাল থেকে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহে বর্তমানে ১ হাজার ২০৯জন ছাত্র-ছাত্রী অধ্যয়নরত রয়েছে।
রিসেটেলমেন্ট অ্যাকশন প্লানে বর্ণিত ‘হেলথ অ্যাকশন প্লান’ এর আওতায় ৫টি পুনর্বাসন সাইটে প্রাথমিক ও জরুরি স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। কেন্দ্রগুলোর মাধ্যমে পুনর্বাসন সাইটে বসবাসরত ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারসমূহ ও পার্শ্ববর্তী এলাকার জনগণের স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় ডাক্তার, মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট, ফার্মাসিস্ট, নার্স, আয়া, সুইপার ও মালি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এপ্রিল ২০১৭ থেকে একযোগে ৫টি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
প্রকল্পের কর্মকর্তারা জানান, স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলো থেকে ১ লাখ ৬১ হাজার ১৩১ জন রোগীকে চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হয়েছে। দরিদ্র ও অসহায় রোগীদের সেবায় বিনামূল্যে ২৮ লাখ ৪৩ হাজার ৩৭৭ টাকার ওষুধ বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়াও উপজেলা পর্যায় থেকে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর যথাযথ সেবা প্রাপ্তির জন্য প্রকল্প এলাকার তিন জেলা সদরের সরকারি হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ৩৬ লাখ ৬ হাজার ২৭৯ টাকার বিভিন্ন মেডিকেল যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হয়েছে।
স্বাক্ষরিত চুক্তির আলোকে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর ১৩টি ট্রেডে ৪ হাজার ৭১১ জন ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যের দক্ষতাবৃদ্ধিমূলক প্রশিক্ষণ প্রদান করছে। ১ম দফায় ৩টি ট্রেডে ১,৫৮৭জনকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। বৈশ্বিক মহামারি কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ বিস্তাররোধে বৎসরাধিককাল বন্ধ থাকার পর মার্চ ২০২১ থেকে পুনরায় প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ২য় দফায় ৯টি ট্রেডে ৬৫৩ জনসহ সর্বমোট ২ হাজার ২৪০ জনের প্রশিক্ষণ সমাপ্ত হয়েছে। বর্তমানে ১০টি ব্যাচে ২৭৯ জনের প্রশিক্ষণ চলমান রয়েছে।