বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : চীনের সাংহাই শহরের আদলে বন্দরনগরী চট্টগ্রামকে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ মডেলে গড়ে তুলতে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ করছে সরকার। দেশের প্রথম এই সুড়ঙ্গপথের নামকরণ করা হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’। এই মেগা প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। আগস্ট মাস পর্যন্ত প্রকল্পের সার্বিক ভৌত অগ্রগতি ৭৩ শতাংশ। আশা করা হচ্ছে, ২০২২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেই এই টানেলের কাজ শেষ হবে। স্বপ্নের এই টানেল দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
চীনের সবচেয়ে বড় ও জনবহুল নগরী সাংহাই পরিচিত ওয়ান সিটি টু টাউন হিসেবে। দেশটির এই শিল্প ও বাণিজ্য কেন্দ্রকে দুই ভাগে ভাগ করেছে চ্যাং জিয়াং নদীর উপনদী হুয়াংপু, যে নদীতে নির্মিত টানেল যুক্ত করেছে দুই পাড়কে। সাংহাই সমুদ্রবন্দর বর্তমান বিশ্বের ব্যস্ততম সমুদ্রবন্দর, সবচেয়ে বড় সমুদ্রবন্দরগুলোর একটিও। আর সাংহাইয়ের মতো ভৌগোলিক অবস্থা বন্দরনগরী চট্টগ্রাম এবং কর্ণফুলী নদীর ওপারের আনোয়ারা উপজেলার।
আশা করা হচ্ছে, স্বপ্নের এই টানেল চালু হলে কর্ণফুলী নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠবে সাংহাইয়ের মতো ওয়ান সিটি টু টাউন। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা কক্সবাজার ও দক্ষিণ চট্টগ্রামগামী গাড়িগুলোকে আর বন্দরনগরীতে ঢুকতে হবে না। চট্টগ্রাম সিটি আউটার রিং রোড হয়ে টানেলের মাধ্যমে দ্রুত সময়ের মধ্যে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে। ফলে চট্টগ্রাম নগরে যানবাহনের চাপ কমে যাবে। টানেলকে ঘিরে চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের পর্যটনশিল্পের আরও বিকাশ ঘটবে।
মূল টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। এর মধ্যে টানেলের প্রতিটি টিউবের দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার এবং ব্যাস ১০ দশমিক ৮০ মিটার। প্রতিটি টিউবে দুটি করে মোট চারটি লেন থাকবে। মূল টানেলের সঙ্গে পশ্চিম ও পূর্ব প্রান্তে ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার সংযুক্ত সড়ক থাকবে। আর রয়েছে ৭২৭ মিটার দীর্ঘ ওভারব্রিজ।
চট্টগ্রাম বিমানবন্দর এলাকা থেকে কর্ণফুলী নদীর দুই কিলোমিটার ভাটির দিকে নেভি কলেজের কাছ দিয়ে প্রবেশ করতে হবে এই টানেলে, বের হওয়া যাবে আনোয়ারা উপজেলার বৈরাগী ইউনিয়নের সার কারখানার কাছ দিয়ে।
কর্ণফুলী নদীতে যখন পিলার সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়, তখন সে সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন তৎকালীন মেয়র আওয়ামী লীগ নেতা মহিউদ্দিন চৌধুরী। তিনি দাবি করেছিলেন কর্ণফুলীর তলদেশ দিয়ে টানেল নির্মাণের। তখন তার সেই দাবি বাস্তবসম্মত মনে হয়নি অনেকের কাছে। ২০০৮ সালে সংসদ নির্বাচনের আগে চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে নির্বাচনি সমাবেশে এই টানেল নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এই টানেল নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি এইনির্মাণকাজ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। দুটি টিউবের একটির খননকাজ শেষ হয়েছে ২০২০ সালের ২ আগস্ট, এখন চলছে সড়কপথের কাজ। ২০২০ সালের ১২ ডিসেম্বর আনোয়ারা প্রান্তে দ্বিতীয় টিউবের খননকাজ শুরু হয়, যে কাজ প্রায় শেষের পথে।
