বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : পৃথিবীর চার ভাগের এক ভাগ স্থল। আর তিন ভাগই বিস্তীর্ণ সুনীল পানিরাশি। একে ঘিরে বা ‘নীল অর্থনীতি’ নিয়ন্ত্রণ করে লাভবান হওয়ার প্রতিযোগিতা চলছে দেশে দেশে। ‘নীল অর্থনীতি’র অন্যতম প্রধান দিক সমুদ্রবন্দর ও শিপিং বাণিজ্য। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশও ধাপে ধাপে এগিয়ে চলেছে। যদিও আরো কূন্যতা পূরণের সুযোগ-সম্ভাবনা হাতছানি দিচ্ছে। সদ্যসমাপ্ত ২০২১ ইং পঞ্জিকা সালে দেশের প্রধান চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ৩২ লাখ এক হাজার ৫৪৮ টিইইউএস কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ে রেকর্ড করেছে। বন্দরের দক্ষতা, সক্ষমতার সব সূচক এখন ঊর্ধ্বমুখী। চট্টগ্রাম বন্দরে প্রবৃদ্ধির সমানতালে করোনার বাধা ডিঙিয়ে বাংলাদেশের পতাকাবাহী ফিডার জাহাজের সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
করোনাকালে গেল দুই বছরে দেশের সমুদ্রগামী জাহাজবহরে আরো ৩২টি জাহাজ যুক্ত হয়েছে দেশীয় উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগে। এই খাতে নতুন বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা। এরফলে আগের ৪৮টিসহ ফিডার জাহাজের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৮০টি। এতে মোট বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা। তবে জাহাজের সংখ্যা কম থাকায় আগে এই শিপিং বাণিজ্যে মাত্র ৮ থেকে ১০ শতাংশ পরিবহন করতে পারত দেশীয় সমুদ্রগামী জাহাজ। বর্তমানে প্রায় ২৫ শতাংশ ধরতে পারে দেশীয় জাহাজবহর। তবে তা যথেষ্ট নয়।
পোর্ট-শিপিং সার্কেলে জানা গেছে, জাহাজযোগে আমদানি-রফতানি পণ্যসামগ্রী পরিবহন বাবদ প্রতিবছর বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী-শিল্পোদ্যোক্তাদের প্রায় ৭৬ হাজার কোটি টাকা ভাড়া বা ফ্র্রেইট চার্জ গুণতে হচ্ছে। পৌনে এক লাখ কোটি টাকার এই বাজার ধরে চাহিদা পূরণ করতে হলে আরো ৭৫ শতাংশ বিনিয়োগের সুবর্ণ সুযোগ রয়ে গেছে। যা নিশ্চিত লাভজনক খাত।
এ প্রসঙ্গে নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহ্মুদ চৌধুরী এমপি গতকাল দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, দেশের অর্থনীতিকে আরো এগিয়ে নেয়া এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পরিচালনায় সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সময়ের প্রয়োজনে নতুন নতুন জাহাজ বাণিজ্যিক জাহাজবহরে যুক্ত হচ্ছে। বড় বড় জাহাজও সংগ্রহ করা হচ্ছে। এরজন্য সরকার ব্যবসা-বাণিজ্য বান্ধব সুযোগ-সুবিধা প্রদান করছে। ২৪ ঘণ্টা সচল চট্টগ্রাম বন্দর ইতোমধ্যে কার্গো, কন্টেইনার ও জাহাজ হ্যান্ডলিংয়ে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। সবক’টি সূচকে বন্দর এগিয়ে গেছে। চট্টগ্রাম বন্দরের পাশাপাশি মংলা বন্দরেও যাতে বড় বড় জাহাজ হ্যান্ডলিং করা যায় এরজন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বে-টার্মিনাল প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজ চলছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিক-নির্দেশনা অনুসারে দেশের জনগণের স্বার্থে সরকার সমন্বিত উন্নয়ন পরিকল্পনা নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে।
বর্তমানে প্রধানত বড় বড় শিল্প মালিকগণ ফ্রেইট চার্জের সাশ্রয় ও হরেক ঝামেলা এড়াতে নিজেদের প্রয়োজনে নিজেরাই সমুদ্রগামী জাহাজ সংগ্রহ ও পরিচালনা করছেন। নিজেদের শিল্প কাঁচামাল ও উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী নিজস্ব জাহাজে তারা পরিবহন করছেন। অনেকে জাহাজবহরের বাড়তি সুবিধা কাজে লাগিয়ে আগ্রহী ব্যবসায়ীদের ফ্রেইটে দিচ্ছেন। আইন-বিধিগত সুরক্ষা, কর সুবিধা, বর্ধিত ফ্রেইট চার্জের সুবাদে সমুদ্রগামী জাহাজ খাতে বিনিয়োগে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন নতুন উদ্যোক্তারা। গার্মেন্টস খাতসহ দেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে যে বিপুল পরিমাণ ভাড়া বা ফ্রেইট পণ্য পরিবহনকারী বিদেশি শিপিং ব্যবসায়ীরা আয়ত্ত করে নিচ্ছেন সেই বিশাল বাজারের সিংহভাগ এখন পর্যন্ত অধরা রয়ে গেছে।
