বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : মৃত্যু-ধ্বংস-রক্তস্রোতের সেই ভয়ঙ্কর-বিভীষিকাময় রক্তাক্ত ২১ আগস্ট। বারুদ আর রক্তমাখা বীভৎস রাজনৈতিক হত্যাযজ্ঞের দিন। মৃত্যু-ধ্বংস-রক্তস্রোতের নারকীয় গ্রেনেড হামলার পনের বছর।
সভ্যজগতের অকল্পনীয় এক নারকীয় হত্যাকান্ড চালানো হয় ২০০৪ সালের এই দিনে। গ্রেনেডের হিংস্র দানবীয় সন্ত্রাস আক্রান্ত করে মানবতাকে। রক্ত-ঝড়ের প্রচন্ডতায় মলিন হয়ে গিয়েছিল বাংলা ও বাঙালীর মুখ। জীবন্ত বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় প্রাঙ্গণ এদিন মুহূর্তেই পরিণত হয়েছিল মৃত্যুপুরীতে।
শোকাবহ রক্তাক্ত আগস্ট মাসেই আরেকটি ১৫ আগস্ট ঘটানোর লক্ষ্য থেকে ঘাতক হায়েনার দল গ্রেনেড দিয়ে রক্তস্রোতের বন্যা বইয়ে দিয়েছিল বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউয়ের আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের সমাবেশস্থলে। টার্গেট ছিল এক ও অভিন্ন। বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগকে সম্পূর্ণ নেতৃত্বশূন্য ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংস করতেই ঘাতকরা চালায় এই দানবীয় হত্যাযজ্ঞ। জাতির সামনে আবারও স্পষ্ট হয়ে ওঠে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধস্পৃহা। বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় থাকার সময়ই খোদ রাজধানীতে প্রকাশ্যে চালানো হয়েছিল যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহৃত মারণাস্ত্র গ্রেনেড দিয়ে এই ভয়াল ও বীভৎস হামলা। ওই সরকারের মন্ত্রী থেকে শুরু করে অনেকেই যে এই নারকীয় হামলার সঙ্গে জড়িত ছিল, তা তদন্তের মাধ্যমে জাতির সামনে আজ স্পষ্ট হয়ে গেছে।
হিংস্র শ্বাপদের ভয়াল ছোবলে সেদিন মানবঢাল রচনা করে নেতাকর্মীরা বঙ্গবন্ধু কন্যা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা করতে পারলেও ওই নৃশংস হামলায় ঝড়ে পড়েছিল বেগম আইভি রহমানসহ ২৪টি তরতাজা প্রাণ। আহত হওয়া পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মীর অনেকেই ঘাতক গ্রেনেডের স্প্লিন্টারের দুর্বিষহ যন্ত্রণা নিয়েই ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছেন মৃত্যুর দিকে। হাত-পা-চোখসহ দেশের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হারিয়ে অসংখ্য নেতাকর্মী পঙ্গুত্ববরণ করে জীবনধারণ করছে। ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়র ও বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় নেতা মোহাম্মদ হানিফ মাথায় বিঁধে থাকা স্প্লিন্টারের জীবনযন্ত্রণা ভোগ করেই শেষ মৃত্যুর কাছে পরাজিত হয়েছেন।
গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংস করতে সেদিন শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে চেয়েছিল ঘাতকচক্র। ঘাতকের গ্রেনেড হামলায় রীতিমতো রক্তগঙ্গা বইয়ে গিয়েছিল আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের প্রাঙ্গণ। সন্ত্রাসবিরোধী আওয়ামী লীগের শান্তির সমাবেশকে ঘিরে কোলাহলপূর্ণ বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউ মুহূর্তেই পরিণত হয়েছিল বীভৎস মৃত্যুপুরীতে। সুপরিকল্পিত ও ঘৃণ্য এই গ্রেনেড হামলা চালিয়ে রক্তাক্ত ও শোকাবহ আগস্টে আরেকটি ১৫ আগস্ট সৃষ্টির অপচেষ্টা করেছিল পরাজিত ঘাতকচক্র। তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে হায়েনাদের হামলার ধরনও ছিল রক্তাক্ত ১৫ আগস্টের মতোই।