প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, টানেলের পতেঙ্গা প্রান্তে ফ্লাড গেটের নির্মাণও শেষ হয়েছে। টানেলের সঙ্গে সংযুক্তকারী দুটি রাস্তার কাজ চলছে। আর আনোয়ারা প্রান্তে ৭২৭ মিটার দীর্ঘ ওভারব্রিজের কাজও শেষ দিকে। আনোয়ারার উপজেলার বৈরাগী ইউনিয়নের বাসিন্দা সুমন শাহ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ধারণা করছি, এই টানেল হয়ে গেলে আমাদের এলাকা অনেক বদলে যাবে। ইতোমধ্যে তার কিছু নমুনাও দেখতে পাচ্ছি। এলাকার রাস্তাঘাট অনেক বড় করে তৈরি হচ্ছে।
‘কোরিয়ান ইপিজেড তো আছেই, সঙ্গে চীনা ইপিজেড তৈরি হচ্ছে। এগুলো হয়ে গেলে এলাকায় কোনো বেকার থাকবে না। অনেক ব্যবসায়ী এখানে কারখানা দেয়ার জন্য জায়গা কেনা শুরু করেছে। এ জন্য আমাদের এলাকার জমির দামও বেড়ে গেছে। সব মিলিয়ে এই টানেল আমাদের জন্য ভালো কিছুই বয়ে আনবে মনে হচ্ছে।’
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ বলছে, চট্টগ্রাম শহরে নিরবচ্ছিন্ন ও যুগোপযোগী সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তুলতে ও বিদ্যমান সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা আধুনিকায়ন করতে করা হচ্ছে এই টানেল। এটি এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করবে। কর্ণফুলী নদীর পূর্ব তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা শহরের সঙ্গে ডাউন টাউনকে যুক্ত করে উন্নয়নকাজ ত্বরান্বিত করবে। চট্টগ্রাম বন্দরের বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি ও গভীর সমুদ্রবন্দরের কাজ ত্বরান্বিত করবে। সর্বোপরি ঢাকা-চট্রগ্রাম-কক্সবাজারের মধ্যে নতুন সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য কর্ণফুলী টানেল নির্মিত হচ্ছে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এই টানেল হয়ে গেলে এই অঞ্চলের যোগাযোগব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন হবে। কর্ণফুলী নদীর পূর্ব প্রান্ত আনোয়ারার দিকে প্রস্তাবিত শিল্প এলাকার উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত চট্টগ্রাম শহর, চট্টগ্রাম বন্দর ও বিমানবন্দরের সঙ্গে উন্নত ও সহজ যোগাযোগব্যবস্থা স্থাপিত হবে। ফলে ভ্রমণ সময় ও খরচ কমবে এবং পূর্ব প্রান্তের শিল্পকারখানার কাঁচামাল ও প্রস্তুতকৃত মালামাল চট্টগ্রাম বন্দর, বিমানবন্দর ও দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে পরিবহন প্রক্রিয়া সহজ হবে।
কর্ণফুলী নদীর পূর্ব প্রান্তের সঙ্গে সহজ যোগাযোগব্যবস্থা স্থাপনের ফলে পূর্ব প্রান্তে পর্যটনশিল্প বিকশিত হবে। এসব কারণে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, রপ্তানি বাড়বে। ফলে দারিদ্র্য দূরীকরণসহ দেশের ব্যাপক আর্থসামাজিক উন্নয়ন হবে।
প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য ২০১২ সালে সেতু কর্তৃপক্ষ, চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড (সিসিসিসিএল) ও অভি অরূপ অ্যান্ড পার্টনার্স হংকং লিমিটেড যৌথভাবে টানেল নির্মাণের কারিগরি ও অর্থনৈতিক সমীক্ষা করে।
২০১৪ সালের জুন মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরকালে দুই দেশের মধ্যে জিটুজি ভিত্তিতে (সরকারের সঙ্গে সরকারের) সমঝোতা স্মারক সই হয়। চীন সরকারই সিসিসিসিএলকে এই টানেল নির্মাণের জন্য মনোনীত করে। এ বিষয়ে ওই বছরের ৩০ জুন সেতু কর্তৃপক্ষ ও সিসিসিসিএলের মধ্যে বাণিজ্যিক চুক্তি হয়।
