নিজস্ব প্রতিনিধি : চারিদিকে থই থই পানি। হৃদয় দোলানো ঢেউ। ঢেউয়ের মনমাতানো ছলাৎ চলাৎ শব্দ। সাথে ঝিরিঝিরি বাতাস। আপনা আপনিই মন উদাসী হয়ে যায়। জলরাশির কেলিতে তৈরি হয় পা দুলিয়ে ভেজানোর গল্প। চলনবিলের জলরাশির মধ্যে থেকেই সূর্যাস্তের মনোহর দৃশ্য মানবমনের জাগতির ভালোলাগা ছুঁয়ে যায় আকাশ জুড়ে।
পর্যটকদের জন্য এমনই অপরুপ সৌন্দর্য মেলে ধরে বসে আছে চলনবিল। তাইতো প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমের এই সময়ে চলনবিলকে উপভোগ করতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে যায় দর্শনার্থীরা। তবে, বেড়াতে গিয়ে নানা সমস্যা আর সংকটে পড়তে হয় তাদের। তাই চলনবিলে পরিকল্পিত পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার দাবি জানিয়েছেন ভ্রমণ পিপাসুরা। তবে, পর্যটন কেন্দ্র করতে গিয়ে চলনবিলের ক্ষতি যেন না হয়, সেদিকে নজর রাখার পরামর্শ দিয়েছেন পরিবেশবিদরা।
চলনবিলে নৌকা ভ্রমণে গিয়ে দেখা যায়, দু’চোখের দৃষ্টিসীমা জুড়ে শুধুই জলরাশি। বাতাসে কান পাতলেই ভেসে আসে জলের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ। উপরে নীল আকাশ আর ছানা কাটা মেঘ নিজেকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। কখনও সূর্য মেঘের আড়ালে মুখ ঢাকলেও, জলে তার প্রতিচ্ছবি মুগ্ধতার সৃষ্টি করে। জলের ঢেউয়ের তালে, হৃদয়ে দোলা দিয়ে যায় এক অন্যরকম ভালালাগা। হঠাৎ দূর থেকে বিশাল বিলের মাঝে লাল সাদা রঙের ব্রিজ মনে হবে একটি দ্বীপ। যেখানে ইচ্ছে করে পানিতে নেমে পা ভেজানোর। অনেকে গা ভিজিয়েও আনন্দ উপভোগ করেন। বেড়ানো শেষে ফেরার পথে চলনবিলের বুকে সূর্যাস্তের দৃশ্য ছড়িয়ে দেয় মুগ্ধতার আবেশ। আনমনা মন হারিয়ে যায় অন্য জগতে। সূর্যাস্তের আলো শরীরে মেখে বিমোহিত হবেন।
জলরাশি ডেঙিয়ে যাত্রাপথে চোখে পড়ে নয়াভিরাম সৌন্দর্যের এক অপরূপ রূপ। সাদা বক, দুধারে মাছ শিকার, নানা ধরণের জাল বিছানো, ডিঙি নৌকায় মাছ ধরা, জেয়ালার বরশি দিয়ে মাছ ধরা। দুপুরে বাড়ির ঘরণীদের নদীতে গোসল, গরু মহিষের পানি ডুবে মাথা বের করাসহ নানা দৃশ্য ধরা পড়ে যাত্রা পথে।
বর্ষা মৌসুমে এমন নানারকম সৌন্দর্যের দেখা মেলে দেশের সবচেয়ে বড় বিল চলনবিলে। যেখানে রয়েছে বেশকিছু দর্শনীয় স্থান। আর তাইতো বছরের এ সময়টাতে নৌকাভ্রমণে চলনবিলকে উপভোগ করতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ছুটে যান দর্শনার্থীরা। দিলপাশার, বিলসা, চাটমোহর, সিংড়া, উল্লাপাড়া সহ বেশকিছু স্থানে পরিবার বা বন্ধু স্বজন নিয়ে নৌকাভ্রমণে উপভোগ করছেন তারা। তবে চলনবিলে পরিবার নিয়ে বেড়াতে গিয়ে কিছু সমস্যা সংকটে বিপাকেও পড়তে হয় বলে জানালেন ভ্রমণপিপাসুরা।
চলনবিলে বেড়াতে আসা ব্যবসায়ী মেহেদী হাসান সুজন, চাকুরীজীবি ইউসুফ মন্ডল বলেন, দেশের সবচেয়ে বড় বিল চলনবিলে প্রতিবছরই তারা বেড়াতে আসেন। নৌকায় বেড়ানো অন্যরকম মজা হয়। আকাশ আর পানির এক অপরুপ মিতালী সৌন্দর্য উপভোগ করার মতো।
কলেজ শিক্ষক অরুপ কুন্ডু, গৃহিনী নাছিমা খানম বলেন, চলনবিলে বেড়াতে খুবই ভাল লাগে। তবে ভাল থাকার জায়গা, খাওয়ার হোটেল, পাবলিক টয়লেট সহ বেশকিছু সমস্যা ও সংকট রয়েছে। এগুলো নিরসনে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা ভূমিকা রাখতে পারেন। পাশাপাশি চলনবিলে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা গেলে আরও ভাল হয়।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে চলনবিল অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের ফোকাল পয়েন্ট এলজিইডির প্রকল্প পরিচালক মমিন মজিবুল হক সমাজী বলেন, সরকারের সকল আইন ও বিধিবিধান মেনে এলজিইডি পরিকল্পিত, সমন্বিত ও টেকসই চলনবিল উন্নয়নের জন্য কাজ করছে। চলনবিলে যদি পর্যটন শিল্পের বিকাশ বিকাশ ঘটাতে হয় তাহলে ইকো ট্যুরিজমের মতো প্যাকেজ গ্রহণ করতে হবে।
চলনবিল রক্ষা আন্দোলনের সদস্য সচিব এস এম মিজানুর রহমান বলেন, চলনবিলে পর্যটন কেন্দ্র হতেই পারে। তার আগে রাষ্ট্রকে বিশেষভাবে বিবেচনা করতে হবে যেন চলনবিল ক্ষতিগ্রস্থ না হয়। এ বিষয়ে যারা বিশেষজ্ঞ ও এলাকার মানুষ আছে, তাদের মতামত নিয়ে কাজ করতে হবে। কারণ ইতিমধ্যে এক হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের চলনবিল এখন ৩৫০ বর্গকিলোমিটারে দাঁড়িয়েছে।
চাটমোহরের নুর ঘাটে কথা হয় বেশ কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে। তারা বলেন, এই ঘাট থেকে বড় বড় নৌকা নিয়ে পিকনিক ও নৌকা ভ্রমণ করতে আসা মানুষগুলো ভাড়া করে নেন। একটি নৌকায় ডেকোরেটর সামগ্রী, সাউন্ড সিস্টেম, বৈদ্যুতিক ব্যবস্থাসহ সব ধরণের সুযোগ সুবিধা রয়েছে।
তাদের দাবী, মাঝ বিলের মধ্যে যাওয়ার পর অধিকাংশ সময় পানির উপরই অবস্থান করতে হয়। নদীর পাড়ে বা নৌকা ভিড়িয়ে দাঁড়ানোর জায়গা একেবারেই নেই। সরকারের কাছে তাদের দাবী, বৃহৎ এই চলনবিলে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বজায় রেখে বিলের কোন ক্ষতি না করে জায়গায় জায়গায় পর্যটন স্পট তৈরী করা হলে একদিনে ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য অনেক ভালো। অন্যদিকে সরকারি ভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করলে এখান থেকেও সরকারের রাজস্ব আয় সম্ভব।