বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : বুধবার রাজধানীর বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্সের আড়ং থেকে বাচ্চাদের জন্য ৯৭০০ টাকার পোশাক কিনেছেন ধানমণ্ডির বাসিন্দা আসিফুর রহমান। তবে বিল পরিশোধে কাউন্টারে লাইনে দাঁড়িয়ে ৪০ মিনিটের বেশি অপেক্ষা করতে হয়েছে তাকে। নিয়মিত কেনাকাটা করলেও মানুষের ভিড়ের কারণে এই প্রথম এত দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়েছেন তিনি। এক রকম বিরক্তি প্রকাশ করে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, তীব্র গরম ও প্রায় ঘণ্টাখানেক জ্যাম পেরিয়ে শপিং করতে এসেছিলাম। বিল পরিশোধ করতে হয়েছে প্রায় ঘণ্টাখানেক দাঁড়িয়ে। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি ঈদের বাকি কেনাকাটা অনলাইনে করব। রমজানে শপিং করতে এসে আসিফুর রহমানের মতো এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে অনেকেরই। এবারের রমজানে অনেকেই আবার ফিরেছেন অনলাইন কেনাকাটায়। ঈদ ঘিরেই আবারও জমে উঠেছে ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম। মূলত ই-কমার্সের আড়ালে প্রতারকদের বিচারের আওতায় আনতে সরকার দ্রুত পদক্ষেপ এবং নীতিমালা প্রণয়ন করায় মানুষ আবারও ই-কমার্সমুখী হয়েছে, অর্ডারও বেড়েছে চার/পাঁচগুণ
জানা গেছে, করোনাকালে কেনাকাটার প্রধান মাধ্যম ছিল ই-কমার্স। ২০২০ সালে ৩০০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি দেখেছে এ খাত। তবে সম্ভাবনাময় হওয়ার পরও গত বছর বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের প্রতারণার কারণে গোটা খাতটি আস্থার সঙ্কটে পড়ে। প্রতারিত গ্রাহকদের অভিযোগে এরই মধ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের গ্রেফতার করেছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। ১৫টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের প্রতারণার বিরুদ্ধে ৪১টি মামলা করেছেন গ্রাহকরা। এসব মামলায় আসামি হয়েছেন ১১০ জন আর গ্রেফতার হয়েছেন ৩৬ জনের বেশি। গত বছরের শেষে গ্রাহকের আস্থা ফেরাতে কাজ শুরু করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ই-কমার্স খাতসংশ্লিষ্টরা। এরই মধ্যে গ্রাহকদের অর্থ ফেরৎ প্রদান, ই-কমার্স ব্যবসার জন্য নিবন্ধনসহ বেশ কিছু উদ্যোগও গ্রহণ করা হয়েছে। তবে কিছু মামলার মধ্যে অর্থপাচারের অভিযোগও রয়েছে। মামলা থাকার কারণে এসব প্রতিষ্ঠানের কাছে আটকে থাকা গ্রাহকের অর্থ ফেরত আনার উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের ত্বরিত পদক্ষেপ ও করোনা নিয়ন্ত্রণে আসায় ফের মানুষ ই-কমার্সমুখী হয়েছে। অর্ডারও বেড়েছে চার/পাঁচগুণ। ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের তথ্যমতে, সাধারণত দিনে প্রায় ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজার অর্ডার পাওয়া যায়। কিন্তু রমজান শুরুর সঙ্গে সঙ্গে এ সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার থেকে ৬০ হাজারে চলে যায়। একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আরিফুল হাসান জানান, তিন হাজার টাকা ছাড়ে একটি স্মার্ট ফোন কিনেছেন একটি ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম থেকে। তিনি বলেন, মোবাইলটা কেনার জন্য ঈদের অফারের অপেক্ষায় ছিলাম। আরিফুল হাসানের মতো অনেকেই অনলাইনেই করছেন ঈদের কেনাকাটা। কারণ সেখান থেকে পণ্য কিনে ক্রেতা পাচ্ছেন বিশেষ মূল্যছাড়। এর সঙ্গে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে টাকা পরিশোধে রয়েছে ক্যাশব্যাক অফার। এছাড়া একটি কিনলে আরেকটি ফ্রি, ফ্রি ডেলিভারির সুযোগ থাকছে। যানজটের ঝক্কি এড়িয়ে অনেকেই তাই প্রয়োজনীয় কেনাকাটা সেরে নিচ্ছেন অনলাইনে