২০১৫ সালের নভেম্বরে একনেক সভায় ‘কনস্ট্রাকশন অব মাল্টি লেন রোড টানেল আন্ডার দ্য রিভার কর্ণফুলী’ শীর্ষক টানেল প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয়। প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয় ২০২০ সালের জুন এবং ব্যয় ধরা হয় ৮ হাজার ৪৪৬ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। পরে প্রকল্পের মেয়াদ আড়াই বছর বাড়িয়ে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়। আর ১ হাজার ৯২৭ কোটি টাকা ব্যয় বাড়িয়ে করা হয় ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা।
প্রকল্পের মোট ব্যয়ের মধ্যে বাংলাদেশ সরকার অর্থসহায়তা দিচ্ছে ৪ হাজার ৪৬১ কোটি ২৩ লাখ টাকা। প্রকল্প সাহায্যের বাকি ৫ হাজার ৯১৩ কোটি ১৯ লাখ টাকা দিচ্ছে চীনের এক্সিম ব্যাংক। এই টাকা ঋণ হিসেবে পরিশোধ করতে হবে। ঋণের সুদের হার ২ শতাংশ।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মইনুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এই বঙ্গবন্ধু টানেল উদ্বোধনের পর চট্টগ্রাম অঞ্চলে ব্যাপক প্রভাব পড়বে। নদীর ওই পাড়ে অর্থাৎ দক্ষিণাঞ্চলে ব্যাপক শিল্পায়ন হবে। ইতোমধ্যে আনোয়ারায় কোরিয়ান ইপিজেড আছে, চীনা অর্থনৈতিক জোনও শুরু হওয়ার পথে।
‘টানেল হয়ে গেলে আরও অনেক শিল্পকারখানা গড়ে উঠবে। সেখানে ব্যাপক কর্মসংস্থান হবে। আবাসনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। মোট কথা সেখানে উপশহর গড়ে উঠবে। এতে চট্টগ্রাম শহরের ওপর কিছুটা হলেও চাপ কমবে। সব কিছু মিলিয়ে আমাদের অর্থনীতির আকার বড় হবে। জিডিপি বাড়বে।’
কর্ণফুলী টানেলের প্রকল্প পরিচালক হারুনুর রশীদ চৌধুরী ৫ অক্টোবর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত পুরো প্রকল্পের সংযোগ সড়কসহ টানেল নির্মাণের কাজ ৭৩ শতাংশ শেষ হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম টিউবের কাজ শেষে চলছে সড়ক নির্মাণের কাজ। ২৪৫০ মিটার সড়কের মধ্যে ১৬০০ মিটারের কাজ হয়েছে। আর দ্বিতীয় টিউব খননের কাজ চলছে। ২৪৫০ মিটার টিউবের মধ্যে ২৪৩৫ মিটারের কাজ শেষ। এই খননকাজ শেষ হলে শুরু হবে সড়ক নির্মাণের কাজ।’
প্রতিদিন কত মিটার খনন হয়, এমন প্রশ্নে প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘এটা একটা বিরাট বোরিং মেশিন। এটা প্রতিদিন কত মিটার খনন করে বলা কঠিন। কারণ এই মেশিনে বিভিন্ন বিষয় আছে। এর যেকোনো একটিতে সমস্যা হলে ওই দিন বেশি কাজ হয় না। এটা ঠিক করে আবার কাজ করতে হয়।’
তিনি বলেন, ‘২০২২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেই এই টানেলের কাজ শেষ করা আমাদের লক্ষ্য। কিন্তু করোনার কারণে কাজে কিছুটা সমস্যা হয়েছে। তারপরও আমরা চেষ্টা করছি এই লক্ষ্যের মধ্যেই কাজ শেষ করার। কিন্তু ওই সময়ের মধ্যেই আমরা কাজ শেষ করতে পারব কি না, এটা এখনই বলা যাবে না।’
প্রকল্প পরিচালক বৃহস্পতিবার রাতে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সুড়ঙ্গ খনন বৃহস্পতিবার শেষ হয়েছে। এখন রাস্তা তৈরির কাজ শুরু হবে। মূল চ্যালেঞ্জ আমরা পার করেছি। আশা করি আর জটিলতা নেই। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে আমরা কাজ শেষ করে দেব।’ তিনি আরও বলেন, ‘এই প্রকল্পের একটি ইতিবাচক দিক হলো, এর মেয়াদ ও ব্যয় বাড়াতে হয়নি। নির্ধারিত মেয়াদে কাজ শেষ হচ্ছে। তবে আগেও শেষ হয়ে যেতে পারে। এটি এখন শিওর করে বলছি না।’