রূপকল্পের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ এখন দৃশ্যমান ও বাস্তব

বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নতুন সরকার যখন দায়িত্ব নেয়, তখন তার মূল লক্ষ্য ছিল “ডিজিটাল বাংলাদেশ” অর্জন। গত বারো বছরে সে অর্জন অনেকাংশেই সফল এ কথা খুব স্পষ্টভাবে বলা যায়, কারণ রূপকল্পের ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন দৃশ্যমান ও বাস্তব রূপ নিয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ প্রযুক্তি ব্যবহারের সুবিধা পাচ্ছে ও সরকার তথ্য-প্রযুক্তি খাতের উন্নয়নে বেশ কিছু নতুন পদক্ষেপ নিয়েছে।

আমরা জানি যে প্রযুক্তি সেবা সম্প্রসারণে কম্পিউটার, ইন্টারনেট ও যন্ত্রপাতির দৃশ্যমান অবস্থান উন্নয়ন রূপান্তরে সফল হতে সাহায্য করে। প্রকৃত অর্থে, ডিজিটাল বাংলাদেশ একটি ‘রূপকল্প’ যা দেশের মানুষকে চিরাচরিত আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দারিদ্র্য-অবস্থা থেকে উন্নততর অবস্থায় নিয়ে যেতে সমর্থ একটি রূপান্তর বাস্তবতা। দেশের সার্বিক উন্নয়নের সাথে এই দর্শন মিলিয়ে না দেখলে আমরা ভুল করবো এই ভেবে যে, দেশে যত বেশি মানুষ কম্পিউটার ব্যবহার করে বা যত বেশি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে আমরা ততবেশি উন্নত হয়েছি ও ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়ন হয়েছে। এই ধারণা অংশত ঠিক মাত্র, কারণ শুধুমাত্র পরিসংখ্যান সূচক দিয়ে বাংলাদেশের মতো একটি দেশের এক দশকের গুণগত উন্নয়নের মান বিবেচনা করা সম্ভব নয়, এই সূচক বার্ষিক উন্নয়নের অগ্রগতি পরিমাপের জন্যে প্রয়োজনীয় কিন্তু সার্বিক উন্নয়ন চিত্রকে প্রভাবের পরিমাপে সংকুচিত ফলাফল দেবে।

বর্তমান সরকার চলমান উন্নয়নের অংশ হিসেবে তথ্য-প্রযুক্তির সর্বোচ্চ সেবা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে যে অঙ্গীকার করেছে তার সুফল বাংলাদেশের মানুষ কোন কোন ক্ষেত্রে পাচ্ছে তার তালিকা দীর্ঘ। কিন্তু আমরা যদি এইভাবে বিবেচনা করি, দেশের মানুষ গতানুগতিকতার কোন পরিবর্তন দেখছে কী না তাহলে তার উত্তর নিশ্চয়ই ইতিবাচক হবে। মানুষ দেখছে তার মধ্যে কারিগরি বা প্রযুক্তি চিন্তা ও আগের তুলনায় প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে। যেমন মোবাইল ফোনের সংখ্যাগত ব্যবহার বেড়েছে কিন্তু এর কারিগরি ও সামাজিক প্রভাবের জ্ঞান অনুধাবনে মানুষ কতোটা আধুনিকতার পরিচয় দিতে পারছে। আর এটাই গুরুত্বপূর্ণ। ইন্টারনেট ব্যবহার করছে মানুষ কিন্তু তার প্রয়োজনীয়তা বা গুরুত্ব সে অনুধাবন করছে কী না। ট্রেনের-বাসের টিকেট বা এই মুহূর্তের খবর পেতে বা ছেলেমেয়েদের পরীক্ষার খবর পেতে বা ডাক্তারের কাছে যেতে- দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের মানুষ ইন্টারনেটের উপর প্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।

এটা কেমন করে সম্ভব হলো? এর ইতিবাচক দিক হলো দারিদ্র্য মোড়ানো এই পোড়া কপালের দেশে সস্তায় বা আয়ত্তের দামে সে এই প্রযুক্তিকে ব্যবহার করতে পারছে। আর সরকারের কৃতিত্ব হলো, নানারকম সুফল কাজের পরিবেশ তৈরি করে জনগণের ক্রয় ক্ষমতা বাড়াতে বা প্রযুক্তির সেবা নিজের সামর্থ্যের মধ্যে নিয়ে আসতে করনীয়গুলো যথাসম্ভব সে করে দিয়েছে। না হলে আমাদের প্রায় শতভাগ মানুষ মোবাইল ফোন ব্যবহার করছে কেমন করে? এ তো আর ফ্রি পাওয়া যায় না। দেশের প্রায় অর্ধেক মানুষ এখন নিয়মিত ইন্টারনেট ব্যবহার করে। আর অপরদিকে মানুষের আর্থিক সামর্থ্য বেড়েছে, আয়ের পথ বেড়েছে, শ্রমশক্তির একটি বড়ো অংশ জ্ঞান সমাজের দীক্ষায় ব্রত। স্কুলগুলোতে তথ্য-প্রযুক্তি শিক্ষা ও পাঠদানে এর ব্যবহার বৈচিত্র্য এখন অনেক আধুনিক। কিছু ক্ষেত্রে প্রান্তিক পর্যায়ে প্রযুক্তি বিকাশের ঘাটতি থাকলেও এই আলোচনাও করা যেতে পারে, সব কিছু পূর্ণ হলে বাংলাদেশ এখন কোথায় পৌঁছে যেতে পারতো!

বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়ে এখন ৭২.৮ হয়েছে যা অনেক উন্নত দেশের মানুষের গড় আয়ুর কাছাকাছি। মাথাপিছু আয় বেড়েছে, চিন্তার প্রকৃতি বহুমুখী হয়ে জ্ঞান বিকাশের কার্যকরী মগ্নতাও বেড়েছে আর এ সবকিছু একটি পশ্চাৎপদ দেশের অগ্রসরকামী প্রতিশ্রুতি থাকার ফলেই সম্ভব হয়েছে। গ্রামে-গঞ্জে শিক্ষার অন্তর্ভুক্তি ও সমাপ্তির হার বেড়েছে এ কথা না বলে যদি আমরা বলি প্রাপ্ত শিক্ষার ব্যবহার বেড়েছে তাহলে যে চিত্র সামনে আসে তা হলো মানুষের চোখেমুখে প্রত্যাশিত কাজের স্বপ্ন বা আকাঙ্ক্ষা বেড়েছে আর সে আকাঙ্ক্ষা সামনে এগিয়ে যাবার চেষ্টা আর এটাই ডিজিটাল বাংলাদেশের বাস্তবতা। না হলে এই দেশে গ্রামে-গঞ্জে দিনে শত কোটি টাকার লেনদেন হয় মোবাইল ফোনের মাধ্যমে, সাধারণ মানুষ এই সেবা গ্রহণ করলো কেন? দূর প্রান্তের কোন স্কুলের প্রধান শিক্ষক তার স্কুলের জন্যে প্রযোজ্য বিজ্ঞপ্তি এখন এক লহমায় ইন্টারনেটে দেখে নিচ্ছে, এর প্রকৃত উৎপাদনশীলতার হিসাব কষলে দেখা যাবে মানুষ জ্ঞান সুবিধার ব্যবহারে অন্য অনেক সময়ের চেয়ে এখন অনেক গুণে বেশি তৎপর ও সাশ্রয়ী।

স্বাস্থ্য ব্যবস্থার যে খারাপ চিত্র দেখে আমরা অভ্যস্ত এখন সেখানে আমরা দেখছি তার ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে চিকিৎসার গুণগত মানে। চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত শ্রমশক্তির একটি বড়ো অংশ এখন প্রশিক্ষিত ও ডিজিটাল সুবিধার নিয়মিত ব্যবহারকারী। ফলে যে কোন জটিল চিকিৎসাজনিত সিদ্ধান্ত নিতে ইন্টারনেট কাজে লাগছে। অনেক স্বাস্থ্যকর্মীও এখন দ্রুত একটি পরামর্শ পেতে বা স্বাস্থ্য তথ্য পেতে মোবাইল ফোন ব্যবহার করছে। গ্রামের একজন সাধারণ মানুষ এর ফলে নিজের স্বাস্থ্য উন্নয়নের জন্যে সঠিক তথ্য পাচ্ছে।

যখন কোন পশ্চাৎপদ দেশে উন্নয়নের অঙ্গীকার বাস্তব রূপ নয় তখন সমাজের উপরের দিকে কাঠামোগত রূপান্তরের দিক আমাদের চোখে পড়ে বেশি। কিন্তু সে দেশের মানুষের ভেতরের পরিবর্তন বা মনোজগতের উন্নয়ন সংঘটিত হয় নীরবে। ফিলিপাইন ও মালয়েশিয়ার বেলায় বিশেষ করে এমনটি ঘটেছিল। নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ে মাহাথীর মোহাম্মদ যখন পুত্রজায়া প্রস্তুত করলেন আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তিসমৃদ্ধ একটি মডেল শহর হিসেবে তখন বাইরের বিশ্বও এর ভেতরের দর্শন বুঝে উঠতে সময় নিয়েছিল। নানা রকম আলোচনা বা মিডিয়া অনেকদিন ধরে শুধু সেখানকার অবকাঠামো, নতুন বিন্যাসে সাজানো এক টুকরো ছবির মতো শহরের আধুনিকতা কতো বিচিত্র হ’তে পারে তা নিয়েই ব্যস্ত ছিল। কিন্তু কিছুদিন পরে দেখা গেলো মালয়েশিয়ার জনগণ নিজেদের ভেতরে এর পরিবর্তন অনুভব করতে শুরু করলেন। দারিদ্র্য পীড়িত সেই দেশ মাত্র ২১ বছরে পৃথিবীর অন্যতম এক উন্নয়ন মডেলের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেল।

