পাবনা প্রতিনিধি : পাবনার রূপপুরে পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মূল যন্ত্র রিঅ্যাক্টর প্রেসার ভেসেল বা পরমাণু চুল্লিপাত্র প্রথম ইউনিটে স্থাপন করা হয়েছে। রোববার বেলা ১১ টা ৪৩ মিনিএে ঢাকা থেকে ভিডিও কনফারেন্সিং এর মাধ্যমে এই কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিশেষ অতিথি হিসেবে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ছিলেন রাশিয়ার পরমাণু শক্তি সংস্থা রোসাটমের মহাপরিচালক অ্যালেক্সি লিখাচেভ।
রিয়াক্টর ভবনের ভেতর থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে রূপপুর প্রকল্পের পরিচালক ও পরমাণু বিজ্ঞানী ড. মো. শৌকত আকবর, রিঅ্যাক্টর প্রেসার ভেসেল স্থাপনের অনুমতি প্রার্থনা করেন। প্রধানমন্ত্রী অনুমতি দিলে, রিঅ্যাক্টর ভেসেলটি নকশা অনুযায়ী যথাস্থানে স্থাপন করা হয়। ৫ থেকে ৬ মিনিটের মধ্যে এটি স্থাপন শেষ হলে জয় বাংলা, জয় বাংলা শ্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে রিঅ্যাক্টর ভবন থেকে অনুষ্ঠানস্থল।
গত ১৪ সেপ্টেম্বর থেকে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মূল যন্ত্রটি স্থাপনের কার্যক্রম শুরু হয়।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আজকের দিনটি শুধু বাংলাদেশের জন্য, আমার ব্যক্তিগত জীবনেও গুরুত্বপূর্ণ। আমি খুব আনন্দিত হতাম যদি স্বশরীরে উপস্থিত থাকতে পারতাম। করোনা মহামারির কারণে সেটি সম্ভব হলো না। তবে দ্রুতই আমি এখানে আসবো।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সাথেও পাকিস্তান আমলের বঞ্চনার ইতিহাস জড়িত। তারা ধোঁকাবাজি করেছে। শুধু জমি বরাদ্দ করে। আর প্রকল্পটি পশ্চিম পাকিস্তানে সরিয়ে নেয়।
জাতির পিতা স্বাধীনতার পরপরই আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেন। এমনটা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এর ফলে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন সহজ হচ্ছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি এজেন্সি-আইএইএ’র অনেক নির্দেশনা মেনে চলতে হচ্ছে।
শেখ হাসিনা বলেন, ২০১৩ সালে রাশিয়া সফরে প্রেসিডেন্ট পুতিনের সাথে আমার আলোচনা হয়। বিশেষকরে পারমাণবিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং জননিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত হয়েই আমরা এই প্রকল্প শুরু করি।
বিশ্বের অন্যতম জ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদ শেখ হাসিনা বলেন, রিয়াক্টর প্রেসার ভেসেল স্থাপনের ফলে বিশ্বে পারমাণবিক যুগে বেশ শক্ত অবস্থানে এলাম আমরা। আর সেটি কিন্তু আমরা পারমাণবিক প্রযুক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার করে।
প্রধানমন্ত্রী মনে করেন, এই পারমাণবিক প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করতে পরমাণু শক্তি কমিশনের বিজ্ঞানীরাও নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করছে। সবকিছু ভালোভাবে পরিচালনা করতে আমরা তাঁদেরকে রাশিয়া ও ভারতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছি।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি বিজ্ঞানমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান বলেন, আজ জাতীয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দিন। পারমাণবিক প্রকল্প বাস্তবায়ণে জাতির পিতা ও তাঁর কন্যার প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। তিনি আরও বলেন, রাশিয়া বাংলাদেশের দুখের দিনের বন্ধু। রিয়াক্টর প্রেসার ভেসেল স্থাপনের কারণে বিশ্ব সভ্যতায় অনন্য অবস্থায় উন্নীত হলো বাংলাদেশ।