ই-কমার্স এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) তথ্যমতে, দেশে প্রায় ৩ হাজার ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের মধ্যে তালিকাভুক্ত ১ হাজার ৬৮৩টি প্রতিষ্ঠান। এছাড়া প্রায় আড়াই লাখ ফেসবুকভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আছে যেগুলো এফ-কমার্স নামেও পরিচিত। ই-ক্যাবের মহাপরিচালক জাহাঙ্গীর আলম শোভন বলেন, সাধারণত রমজানের শুরু থেকে অনলাইনে বিক্রি ৩০-৪০ শতাংশ বাড়ে। তবে এবার মাসের শুরু থেকে প্রায় ৬০ শতাংশ বা তার বেশি বিক্রি হবে। ঈদ পর্যন্ত এই সংখ্যা আরও বাড়বে বলে আশা করা যাচ্ছে। সরকারী হিসাবে দেশের ই-কমার্স বাজারের পরিমাণ প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা। বছর শেষে সামগ্রিকভাবে ৪০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে যা প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। দেশের শীর্ষস্থানীয় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আজকেরডিলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহিম মাশরুর বলেন, অনলাইনে বিক্রি স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে দেড় থেকে ২ গুণ বেশি হচ্ছে। আশা করছি, এটি আরও বাড়বে। পণ্য পৌঁছাতে সমস্যা থাকায় মাসের শেষ সপ্তাহে বিক্রি কম হবে। তাই এই উৎসব সামনে রেখে ব্যবসায়ীদের বিক্রি বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন ধরনের পোশাক, ঘরের আসবাবপত্র এবং ইলেকট্রনিক পণ্যের ওপর ছাড় দেয়াসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, পোশাকের ক্ষেত্রে আমাদের ওয়েবসাইটের তুলনায় ফেসবুক পেজ থেকে বেশি অর্ডার পাচ্ছি। এখানের গ্রাহকদের বড় অংশ নারী, যারা ফেসবুকের মাধ্যমে পণ্য কিনতে পছন্দ করেন। এদিকে আমাদের ফেসবুক ব্যবসায়ীরা সারাদেশে পণ্য পাঠাচ্ছেন।
যেহেতু ফেসবুকের গ্রাহকরা ক্যাশ অন ডেলিভারি করতে পছন্দ করেন, তাই ব্যবসায়ীদের পণ্যের মূল্য হাতে পেতে বেশি সময়ের প্রয়োজন হয়। তার ভাষ্যমতে, দেশে ই-কমার্স সম্পর্কিত কিছু নেতিবাচক ঘটনার পরেও আবার কেনাকাটার প্রবণতা ফিরে এসেছে। তাই আমরা এটিকে উৎসব মনে করেছি। এই উৎসবে অনেক নতুন গ্রাহককে কেনাকাটা করতে দেখছি। এই প্রবণতা শুধু ঢাকা শহরেই নয়, জেলা শহরগুলোতেও দেখা গেছে। ই-কমার্স ব্যবসায়ী সাজ্জাদ বলেন, রমজানের এই সময়ের মধ্যে আমাদের গ্রাহক সংখ্যা দ্বিগুণ করার দিকে নজর দেব। গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী পোশাকের ওপর বেশি নজর দেই। এছাড়াও আমরা পেমেন্ট পদ্ধতিতে নগদের মাধ্যমে ২০ শতাংশ তাৎক্ষণিক ব্যাক অফার দিয়ে থাকি। যাতে গ্রাহকরা তাদের দৈনন্দিন পণ্যগুলো সবোর্চ্চ সাশ্রয়ী মূল্যে কিনতে পারে। এবারের রমজানে ৩ গুণ বেশি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ঠিক করেছেন ই-কমার্স ব্যবসায়ীরা। পোশাক এবং গ্যাজেট পণ্যের ওপর ভিত্তি করে এই সম্ভাবনার কথা জানিয়েছেন ই-ব্যবসায়ীরা। তারা আরও বলেন, উষ্ণ আবহাওয়া, রাস্তায় ধুলাবালি, পরিবহন খরচ বাড়া এবং যানজটের কারণে অনলাইনে ক্রয়-বিক্রয়ের প্রতি আকর্ষণ বেড়েছে। গ্রাহকরা অনলাইনে পণ্য কিনতে ভালবাসেন এবং এটি উপভোগও করেন।
বাজার ও ভোক্তা পরিসংখ্যানের মতে, ২০২২ সালের শেষে বাংলাদেশের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৩৫ শতাংশে দাঁড়াবে। ফলে দেশের ই-কমার্স আয় ৮ হাজার ৩০ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছে। ঈদ কেনাকাটা নিয়ে জানতে চাইলে ই-কমার্স এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ফেসবুক গ্রুপ উইমেন এ্যান্ড ই-কমার্স ফোরামের (উই) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নাসিমা আক্তার নিশা বলেন, গতবার বা তার আগের বছর ঈদ সীমিত আকারে উদযাপিত হয়েছে। করোনার প্রথম বছর ই-কমার্স সেক্টর সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি দেখেছে। পরের বছর কিছু প্রতিবন্ধকতার কারণে সেটা হোঁচট খেয়েছে। কিন্তু বাকি সব সেক্টর থেমে থাকলেও ই-কমার্স থেমে থাকেনি। তিনি বলেন, এবার আমাদের মনে হচ্ছে গত দুবারের তুলনায় বেচাকেনা ভালই হবে। মানুষ স্বাচ্ছন্দ্যে কেনাকাটা করছে। রোজার আগে প্রতিদিন ২ লাখ ৭০ হাজার অর্ডার ছিল। রোজার ভেতর সেটা সাড়ে তিন লাখ হয়েছে। ঈদের আগে অর্ডার ডেলিভারি আরও বাড়বে বলে মনে করছি। আমরা ধরে নিচ্ছি সেটা পৌনে চার লাখ ছাড়াবে। নাসিমা আক্তার নিশা বলেন, ক্যাশ অন ডেলিভারির পাশাপাশি কার্ডেও গ্রাহকরা টাকা পরিশোধ করছেন। তবে ক্যাশ অন ডেলিভারির সংখ্যাটা বেশি। বিতর্কিত কিছু প্রতিষ্ঠানের কর্মকা-ে ই-কমার্সে যে আস্থার সঙ্কট তৈরি হয়েছিল সেটা থেকে মানুষ বের হয়েছে। এ কারণে ই-কমার্সে ঈদ কেনাকাটা বেড়েছে।
