সমুদ্র হক ॥ প্রজন্মের তরুণদের ভিড় প্রমাণ করে দিয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী জানার কৌতূহল তাদের কতটা। প্রবীণ ও মধ্যবয়সীদের অনেকে জানেন না ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু জেলের ভেতরে থেকে কিভাবে নেতৃত্ব দিয়ে আন্দোলনকে সফল পরিণতির দিকে টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর পাকিস্তানীরা শোষণ শুরু করেছিল। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে চেয়েছিল। এসবের প্রতিবাদে সেদিনের তরুণ শেখ মুজির কিভাবে রুখে দাঁড়িয়ে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এই বিষয়গুলোর বিস্তারিত তুলে আনা হয়েছে ‘চিরঞ্জীব মুজিব’ চলচ্চিত্রে। ২ ঘণ্টা ১৪ মিনিটের পূর্ণদৈর্ঘ্য এই ছবি দেখতে তরুণ মধ্যবয়সী ও প্রবীণদের ভিড় ছিল লক্ষ্য করার মতো। বগুড়ার মধুবন সিনেপ্লেক্সে ছবিটি মুক্তি পেয়েছে শুক্রবার। দু’দিন আগেই প্রতিটি শোর টিকেট বিক্রি হয়েছে আগাম।
মধুবন সিনেপ্লেক্স কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, ছবিটির বেশিরভাগ দর্শক তরুণ। অগ্রিম টিকেট নেয়া দেখে বোঝা যায় জতির পিতাকে নিয়ে তাদের জানার আগ্রহ কতটা। ছবির পোস্টারে লেখা আছে- শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী অবলম্বনে নির্মিত এই ছবি। ক’জন তরুণ বললেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জীবনী, ’৬৯-এর গণআন্দোলন, ৭ মার্চের ভাষণ মুক্তিযুদ্ধ বিজয় অর্জনের ইতিহাস তারা জেনেছে। অসমাপ্ত আত্মজীবনী জানার আগ্রহ নিয়ে তারা ছবিটি দেখছে। ছবি দেখার পর প্রতিক্রিয়ায় তারা বলল-মহান একুশের ভাষা আন্দোলনে সালাম রফিক জব্বার বরকতসহ কজনের নাম তারা জানে। কিভাবে এই আন্দোলন গড়ে উঠল, কে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তা এতকাল অজানাই ছিল। ছবিটি দেখে তারা জানতে পেরেছে বঙ্গবন্ধু কারাগারে থেকে কিভাবে ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ছবি দেখার পর কজন তরুণ প্রতিক্রিয়ায় বললেন শেখ মুজিবুর রহমানের সম্মানিত নাম বঙ্গবন্ধু তারা জানেন। জাতির পিতা মুক্তিযুদ্ধের ডাক দিয়ে দেশকে বিজয় এনে দিয়েছেন তা ইতিহাসের পাতার আছে। তিনি কিভাবে মহান নেতা হয়ে উঠলেন তা স্পষ্ট বোঝা যায় এই ছবি দেখে।
ছবিতে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন দীর্ঘাঙ্গী ও ভরাট কণ্ঠের অভিনেতা আহমেদ রুবেল। ক’জন মধ্যবয়সী বললেন, ছবিতে তিনি যখন হাঁটেন ও ফুলহাতা গেঞ্জি গায়ে শুয়ে থেকে বই পড়েন তখন মনে হয় সত্যিই মুজিবকে দেখছেন। তার সহধর্মিণী বেগম ফজিলতুন নেছা মুজিবের ডাক নাম রেণু তাও জানলেন এই ছবি দেখে। আন্দোলনে তার যে আত্মত্যাগ ছবিতে তা ফুটিয়ে তুলেছেন দিলারা হানিফ পূর্ণিমা। ১৯৪৯ সালে শেখ মুজিব কলকাতা থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ফেরার পর সেদিনের সংলাপ সেদিনের ঘটনাগুলো এমনভাবে চিত্রায়িত হয়েছে মনে হবে প্রায় ৭২ বছর আগের দিনে ফিরে গেছে দর্শক। ছবিতে ঘটনার ক্রম ১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এই তিন বছরে বঙ্গবন্ধুর বেশিরভাগ সময় ছিলেন জেলবন্দী। পাকিস্তানী শাসকরা তাকে এতটাই ভয় পেত এক মামলার জামিন হলে তখনই আরেক মামলায় গ্রেফতার। জেল থেকে বের হতে দেয়া হয়েছে কম। যখন কিছুদিন মুক্ত থাকতেন তখন বড় মেয়ে শেখ হাসিনা ও ছেলে শেখ কামালকে নিয়ে ফসলের মাঠে যেতেন। ছবির এক দৃশ্যে আছে-বঙ্গবন্ধু জেল থেকে ছাড়া পেয়ে বাড়ি এসেছেন। বড় মেয়ে (শেখ হাসিনা) বাবাকে চিনে কাছে এসেছেন। ছেলে (শেখ কামাল) একটা দূরে। বঙ্গবন্ধুর সংলাপ ‘ছেলে বোধ হয় আমাকে চিনতে পারেনি। মনে করেছে কোন লোক এলো।’
