নিজস্ব প্রতিনিধি : চরে মাসকালাই চাষি শমছের আলী, মৎস্যজীবি রমজান মিয়া, খেয়া ঘাটের মাঝি আলম হোসেন, সবজি চাষি নজরুল ইসলাম, গৃহিনী ময়না খাতুন, চম্পা বেগম, আমেনা খাতুনের মতো আরও অনেকের চোখে মুখেই হাসির ঝিলিক। চরের বালির রোদ্রতপ্ত বালুর উপর দিয়ে হাটতে থাকা স্কুল শিক্ষার্থী সাবিনা খাতুন, সুচন্দা, বেলী, সাগর, রফিক, রাতুলসহ অনেকেই খুশিতে আত্মহারা। তারা বিদ্যুৎ পাবে। আলো জ্বলবে। ঘরে টিভি দেখবে। ফ্রিজের ঠান্ডা পানি পান করবে। আরও কত কি সখের বায়নার কথা।
পাবনার নগরবাড়ি যমুনা নদীর ওপারেই পুরানভারেঙ্গা ইউনিয়নের একটি অংশ। চরসিংহাসন গ্রামের নাম। চারিদিকে শুধু চর আর চর। যমুনা নদীর জেগে ওঠা চরেই আবাদ হচ্ছে চরে মাসকালাইসহ নানা ফসল। নদীর দুধারে কাশবনের হাতছানি।
পাবনা জেলার জলরাশির সীমনা ক্ষেত্রে যমুনা নদী ভাগ করেছে এপার ওপার। একপাড়ে গড়ে উঠেছে নগরবাড়ি নৌবন্দরের মতো একটি সমৃদ্ধ জনপদ। অপরপাড়ে শুধুই ধু ধু চর। নেই সমৃদ্ধির ছিঁটেফোটা। উন্নয়ন হাতছানি দিয়ে ডাকলেও লাগেনি তার ছোঁয়া। যমুনার ভাঙ্গাগড়ার সাথে খেলা হয় সেখানকার মানুষের ভাগ্যের। বরাবরই উন্নয়ন বঞ্চিত চরের মানুষ। তাই পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠির তালিকা থেকে বের হতে পারে না তারা। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষার মতো মৌলিক অধিকারগুলো এখনও তাদের কাছে স্বপ্নের মতোই মনে হয়।
তবে সেই চরে এবার অন্ধকার ঘুচে ফুটবে আলো। বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত হবে চরের জীবন। বাড়বে ফসল উৎপাদন আর শিক্ষার হার এমনটাই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। আর্থ সামাজিক উন্নয়নে আমুল পরিবর্তন ঘটবে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধির পাশাপাশি চরবাসি।
জানা যায়, পাবনার দুইটি সংসদীয় আসন এবং মানিকগঞ্জের ১ টি ও রাজবাড়ি জেলার চরাঞ্চলের ৯টি ইউনিয়নের ৭০টি গ্রামকে নিয়ে আসা হচ্ছে বিদ্যুতের আওতায়। ইতিমধ্যে কাজ শুরু হয়েছে। সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে যমুনা নদীর তলদেশ দিয়ে সাবমেরিন লাইন নির্মাণকাজ চলছে দ্রুতগতিতে। চলছে নদী ড্রেজিং। নভেম্বরের শেষ নাগাদ কাজ শেষ হওয়ার আশা করছেন বিদ্যুৎ বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকতারা।
প্রকল্প সুত্রে জানা গেছে, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) ও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণ করা হচ্ছে ২৮৫ কিলোমিটার অফগ্রিড বৈদ্যুতিক লাইন। যার আনুমানিক ব্যয় ধরা হয়েছে ৫০ কোটি টাকা। প্রকল্পের মধ্যে সাবস্টেশন রয়েছে একটি (১০ এমভিএ)। সাবমেরিন ক্যাবল ৩৩ কেভি একটি ও ১১ কেভি ৩টি। আওতাভুক্ত উপজেলা ৫টি হলো পাবনার বেড়া, রাজবাড়ি জেলার সদর, গোয়ালন্দ, দৌলতদিয়া ও মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার একাংশ। ইউনিয়ন সংখ্যা ৯টি হচ্ছে; নতুন ভারেঙ্গা, পুরান ভারেঙ্গা, হাটুরিয়া-নাকালিয়া, আরুয়া, মিজানপুর, শিবালয়, তেওতা, বাঘুটিয়া ও বাচামারা। ৭০টি গ্রামের ১১ হাজার ২৭৬ জন মানুষ এ বৈদ্যুতিক সেবার আওতায় আসবেন। পাবনার কাশিনাথপুর ফায়ার সার্ভিসের পেছন থেকে মানিকগঞ্জের বাঘুটিয়া পর্যন্ত অফগ্রিড লাইন নির্মাণ করা হবে। এক বছর আগে শুরু হওয়ার এ কাজ শেষ হবে নভেম্বরের মধ্যে। সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর গ্রিড থেকে মূল লাইন এসে যুক্ত হবে এই লাইনে।
সম্প্রতি পাবনার বেড়া উপজেলার কল্যাণপুর চরে নির্মাণকাজ দেখতে যান পাবনা-২ আসনের সংসদ সদস্য আহমেদ ফিরোজ কবির। এ সময় তার সাথে ছিলেন পাবনা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২ এর জেনারেল ম্যানেজার প্রকৌশলী মো: এমদাদুল হক, সহকারি জেনারেল ম্যানেজার (কারিগরি) মনিরুল ইসলাম, এজিএম (সদস্য সেবা) আনোয়ার হোসেন, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মেজবাহ উল হক সহ অনেকে। সেখানে চরবাসীদের সাথে মতবিনিময় করে সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ড তুলে ধরেন। সেই সাথে কাজের অগ্রগগতি দেখে সন্তোষ প্রকাশ করেন সংসদ সদস্য আহমেদ ফিরোজ কবির।
সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পাবনা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২ এর জেনারেল ম্যানেজার প্রকৌশলী এমদাদুল হক বলেন, শাহজাদপুর গ্রিড থেকে আমরা প্রায় ৩০ কিলোমিটার ৩৩ কেভি লাইন ইতিমধ্যে নির্মাণ করেছি। যমুনা নদীর তলদেশ দিয়ে সাবমেরিন ক্যাবল যাবে ২ দশমিক ২ কিলোমিটার। এজন্য নদী খননকাজ চলছে। নদী খননকাজ করছে বিআইডব্লিউটিএ। খননকাজ শেষ করে তার লিংক করা, সাবস্টেশন চালু করে চর এলাকার সোয়া ১১ হাজার গ্রাহককে বিদ্যুৎ সংযোগ দিতে পারবো। আশা করছি আগামি নভেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ হবে।
সমিতির ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (কারিগরি) মনিরুল ইসলাম বলেন, যেহেতু নদীতে ড্রেজিং চলছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আমাদের কাজ শেষ করা হবে এবং মুজিব বর্ষের মধ্যেই চর আলোকিত হবে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ, সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) এর মাধ্যমে পাবনা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২ এ কাজ বাস্তবায়ন করছে।
সমিতির এজিএম (সদস্য সেবা) আনোয়ার হোসেন বলেন, এ বিদ্যুৎ সংযোগ নিতে মানুষ যাতে কোনো হয়রানীর শিকার না হয়, দালালের খপ্পরে না পড়েন, সেজন্য আমরা প্রচারণা চালাচ্ছি। লিফলেট বিতরণ করেছি। পাশাপাশি প্রতিটি এলাকায় উঠান বৈঠক ও মাইকিং করেছি। সবাইকে বলে দেয়া হয়েছে অফিসের নির্ধারিত ফি ৪৫০ টাকা দিয়ে বিদ্যুৎ সংযোগের আবেদন করার জন্য। এর বাইরে কাউকে কোনো টাকা না দিতে আহবান জানানো হয়েছে।
অন্ধকার চরে বিদ্যুৎ আসছে দেখে খুশি চরের মানুষ। কৃষক আবুল হোসেন, গৃহবধূ মনোয়ারা বেগম সহ অন্যরা বলেন, এতদিন অন্ধকারে ছিলেন তারা। এরপর সৌর বিদ্যুৎ আসলেও সবকিছু করা যাচ্ছে না। পল্লী বিদ্যুৎ আসলে খুব ভাল হবে। ছেলেমেয়ের লেখাপড়া, কৃষিকাজ থেকে শুরু করে সব উন্নয়নে বিদ্যুৎ ভূমিকা রাখবে। চরের জীবন পাল্টে যাবে। একাধিক শিক্ষার্থীরা অনুভূতিতে জানা যায়, অনেকেই কুপি বাতি বা হারিকেন জ্বালিয়ে পড়াশুনা করে। এতে তাদের পড়ালেখায় মনোনিবেশ করতে কিছুটা সমস্যা হয়। বিদ্যুৎ আসছে, আলো জ্বলবে, টিভি দেখতে পাবে ভেবেই তারা আনন্দিত।
কল্যাণপুর চরের আবু মিয়া, কালাম হোসেন, লোকমান হাকিমসহ বেশ কয়েকজন জানান, বিদ্যুৎ নেই জন্য গড়ে উঠেনি ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। নেই স্বাস্থ্য সেবার উন্নয়ন ব্যবস্থা। বিদ্যুৎ আসলে হয়তো এই আধার কেটে আমরাও শেখ হাসিনার উন্নয়নের সড়কে চলতে পারবো। তারা দীর্ঘদিন পর হলেও বিদ্যুৎ সেবা পাবেন বলেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্থানীয় সংসদ সদস্য আহমেদ ফিরোজ কবিরের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
আর পাবনা-২ আসনের সাংসদ আহমেদ ফিরোজ কবির বলেন, আলো জ্বলবে চরের সোয়া এগারো হাজার পরিবারে , চরাঞ্চলের একটি বড় অংশ বিদ্যুৎ থেকে বিচ্ছিন্ন। প্রধানমন্ত্রীর উন্নয়ন দর্শন যে পিছিয়ে পড়া সব শ্রেণির মানুষকে এগিয়ে নেয়া, সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নে এই বিদ্যুৎ লাইন নির্মাণ একটি উন্নয়ন কাজ। বিদ্যুৎ সরবরাহের মাধ্যমে পাবনা, মানিকগঞ্জ ও রাজবাড়ির চরাঞ্চলের মানুষের আর্থ সামাজিক জীবনমান উন্নয়নে আমুল পরিবর্তন ঘটবে। বিশেষ করে কৃষি সেক্টরে ব্যাপক উন্নয়ন ঘটবে। এতে উৎপাদন খরচ কমে চরের মানুষ উৎপাদনে উৎসাহি হবে।