বিদেশের বিনিয়োগ বাড়লো। নামী দামী দেশের কোম্পানিগুলো এসে তাদের কারখানা খুলে বসলো কারণ আত্মবিশ্বাসী মালয় নাগরিকেরা ইতোমধ্যে প্রযুক্তি বান্ধব হয়ে উঠতে পেরেছে ও নাগরিকের সে সংগঠন শক্তির কারণে বিশ্ব ব্যাঙ্কও সেখানে কাজ করতে হিমশিম খেয়েছে কারণ যা খুশি তা চাপিয়ে দেয়া সে দেশে সম্ভব ছিল না। ফিলিপাইনের উন্নয়নেও তথ্য-প্রযুক্তি এক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম-ভূমিকা রাখতে সমর্থ হয় কোরাজন অ্যাকুইনো-র আমলে। সে দেশের প্রযুক্তি চেষ্টায় কৃষি গবেষণা থেকে টেলিকমিউনিকেশন (টেক্সট মেসেজের জনপ্রিয়তা বেড়েছে সেখানেই), স্বাস্থ্য উন্নয়নের নানারকম উদ্ভাবনী উদ্যোগ বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত। আর এ সব কর্মকাণ্ডই ফিলিপাইনের জন-মানসে এনে দিয়েছে এক অপূর্ব আত্মশক্তি যা কোরাজন অ্যাকুইনো সঠিকভাবে সংগঠিত ও দেশের উন্নয়নে ব্যবহার করতে সমর্থ হয়েছিলেন।

প্রযুক্তির কার্যকর ভূমিকা জনমানসে একটি মোক্ষলাভের উপায় হিসেবে কাজ করে। একই সাথে দৃশ্যমান উন্নয়নের ফলে জনগণের চিন্তা ও ভাবজগতে একটি উপায়লাভ দর্শনের জন্ম দেয়। যিনি এই কাজের একক বা সামষ্টিক নেতৃত্ব দেন তাঁর জন্যে তখন অগ্রসর চিন্তা নিয়ে জনগণকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সংগঠিত করা সহজ হয়। বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশেষ করে গত বারো বছরের ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ শাসনামলে এই মানবিক আত্মশক্তি দর্শনেরই জন্ম দিয়েছেন যার ফলে দেশের মানুষ এখন তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহারকে মুক্তির উপায় হিসেবে বিবেচনা করছে। দেশে তরুণ শ্রমশক্তির একটি বড়ো অংশ প্রযুক্তিখাতে নিজের মেধা ও ভাবলোক বিনিয়োগ করছেন যার ফলে প্রচুর উদ্ভাবনী চিন্তার ও কাজের সম্প্রসারণ ঘটছে।

ভেতরের কাঠামোতে তাই এক আশ্চর্য মানবিক মূল্যবোধ জন্ম নিতে শুরু করেছে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখন দেশের সীমান্ত খুলে দিতে চাইলেন তখন বর্ডার গার্ড, কূটনীতিক বা সাধারণ মানুষ কোন পর্যায় থেকেই কোন আপত্তি আসেনি কারণ এই দেশের মানুষ এখন এক মানবিক দেশের নাগরিক হয়ে উঠেছে। আর তা সম্ভব হয়েছে বর্তমান প্রধান নেতৃত্বের অনুপ্রেরণাশক্তির কারণেই। দেশের মানুষ যখন দেখে খোদ জাতিসংঘের মহাসচিব বিশ্ব ব্যাঙ্কের প্রেসিডেন্টকে পাশে রেখে, বাংলাদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে রোহিঙ্গাদের জন্যে বিশ্ববাসীর কাছে সহযোগিতা চাইছেন তখন সকলের মনেই এই প্রত্যয় জন্মে যে, ডিজিটাল বাংলাদেশের নেতৃত্ব সঠিক পথেই চলছে। এই ইতিবাচক উৎসাহ জনগণকে একটি নতুন ভাবাদর্শ নির্মাণের স্বপ্ন উপহার দেয় আর তা হল ‘মানবিক বাংলাদেশ’ যে বাংলাদেশ এখন বিশ্ব মানবতার প্রতীক হয়েছে।

আমরা দিব্য চোখে দেখতে পাচ্ছি এক সাহসিনী নারীর নেতৃত্বে ডিজিটাল বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে যে বাংলাদেশ আমরা নির্মাণ করতে যাচ্ছি তা মানবিক শাসন ও মূল্যবোধের। দুনিয়ার সবাই এখন বাংলাদেশকে চেনে মানবতাবাদী অসাম্প্রদায়িক দেশ হিসেবে যে দেশ একদিন খেঁটে খাওয়া স্বল্পাহারী কৃষক-শ্রমিকের সম্মিলিত সশস্ত্র যুদ্ধে স্বাধীনতা লাভ করেছিল আর সে দেশ এখন নিজের চেষ্টায় স্বাবলম্বী, প্রত্যয়ী ও প্রযুক্তি-বান্ধব মানবিক ভাবাদর্শ অর্জন করে নিয়েছে।

রূপকল্পের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ এখন দৃশ্যমান ও বাস্তব
Comments (0)
Add Comment