জনপ্রিয় ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম অথবা ডট কমের হেড অব বিজনেস নুর মোহাম্মদ রাসেল বলেন, গত দুই বছরে অনলাইনে ভাল কেনাকাটা হয়েছে। এ বছর আরও ভাল কেনাকাটা হচ্ছে। কারণ আমাদের করোনা পরিস্থিতি প্রায় নিয়ন্ত্রণে এসেছে। তিনি আরও বলেন, আমাদের ফ্যাশন আইটেম খুব ভাল চলছে। স্মার্টফোন বিক্রির রেসপন্সও ভাল। অথবা ডটকম থেকে কেনাকাটায় ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ডিসকাউন্ট থাকছে। একটা কিনলে একটা ফ্রি, ফ্রি ডেলিভারি, ইএমআইসহ নানান সুযোগ-সুবিধা থাকছে।
অনলাইনে বিক্রি বেড়েছে জামদানির ॥ নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার নোয়াপাড়া বিসিক শিল্প নগরীর জামদানি পল্লীতে সরাসরি পল্লীতে ক্রেতারা না এলেও অনলাইনে জামদানি খুব ভাল বিক্রি হচ্ছে। করোনার পরিস্থিতি জামদানির বাজার দখল করে নিয়েছে ই-কমার্স। তাঁতিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, করোনা ও লকডাউনে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে ৫ হাজার তাঁতি। লকডাউন ও করোনা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে তাঁতিরা ই-কমার্স ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে জামদানি শাড়ি বিক্রির নতুন বাজার হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে। বর্তমানে পল্লীর তাঁতি ও দোকান মালিকদের সবারই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই ফেসবুক পেজ রয়েছে। ঈদ সামনে রেখে সেই পেজের মাধ্যমেই তারা শাড়ি বিক্রি করে করছেন। পল্লীর বিসমিল্লাহ জামদানির মালিক আসিফ জানান, দোকানের পাশাপাশি বিসমিল্লাহ জামদানি নামে তার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি পেজ রয়েছে।
বর্তমানে দোকানে বিক্রি অনেক কমে গেলেও ঈদকে সামনে রেখে অনলাইনে শাড়ি খুব ভাল বিক্রি হচ্ছে।অনলাইন কেনাকাটায় আরও বেশি সচেতন হওয়ার পরামর্শ ॥ ফেসবুকে অসংখ্য অনলাইন শপিং পেজ রয়েছে, যেগুলো নানা রকমের চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে লোকজনকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে থাকে। এর মধ্যে কিছু পেজ পাওয়া যায় যেগুলো কখনও কখনও এক ধরনের প্রোডাক্ট দেখিয়ে অন্য ধরনের প্রোডাক্ট বা নিম্নমানের প্রোডাক্ট ডেলিভারি দিয়ে থাকে। আবার, কিছু কিছু পেজ পাওয়া যায় যেগুলো প্রোডাক্ট অর্ডারের জন্য অগ্রিম মূল্য পরিশোধ করার পরও কোন প্রোডাক্টই ডেলিভারি দেয় না। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পেজ খুলে আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন দিয়ে ভোক্তাদের অত্যন্ত নিম্নমানের পণ্য সরবরাহ করা একটি চক্রকে আটক করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের লালবাগ বিভাগের একটি দল। তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ ব্যবহার অযোগ্য ও অতি নিম্নমানের পুরাতন ছেঁড়া শাড়ি, লেহেঙ্গা, থ্রি-পিসসহ বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী জব্দ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও তথ্য প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ হচ্ছে- সুপরিচিত বা সুপ্রতিষ্ঠিত অনলাইন শপ ছাড়া অন্য কোন অনলাইন শপ থেকে কেনাকাটার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকুন। এক্ষেত্রে তাদের কাস্টমার রিভিউগুলো ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করে নিতে পারেন। ঈদকে সামনে রেখে এসব প্রতারণা এড়ানোর জন্য পরামর্শ দিয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ। পাশাপাশি প্রতারণার শিকার হলে বিলম্ব না করে পুলিশকে অবগত করতে বলা হয়েছে।