অনুষ্ঠানে অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, পাবনা ১ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট শামসুল হক টুকু, পাবনা- ২ আসনের সংসদ সদস্য আহমেদ ফিরোজ কবির, পাবনা-৩ আসনের সংসদ সদস্য মকবুল হোসেন, পাবনা-৪ আসনের সংসদ সদস্য আলহাজ্ব বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুজ্জামান বিশ্বাস, পাবনা- ৫ আসনের সংসদ সদস্য জেলা আওয়ামীলীগ সেক্রেটারী গোলাম ফারুক প্রিন্স ।
রাশিয়ার কারিগরি ও আর্থিক সহায়তায় নির্মিত হচ্ছে রূপপুর প্রকল্প। রুশ পরমাণু শক্তি সংস্থার মহাপরিচালক এলেক্সি লিখাচেভ বলেন,পারমাণবিক বিদ্যুৎ নির্মাণ বেশ জটিল একটি বিষয়। রুশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষতার প্রমাণ ভিভিইআর রিয়াক্টর। যেটি রূপপুরে নির্মাণ করা হচ্ছে। নির্মাণের পর এটি পরিচালনার জনশক্তিকেও প্রশিক্ষিত করে দিচ্ছে বাংলাদেশ। পারমাণবিক প্রযুক্তি ক্লিন এনার্জির একটি উত্তম দৃষ্টান্ত। এছাড়া রূপপুরের কারণে ২০ হাজার কর্মসংস্থান হবে। এটি শুধু স্থানীয় জীবনমানই পরিবর্তন করবে না বরং জিডিপি বৃদ্ধিতেও অবদান রাখবে। বাংলাদেশের পারমাণবিক প্রকল্প নির্মাণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে রোসাটম। এবং সময়মতো এটির নির্মাণ শেষ করতে রাশিয়া সম্ভাব্য সবকিছু করবে।
রুপপুর প্রকল্প বাস্তবায়ণ করছে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন। প্রকল্প পরিচালক ও পরমাণু বিজ্ঞানী ড. মো. শৌকত আকবর বলেন, আইএইএ’র গাইডলাইন অনুযায়ী সব নির্দেশনা মেনেই আজকে রিয়াক্টর প্রেসাল ভেসেল স্থাপন করা হচ্ছে।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. জিয়াউল হাসান। রিঅ্যাক্টর প্রেসার ভেসেল: পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মূল যন্ত্র। এর মধ্যেই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জ্বালানি ইউরেনিয়াম লোড করা হয়। এবং এখানেই ফিশন বা চেইন রিয়াকশনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রক্রিয়া শুরু হয়।
কি কি বসবে রিঅ্যাক্টর ভবনে? প্রকল্প এলাকায় গোলাকৃতি যে দুটি ভবন দেখা যায় সেগুলোই রিঅ্যাক্টর ভবন। এদের মধ্যে একটিতে ১০ অক্টোবর বসানো হবে রিঅ্যাক্টর প্রেসার ভেসেল বা পরমাণু চুল্লিপাত্র। এটিকে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের হার্ট বা হৃদপিন্ড বলা যেতে পারে। এই ভবনের বিভিন্ন ধাপে বসানো হয়েছে নিউক্লিয়ার যন্ত্রপাতি। পাঁচ ধরনের যন্ত্রের মধ্যে ইতিমধ্যে প্রেসারাইজার, কুল্যান্ট পাম্প এবং হাইড্রো এক্যুমুলেটর বসানো সম্পন্ন হয়েছে। রিঅ্যাক্টর প্রেসার ভেসেল স্থাপনের পরপরই আগামি নভেম্বরে স্থাপন করা হবে স্টিম জেনারেটর। এর মাধ্যমে প্রথম ইউনিটে সব ধরনের নিউক্লিয়ার যন্ত্রপাতি বসানো শেষ হবে।
প্রকল্প পরিচালক বলেন, প্রতিটি যন্ত্র সর্বোচ্চ পরীক্ষা নিরীক্ষার ধাপ পেরিয়ে নকশা অনুযায়ি বসানো হচ্ছে। এজন্য নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের সনদ নিতে হয়েছে এবং কাজের মান দেখে তারা সন্তোষ প্রকাশও করেছে।
১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি খরচের এই প্রকল্পে নব্বই ভাগ টাকা ঋণ দিয়েছে রাশিয়া। একই সাথে আন্তঃরাষ্ট্রীয় কয়েকটি চুক্তির মাধ্যমে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণ করছে রূশ ঠিকাদার এটমস্ট্রয়এক্সপোর্ট। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২৩ এ প্রথম ইউনিট থেকে ১২০০ মেগাওয়াট এবং একই পরিমাণ বিদ্যুৎ দ্বিতীয় ইউনিট থেকে পাওয়া যাবে ২০২৪ সালে।