কারাগারে অসাম্প্রদায়িক চেতনার এক বন্দী অসুস্থ হওয়ার পর হাসপাতালে অপারেশনের জন্য নেয়ার সময় শেখ মুজিবকে দেখার অনুরোধ জানালে জেল সুপার ইশারায় মুজিবকে ডেকে আনতে বলেন। মুজিব কাছে এলে বন্দীর কথপোকথন ছিল আন্দোলনের আবেগের। এই দৃশ্যে জেল সুপারের অভিনয় ছিল অসাধারণ। তার সংলাপ ছিল না। সাইন ল্যাঙ্গুয়েজে ও বডি ল্যাঙ্গুয়েজে তিনি বুঝিয়েছেন মুজিবের পক্ষে তিনি আছেন। শেখ মুজিব কারাগারের থেকে কিভাবে পাকিস্তানীদের রক্তচক্ষু উপক্ষো করে শোষণের বিরুদ্ধে ও ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন ছবিতে তা তুলে ধরা হয়েছে ধারাবাহিকভাবে। শেখ মুজিবকে কখনও খুলনা কখনও ফরিদপুর কারাগারে নেয়া হয়। মামলার তারিখ পড়ার সময় বিভিন্ন স্থানে নেয়া হয়। কারাগারে তিনি যেন আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে না পারেন এ জন্য আলাদা করা হয়। মহান ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বের এক পর্যায়ে শেখ মুজিব কারাগারে অনশন শুরু করলে অন্য কারাগারে নেয়া হয়। সেখানেও অনশন শুরু করলে জীবন যখন সঙ্কটাপন্ন মৃত্যু শয্যায় তখন জেল সুপার ওপর মহলে রেডিওগ্রাম টেলিগ্রাম পাঠিয়ে ওই সময়ের ঘটনা তুলে ধরেছেন। এক পর্যায়ে পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুর দাবি মেনে নিয়ে তাকে মুক্ত করে দেন। ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ বঙ্গবন্ধু মুক্তি পান। চিরঞ্জীব মুজিব ছবির এটিই শেষ দৃশ্য।
শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা নিবেদিত শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী অবলম্বনে নির্মিত ছবির পান্ডুলিপি সংলাপ ও পরিচালনা করেছেন প্রধানমন্ত্রীর স্পিচ রাইটার নজরুল ইসলাম। তিনি জানান, ছবির সংলাপ সংশোধন পরিমার্জন করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বগুড়ায় প্রথম ছবিটি মুক্তি দেয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সব জেলায় ছবিটি মুক্তি পাবে। স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীদের ছবিটি দেখানোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। যাতে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী তারা জানতে পারে। ছবির সৃজনশীল চিত্রনাট্য ও পরিচালক জুয়েল মাহমুদ। চিত্রগ্রহণ করেছেন সাহিল রনি। একটি দৃশ্যে দিনের বেলায় ফিল্টারে বিশেষ ব্যবস্থায় রাতের দৃশ্য ফোটাতে যেয়ে আকাশের সূর্যকে চাঁদ বলে দেখানোর চেষ্টা হয়েছে। যা না করলেও চলত। মনিরুল ইসলামের সম্পাদনায় সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন ইমন সাহা। ছবিতে বঙ্গবন্ধুর বাবা ও মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন যথাক্রমে খায়রুল আলম সবুজ ও দিলারা জামান। ইংরেজী বছরের শেষ দিনে ছবিটি তরুণদের হৃদয়ে ঠাঁই পেয়েছে। চেতনায় এই রেশ তারা ধরে রাখবে আগামী দিনগুলোতে।