বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : বিদেশে পাড়ি জমালেই নিজেদের নিরাপদ মনে করছেন দুর্নীতিবাজরা। এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে। এটি বন্ধের উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। সংশোধন হতে যাচ্ছে ১৯৭৪ সালের প্রত্যর্পণ আইন। এ আইনে অন্যান্য বিভিন্ন অপরাধে অভিযুক্তদের দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয় উল্লেখ থাকলেও দুর্নীতির বিষয়টি নেই। তাই আইনটি সংশোধনের মাধ্যমে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আইনে থাকা দুর্নীতি ও অর্থ পাচার সম্পর্কিত বিষয়গুলো প্রত্যর্পণ আইনের তফসিলে যুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এভাবে আইনটি সংশোধন হলে বিদেশে চলে গেলেও দুর্নীতিবাজদের ফিরিয়ে আনতে সহজে পদক্ষেপ নিতে পারবে সরকার।
দুদকের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান যুগান্তরকে বলেন, প্রত্যর্পণ আইনের এ সংশোধনটি খুবই দরকার। বর্তমানে যে পদ্ধতি আছে তাতে দুর্নীতিবাজদের ফিরিয়ে আনতে অনেক লম্বা প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়। আইন সংশোধন হলে সহজে সেটা করা যাবে। তিনি বলেন, খুব কম দেশের সঙ্গে আমাদের প্রত্যর্পণ চুক্তি আছে। এ আইনে সব দেশের সঙ্গে সংযোগের ক্ষেত্র থাকা উচিত-যাতে যে কোনো দেশ থেকে দুর্নীতিবাজদের ফিরিয়ে আনা যায়।
দেশে অবৈধভাবে টাকা উপার্জন করে অনেক ক্ষমতাধর ব্যক্তি বিদেশে নিশ্চিন্তে চলছেন। তারা জানেন তাদের দেশে ফেরাতে সরকারের উদ্যোগ নেওয়ার আইনি ক্ষমতা সীমিত। এ সুযোগেই দুর্নীতিবাজদের বেগমপাড়া বা সেকেন্ড হোম গড়ে উঠছে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে। আর তাদের আলিশান বাড়ির ছবি ঘুরছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
৪৭ বছর আগে প্রণীত প্রত্যর্পণ আইন এ কারণেই সংশোধনের সুপারিশ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন। তারই আলোকে সম্প্রতি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে বৈঠক হয়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাসহ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, জননিরাপত্তা বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, আইন ও বিচার বিভাগ, লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের প্রতিনিধিরা সেখানে ছিলেন। বৈঠকে দুদকের প্রস্তাবিত সংশোধনের বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। প্রত্যর্পণ আইনটি প্রণয়ন হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে। তাই এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ সংশোধনের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবে।
এ কাজে যুক্ত এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, আইনটির ছোট পরিবর্তন আনা হচ্ছে। কিন্তু এর প্রভাব অনেক বড় হবে। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, অনেক বড় বড় নেতা, সরকারি কর্মকর্তা ও আর্থিক খাতের ব্যক্তি আইনি দুর্বলতার কারণে বিদেশে পাড়ি জমিয়ে নিজেদের নিরাপদ করে তোলেন। এ কারণে অন্য দুর্নীতিবাজও দুর্নীতি করে বিদেশে পাড়ি জমানোয় উৎসাহ পান। সরকার চায় এ ধারাটা ভেঙে দিতে। তাই আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
দুর্নীতি দমন কমিশন তাদের যুক্তি তুলে ধরে বলেছে, ১৯৭৪ সালের প্রত্যর্পণ আইনের তফসিলে ‘দুর্নীতি’ বা ২০০৪ সালের দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের তফসিলভুক্ত অপরাধগুলোর সংযুক্তি নেই। কিছু নাগরিক দেশে দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল অঙ্কের অবৈধ অর্থবিত্ত সংগ্রহ করছে। এসব অর্থের বেশিরভাগই বাইরে পাচার হচ্ছে। এ কারণে সম্প্রতি টাকা পাচারের প্রবণতা বেড়ে গেছে। দেশের আর্থসামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার প্রয়োজনে এসব বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। সুনির্দিষ্টভাবে সংশ্লিষ্ট ঘটনা দ্রুত উদ্ঘাটন, অনুসন্ধান তদন্তের মাধ্যমে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। এর মাধ্যমে বিদেশ থেকে অবৈধভবে চলে যাওয়া অর্থ-সম্পদ ফেরত আনা দরকার। একইসঙ্গে সংশ্লিষ্ট অপরাধীদেরকেও দেশে ফেরত আনার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
আইন সংশোধনসংক্রান্ত বৈঠকে সভাপতিত্ব করেছেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (জেলা ও মাঠ প্রশাসন) জিল্লুর রহমান চৌধুরী। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি যুগান্তরকে বলেন, আইন সংশোধন একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। এ আইনটির ছোট্ট একটি সংশোধনের প্রস্তাব দুর্নীতি দমন কমিশন থেকে এসেছিল। তার পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে বৈঠক হয়েছে। এতে আইন সংশোধনের নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। এটি বাস্তবায়নের আগে আরও অনেক ধরনের যাছাই-বাছাই হবে।’
এক প্রশ্নের উত্তরে জিল্লুর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘আইন সংশোধন হলে কতটা কী হবে সেটা সময়ের ওপর নির্ভর করবে। সরকার আপাতত মনে করছে আইনটি সংশোধন করলে দুর্নীতি প্রতিরোধে ভালো ভূমিকা রাখবে। বাস্তবে সেটা কতটুকু কার্যকর হবে সেটা আইন সংশোধন হলে বলা যাবে।’ বৈঠকে দুদকের প্রস্তাব অনুযায়ী আইনের তফসিলে দুর্নীতি বা ২০০৪ সালের দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের তফসিলভুক্ত সব অপরাধ অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষে সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে জাতিসংঘের প্রণীত বিধি-বিধানের সঙ্গে যাতে সাংঘর্ষিক কিছু না থাকে সে বিষয়ে সতর্ক থাকার জন্য জননিরাপত্তা বিভাগকে বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, জাতিসংঘের প্রচলিত কী কী বিধান আছে তা যাচাই-বাছাই করে আইনে যুক্ত করতে হবে-যাতে আইন সংশোধনের পর এ বিষয়ে কোনো প্রশ্ন না উঠে।
এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, এটা তো খুব ভালো উদ্যোগ। আমি মনে করি, এ সংশোধন হওয়া উচিত। যারা অর্থ পাচার করে বিদেশে চলে যান তাদেরকে কোথাও জবাবদিহি করতে হয় না। এমন সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসার জন্য আইনের সংশোধন গুরুত্বপূর্ণ। একইসঙ্গে সংশোধনের পর আইনটি সঠিকভাবে প্রয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে।