নিজস্ব প্রতিনিধি, পাবনা : পাবনার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও প্রাচীন কৃতিকর্মগুলোর মধ্যে সনাতন ধর্মাবলম্বী- ভক্ত অনুসারীদের তীর্থস্থান খ্যাত শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র সৎসঙ্গ আশ্রম। শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র ছিলেন সনাতন ধর্মের একজন আধ্যাত্মিক পুরুষ। যার রয়েছে নানা ধর্মের ভক্ত। বাংলা ১২৯৫ সনের ৩০ ভাদ্র পাবনা শহরের অদূরে পদ্মানদীর তীরে হিমাইতপুরে তিনি আবির্ভূত হন। নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ শিবচন্দ্র ও স্বতীসাদ্ধী রমনী মনোমোহিনী দেবীর সুযোগ্য সন্তান। ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র দীক্ষাপ্রাপ্ত হন তার মায়ের কাছ থেকে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, পদ্মানদীর তীরে হিমাইতপুর গ্রামেই অনুকূলচন্দ্রের শৈশব, বাল্য ও কৈশোর অতিক্রান্ত হয়। পিতামাতার প্রতি ছিল তার গভীর শ্রদ্ধা। একবার পিতার অসুখের সময় সংসারে খুব অর্থকষ্ট দেখা দেয়। বালক অনুকূলচন্দ্র এগিয়ে এলেন সংসারের হাল ধরতে। তিনি প্রতিদিন আড়াই মাইল হেটে গিয়ে শহর থেকে পিতার জন্য ঔষধ আনতেন, পথ্য আনতেন। মায়ের প্রতিও ছিল তাঁর অগাধ ভক্তি। হিমাইতপুরে পাঠশালায় পাঠ সমাপ্ত হলে তিনি পাবনা ইনস্টিটিউট-এ ভর্তি হন। সহপাঠীদের কাছে ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র ছিলেন প্রিয়পাত্র। পরে তিনি হোমিও চিকিৎসা শাস্ত্রে পড়াশুনা করেন এবং হিমাইতপুরে এসে চিকিৎসক হিসাবে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। এতে তার অভূতপূর্ব সাফল্য আসে। তবে তিনি শুধু দেহের চিকিৎসাই করেননি, মনের চিকিৎসাও করেন। তিনি উপলব্ধি করলেন, মানুষের দুঃখের স্থায়ী নিবারণ করতে হলে শারীরিক, মানসিক ও আত্মিক এই তিন রকম রোগের চিকিৎসা প্রয়োজন। তিনি মানসিক ব্যাধির চিকিৎসা শুরু করলেন। অসহায়, অবহেলিতরাই অনুকূলচন্দ্রের প্রাণের বন্ধু। তাদের তিনি নামমাহাত্ম শুনিয়ে কীর্তনের দল গড়ে তুললেন। কিন্তু কিছু কিছু শিক্ষিত তরুণও এই সময় তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন।
এদের নিয়ে কীর্তন আনন্দে মেতে উঠলেন অনুকূলচন্দ্র। কীর্তনের ব্যাপারটা নিয়ে ঠাকুর গভীর চিন্তায় মগ্ন হলেন। তিনি উপলব্ধি করলেন, কীর্তন মানুষের মনকে উপরের স্তরে নিয়ে যায় বটে, কিন্তু সে অবস্থা বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারে না। মনের স্থায়ী উন্নতি ঘটাতে হলে চাই সৎনাম স্মরণ ও মননের সাহায্যে ব্রহ্মের উপলব্ধি। তাঁর ভক্ত ও অনুরাগীর সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে লাগল। সৎসঙ্গের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র। প্রতিষ্ঠানটির নামের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘সৎ-এ সংযুক্তির সহিত তদগতি সম্পন্ন যাঁরা তারাই সৎসঙ্গী, আর তাদের মিলনক্ষেত্রই হল সৎসঙ্গ। শুরু হল মানুষ তৈরির আবাদ। কর্মের মাধ্যমে যোগ্য মানুষ গড়াই হল এর লক্ষ।
অন্যদিকে হিমাইতপুরে গড়ে উঠল ধর্ম কর্মের অপূর্ব সমন্বয়ে সৎসঙ্গ আশ্রম। শিক্ষা, কৃষি, শিল্প সুবিধাসহ আস্তিকের এই চার স্তম্ভের অভিব্যক্তি। এই আশ্রমে বিভিন্নমুখী কর্ম প্রতিষ্ঠানের বিদ্যায়তন গড়ে উঠল, প্রাচীন ঋষিদের তপোবনের নবতর সংস্করণ যেন। ব্রহ্মচর্য্য, গার্হস্থ্য, বানপ্রস্থ ও সন্ন্যাস সনাতন আর্য জীবনের এই চারটি স্তরই সৎসঙ্গ আশ্রমভূমিতে এক সামঞ্জস্যপূর্ণ যুগপোযোগী রূপলাভ করে। ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের আধ্যাত্মিক প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দলে দলে মানুষ এসে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। ঠাকুর অনুকুলচন্দ্রের প্রতিষ্ঠিত হিমাইতপুর সৎসঙ্গ আশ্রম নামে উপমহাদেশে সুপরিচিতি লাভ করে। মহাত্মা গান্ধী এই সৎসঙ্গের কর্মকান্ড দর্শন করে ভূয়সী প্রশংসা করেন। নেতাজী সুভাষ বোস, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, উপমহাদেশের নানা সংস্কৃতি সাধক, উপন্যাসিক, লেখক, কবিসহ নানা দেশ বরেণ্য ব্যক্তিত্ব এই আশ্রম দর্শন করেছেন।
ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র শুধু আশ্রমটি প্রতিষ্ঠাই করেননি। এই আশ্রম ঘিরে রয়েছে নানা আয়োজন। বছরে দুটো মহোৎসব অনুষ্ঠিত হয় ঠাকুর স্মরণে। দেশবিদেশের লক্ষাধিক মানুষের সমাগম ঘটে এই তীর্থস্থানে। পুলিশ ক্যাম্প থেকে শুরু করে পোষ্ট অফিস, হোমিও চিকিৎসালয়, প্রার্থনালয়, বৃহৎ মাঠ, অনুষ্ঠান মঞ্চ, ঠাকুরের মন্দির, মাতৃমন্দির, আনন্দবাজার, নারীপুরুষের স্নানঘাট, বৃহৎপরিসরে স্যানিটেশন ব্যবস্থা, বিনামুল্যে ছাত্রাবাসে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা, বৃহৎ সমৃদ্ধ লাইব্রেরি, সেমিনার কক্ষ, পুরোনা জাতীয় দৈনিক পত্রিকার সম্ভাব, ফিলানথ্রপিসহ নানা দিকদিয়ে সমৃদ্ধ এই আশ্রম।