বাংলাদেশ সমুদ্রগামী জাহাজ মালিক সমিতি (বিওজিএসওএ) সূত্র জানায়, বর্তমানে সমুদ্রগামী জাহাজ ক্রয় বা সংগ্রহ ও পরিচালনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন কারণে অনুকূল অবস্থা বিরাজ করছে। সরকার বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ প্রটেকশন (সুরক্ষা) আইন-২০১৯ প্রণয়ন ও কার্যকর করেছে। সেই সঙ্গে ভ্যাট অব্যাহতির সুবিধা, দেশের সমুদ্র বন্দরে জাহাজের বার্থিং (ভিড়া) পেতে দেশীয় পতাকাবাহী জাহাজের অগ্রাধিকার, আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে বাহিত মোট পণ্যের ৫০ শতাংশ দেশীয় জাহাজে পরিবহনের বাধ্যবাধকতা (যা আগে ছিল ৪০ শতাংশ), জাহাজ নিবন্ধনের জটিলতা দূরীকরণ ইত্যাদি ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। সেই সাথে করোনাসহ বিভিন্ন কারণে বৈশ্বিক সরবরাহ চেইন ব্যাহত ও বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে জাহাজে পণ্য পরিবহনে ভাড়া অনেক বেড়েছে। বাড়তি আয়ের সুবাদে সমুদ্রগামী জাহাজ খাতে এসেছে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ। দেশীয় উদ্যোক্তাদের প্রচেষ্টায় এ খাতে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হচ্ছে।
তাছাড়া করোনা মহামারির কারণে বিশ^ ও দেশীয় বাজারে জাহাজের দাম কমে গেছে। এর সুযোগ গ্রহণ করেন উদ্যোক্তারা। মহামারির কারণে বিশ্ববাণিজ্যে মন্দাকালে ফিডার জাহাজের দাম এক থেকে সোয়া কোটি ডলার থেকে প্রায় অর্ধেকে নেমে আসে। এরফলে করোনাকালে গত দুই বছরে দেশীয় পতাকাবাহী সমুদ্রগামী জাহাজবহরে যুক্ত হয়েছে ৩২টি জাহাজ। ২০১৯ সালের ৪৮টি থেকে বর্তমানে ফিডার জাহাজের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮০টিতে। জাহাজ খাতে বিনিয়োগে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন দেশের শিল্পোদ্যোক্তাগণ। এটি সঠিক ধারায় এগিয়ে গেলে মার্চেন্ট ফিডার জাহাজ খাতে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে। বাড়তি আয় আসবে অন্তত ৩৪ হাজার কোটি টাকা।
জাহাজের বাণিজ্যে চট্টগ্রাম ও ঢাকাভিত্তিক শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে- কবির গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, আকিজ গ্রুপ, ইস্ট-কোস্ট গ্রুপ, কর্ণফুলী গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ, ওরিয়ন গ্রুপ ইত্যাদি। সাধারণ ফিডার জাহাজ ছাড়াও বিভিন্ন শিল্প গ্রুপের রয়েছে পেট্রোলিয়াম (বিশেষত এলপিজি) বহনযোগ্য ট্যাংকারবহর। পোর্ট-শিপিং-জাহাজবহরের প্রধান ব্যবহারকারী বা স্টেকহোল্ডার বিজিএমইএ’র প্রথম সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, ফিডার জাহাজবহর কেনা ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির ফলে শিপিং খাতে সক্ষমতা বেড়ে যাচ্ছে। গার্মেন্টস ও বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামাল আমদানির জন্য তা সহায়ক হচ্ছে। এরফলে আগের ৮-১০ শতাংশের স্থলে এখন ২৫ শতাংশ পর্যন্ত ফ্রেইট ধরা বা পরিবহনের সক্ষমতা এসেছে দেশীয় জাহাজবহরের।
তিনি জানান, এই খাতে বিনিয়োগের আরও সুযোগ রয়েছে। আমরা ইতোমধ্যে সরকারের কাছে বড় ক্যারিয়ারের জন্য তাগিদ দিয়েছি। সম্প্রতি সরাসরি ইতালি থেকে বড় ক্যারিয়ার রফতানি চালান নিয়ে আসা-যাওয়া করেছে। এরফলে ফ্রেইট পরিবহন খরচ সাশ্রয় হবে। দেরিতে হলেও সরকার ব্যবসাবান্ধব নীতি গ্রহণ করেছে। তবে সার্বিক সুফল পেতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
এদিকে গেল ২০২১ সালে চট্টগ্রাম বন্দর ৩২ লাখ এক হাজার ৫৪৮ টিইইউএস কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ে রেকর্ড করেছে। গত ২০২০ সালে যা ছিল ২৮ লাখ ৩৯ হাজার ৯৭৭ টিইইউএস। ২০১৯ সালে কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের পরিমাণ ছিল ৩০ লাখ ৮৮ হাজার ১৮৭ টিইইউএস। গেল বছর কন্টেইনার ছাড়াও খোলা সাধারণ পণ্যসামগ্রী (ব্রেক বাল্ক কার্গো) হ্যান্ডলিং করা হয়েছে ১১ কোটি ৬৬ লাখ ১৯ হাজার ১৫৮ মেট্রিক টন। বন্দরে আমদানি-রফতানিমুখী পণ্যবাহী জাহাজ গমনাগমন করেছে ৪ হাজার ২০৯টি। সবমিলিয়ে প্রায় ১৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে বন্দর। চট্টগ্রাম বন্দর ও জাইকার আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতায় নির্মাণাধীন মাতারবাড়ী বহুমুখী গভীর সমুদ্রবন্দর গতবছর ৪০টি বিভিন্ন ধরনের জাহাজ বার্থিং ও হ্যান্ডলিং করেছে।