ভয়াল সেই হামলায় মৃত্যুজাল ছিন্ন করে প্রাণে বেঁচে গেলেও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হারিয়েছেন তাঁর দু’কানের স্বাভাবিক শ্রবণশক্তি। সেদিনের গ্রেনেড হামলায় আহত সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানকেও ওইদিন তাঁর প্রিয়পত্নী আইভি রহমানকে হারানোর শোক নিয়েই এ পৃথিবী থেকে চলে যেতে হয়েছে না ফেরার দেশে। আহত পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মী দেহে স্প্লিন্টার নিয়ে, হাত-পা-চোখ হারিয়ে জীবন্মৃত অবস্থায় অভিশপ্ত জীবন কাটাচ্ছেন। অসংখ্য নেতাকর্মীকে চিরদিনের জন্য বরণ করতে হয়েছে পঙ্গুত্ব, অন্ধত্ব। বীভৎস ওই হামলার ঘটনায় দেশে-বিদেশে গভীর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা সৃষ্টি করলেও বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে মামলাটি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে এবং আলামত নষ্ট করার নানা চক্রান্ত প্রত্যক্ষ করেছে দেশবাসী।
তবে এই ভয়াল ও নারকীয় এই হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার যে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত তা সময়ের ব্যবধানে দেশবাসীর সামনে প্রকাশ পেয়েছে। তদন্তে বেরিয়ে এসেছে ওই বীভৎস হামলার সঙ্গে জড়িত জোট সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ উগ্র জঙ্গীবাদের সশস্ত্র ক্যাডাররা।
এই লোমহর্ষক গ্রেনেড হামলার ঘটনা ধামাচাপা, ভিন্ন খাতে প্রবাহিত ও আলামত নষ্টসহ হেন কোন কাজ নেই যা করে যায়নি বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। হাওয়া ভবনে বসে তখন জজ মিয়ার নাটক সাজানোর ঘটনা এখন দেশবাসীর মুখে মুখে। বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসে ২১ আগস্ট মামলা অধিকতর তদন্ত শেষ করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেছে। তদন্তকারী সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, এই হামলায় ব্যবহৃত গ্রেনেডের উৎসের সন্ধান পেয়েছে তারা। তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের অনেক রাঘববোয়ালদের জড়িত থাকার প্রমাণও তাদের হাতে।
নারকীয় এই গ্রেনেড হামলার ৯ বছর পেরিয়ে গেলেও এখন ঘাতকচক্রের বিচার হয়নি। এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশ ইতোপূর্বে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টু এবং ঢাকা সিটি ওয়ার্ড কমিশনার আরিফুল ইসলাম আরিফকে গ্রেফতার করে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ৭ বছর ও অধিকতর তদন্তের আদেশ হওয়ার প্রায় ২ বছর পর ২০১১ সালের ৩ জুলাই আদালতে সম্পূরক চার্জশিট দাখিল করা হয়। সম্পূরক এ চার্জশিট দাখিল করতে দুই বছরে ১৪ দফা সময় নেয়া হয়।
এরপর সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আব্দুল কাহ্হার আকন্দ পরবর্তীতে তদন্ত করেন। তিনি একই বছরের ৩ জুলাই গ্রেনেড হামলার হত্যা ও বিস্ফোরকের পৃথক দুই মামলায় সিআইডির সম্পূরক অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করেন। নতুন সম্পূরক অভিযোগপত্রে তারেক রহমানসহ নতুন ৩০ জনকে আসামি করা হয়। সম্পূরক চার্জশিট দাখিলের সময় মোট ১৮ জন পলাতক ছিলেন। পরে ৬ পুলিশ কর্মকর্তা আদালতে আত্মসমর্পণ করে কারাগারে গেলে পলাতক আসামির সংখ্যা দাঁড়ায় ১২ জনে।
ফ্লাশব্যাক : ২১ আগস্ট ২০০৪
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। সেদিনটি ছিল শনিবার। বিকেলে বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউয়ে সন্ত্রাস ও বোমা হামলার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশ। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। হাজার হাজার মানুষের স্রোত সমাবেশটিতে। সমাবেশ শেষে সন্ত্রাসবিরোধী মিছিল হওয়ার কথা। তাই মঞ্চ নির্মাণ না করে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে একটি ট্রাককে মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সমাবেশে অন্য কেন্দ্রীয় নেতাদের বক্তব্য শেষে শেখ হাসিনা বক্তব্য দিতে শুরু করেন। বক্তব্যও শেষ করে ফেলেন।
সময় তখন বিকেল ৫টা ২২ মিনিট। ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে বক্তৃতা শেষ করে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা তাঁর হাতে থাকা একটি কাগজ ভাঁজ করতে করতে এগুতে থাকলেন ট্রাক থেকে নামার সিঁড়ির কাছে। মুহূর্তেই শুরু হলো নারকীয় গ্রেনেড হামলা। বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হতে লাগল একের পর এক গ্রেনেড। আর জীবন্ত বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউ মুহূর্তেই পরিণত হলো মৃত্যুপুরীতে। শেখ হাসিনাকে টার্গেট করে খই ফোটার মতো একের পর এক গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটায় ঘাতকরা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ১৩টি গ্রেনেড হামলার বীভৎসতায় মুহূর্তেই রক্ত-মাংসের স্তূপে পরিণত হয় সমাবেশস্থল। রক্তগঙ্গা বইয়ে যায় এলাকাজুড়ে।
ঘাতকদের প্রধান লক্ষ্যই ছিল শেখ হাসিনা। পরিস্থিতির তাৎপর্য বুঝতে ট্রাকে অবস্থানরত নেতৃবৃন্দ ও শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মকর্তারা মানবঢাল রচনা করে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেন বঙ্গবন্ধুর এই কন্যাকে। নেতা ও দেহরক্ষীদের আত্মত্যাগ ও পরম করুণাময়ের অশেষ রহমতে অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পান বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আরেকটি রক্তাক্ত ১৫ আগস্ট ঘটাতে শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে উপর্যুপরি ১৩টি গ্রেনেড মেরেই ক্ষান্ত হয়নি ঘাতকরা; গ্রেনেডের আঘাতে পরাস্ত করতে না পেরে ওইদিন শেখ হাসিনার গাড়িতে ঘাতকরা ছুঁড়েছিল বেশ কয়েক রাউন্ড গুলি। একেবারে পরিকল্পিত ও টার্গেট করা ঘাতকদের নিক্ষিপ্ত গুলি ভেদ করতে পারেনি শেখ হাসিনাকে বহনকারী বুলেটপ্রুফ গাড়ির কাচ। কিন্তু ঘাতকদের নিক্ষিপ্ত বুলেট থেকে শেখ হাসিনাকে রক্ষায় বুলেটের সামনে দাঁড়িয়ে জীবন বিলিয়ে দেন তাঁর ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকর্মী ল্যান্স কর্পোরাল (অব) মাহবুবুর রশীদ।
পরিকল্পিত হামলায় মৃত্যুর দুয়ার থেকে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ফিরে এলেও ওইদিন মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয় পুরো এলাকা। এই ভয়ঙ্কর গ্রেনেড হামলার পর সেদিন স্প্লিন্টারেরআঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন শত শত মানুষ। আকস্মিক মৃত্যু আর রক্তস্রোতে ল-ভ- শান্তিপ্রিয় অসংখ্য মানুষের হাত-পা সহ মানবদেহের বিভিন্ন অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। কারও হাত নেই, কারও পা উড়ে গেছে। রক্তে ভিজে লাল হয়ে যায় পিচঢালা কালো পথ। অস্থায়ী সভামঞ্চ ট্রাকের চারপাশে রক্তের অনাহূত আল্পনা, শত শত মানুষের আর্তচিৎকার। বেঁচে থাকার জন্য, প্রাণ বাঁচানোর জন্য মুমূর্ষুদের আকৃতি, কাতর আর্তনাদসহ অবর্ণনীয় মর্মান্তিক সেই দৃশ্য।
যাঁরা নিহত হয়েছিলেন:
২১ আগস্টের সেই রক্তাক্ত ঘটনায় ঘটনাস্থলেই নিহত হন ১৬ জন। পরে সবমিলিয়ে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৪ জনে। নারী নেত্রী আইভি রহমান ৫৮ ঘণ্টা মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে একই বছরের ২৪ আগস্ট মারা যান। আহত হওয়ার পর প্রায় দেড় বছর মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে হেরে যান আওয়ামী লীগের জনপ্রিয় নেতা ও প্রথম নির্বাচিত মেয়র মোহাম্মদ হানিফ। রক্তাক্ত-বীভৎস ওই ভয়াল গ্রেনেড হামলায় নিহত অন্যরা হলেন শেখ হাসিনার দেহরক্ষী ল্যান্স করপোরাল (অব) মাহবুবুর রহমান, হাসিনা মমতাজ, রিজিয়া বেগম, রফিকুল ইসলাম (সবার প্রিয় আদা চাচা), রতন শিকদার, মোহাম্মদ হানিফ ওরফে মুক্তিযোদ্ধা হানিফ, মোশতাক আহমেদ, লিটন মুনশি, আবদুল কুদ্দুছ পাটোয়ারী, বিল্লাল হোসেন, আব্বাছ উদ্দিন শিকদার, আতিক সরকার, মামুন মৃধা, নাসিরউদ্দিন, আবুল কাসেম, আবুল কালাম আজাদ, আবদুর রহিম, আমিনুল ইসলাম, জাহেদ আলী, মোতালেব ও সুফিয়া বেগম।