বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : মহামারি করোনার কারণে গত দুই বছর ঈদে গ্রামের বাড়িতে যেতে পারেননি অনেকে। এবার পরিস্থিতি বদলেছে। করোনা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এসেছে। ফলে এবারের ঈদুল ফিতরে সড়কের পাশাপাশি রেলপথে থাকবে ঘরমুখো মানুষের চাপ। এ কারণে নানা সংকটের মধ্যেও অনেকটা জোড়াতালি দিয়ে ঈদযাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলাদেশ রেলওয়ে।
প্রয়োজনের মাত্র ২৫ শতাংশ জনবলের পাশাপাশি বাজেট স্বল্পতা নিয়ে এবারের ঈদযাত্রায় ৫০টি বগি সংযুক্ত করতে যাচ্ছে সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানা। নষ্ট ও চলাচল অযোগ্য বগিগুলোকে সচল করে তুলছেন কারখানার শ্রমিক-কর্মচারীরা। চরম কর্মব্যস্ততায় সময় কাটছে তাদের।
জানা গেছে, সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানায় পুরোনো ট্রেনকে নতুন করার কাজ চলে আসছে ব্রিটিশ আমল থেকে। ব্রিটিশ সরকার ১৮৭০ সালে সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানাটি স্থাপন করে। সেই সময় সৈয়দপুর কারখানায় কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শ্রমিকের সংখ্যা ছিল প্রায় ১০ হাজারের মতো। ধীরে ধীরে জনবল কমে যাওয়ার পরও এ কারখানায় প্রতিদিন একটি কোচ ও একটি ওয়াগন মেরামত করা হয়। এছাড়া রেলওয়ের নানা ধরনের যন্ত্রাংশ তৈরি করা হয় এখানে। প্রয়োজনের মাত্র ২৫ শতাংশ জনবল নিয়ে কাজ হচ্ছে কারখানাটিতে। কারখানার যান্ত্রিক শাখায় ২ হাজার ৮৫৯ জনবলের বিপরীতে কর্মরত রয়েছেন মাত্র ৬৯১ জন। বৈদ্যুতিক শাখায় ৩৩৭ জনবলের বিপরীতে কর্মরত রয়েছেন ১৪৮ জন।
সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার জিওএইচ, উৎপাদন মেশিন শপ, ক্যারেজ শপ, হুইল শপ, বগি শপ ও সিএইচআর শপ ঘুরে দেখা গেছে, চলছে নষ্ট হয়ে যাওয়া বগি মেরামত। কেউ ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ, কেউবা ব্যস্ত চাকা মেরামতে। আবার কেউ ওয়েল্ডিং ও কোচের সিট মেরামতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। কোথাও আবার মেরামত করা বগিকে নতুন করে রং লাগিয়ে চকচকে করে তোলা হচ্ছে। যেন দম ফেলার সময় নেই তাদের। তীব্র জনবল সংকটের মধ্যেও সেবার ব্রত নিয়ে কাজ করছেন শ্রমিকরা। তাদের অভিযোগ- পর্যাপ্ত জনবল ও কিছু সংখ্যক কাঁচামালের অভাবে পুরো কর্মযজ্ঞ কিছুটা বাধাগ্রস্ত।
মেরামতকৃত এসব কোচ দিয়ে ঢাকা-খুলনা, ঢাকা-পার্বতীপুর রুটে দুটি বিশেষ ট্রেন চালু করা হবে। আর বাকি কোচ অন্যান্য ট্রেনের সঙ্গে সংযুক্ত করা হবে। রেলবহরে বাড়তি কোচগুলো যুক্ত হলে ঘরমুখো মানুষের যাত্রাপথের ভোগান্তি কিছুটা হলেও লাঘব হবে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে শুরু করে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কাজ চলছে কারখানার ২৪টি বিভাগে। ইতোমধ্যে প্রস্তুত হওয়া ৪২টি বগি চলে গেছে রেলওয়ের পাকশী ও লালমনিরহাট রেলওয়ে বিভাগের কাছে।
ক্যারেজ শপের ওয়েল্ডিং মিস্ত্রি রাশেদুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রতি ঈদে আমাদের অতিরিক্ত একটা টার্গেট দেওয়া হয়, সেই টার্গেট পূরণ করতে আমাদের স্বল্পসংখ্যক জনবল নিয়ে খুব কষ্ট হচ্ছে। আমাদের নির্ধারিত ডিউটির বাইরেও এক ঘণ্টা করে অতিরিক্ত ডিউটি করে এই অসমাপ্ত কাজগুলো শেষ করার চেষ্টা করছি। আশা করি এবারের ঈদে ঘরমুখী অতিরিক্ত ৫ হাজার যাত্রী প্রতিদিন নির্বিঘ্নে বাড়ি পৌঁছাবে।
জনবল সংকটের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমার সেকশনে লোক ছিল ৩৫ জন, বর্তমানে সেই লোক কমে ১৩ জনে এসেছে। এই ১৩ জন লোক দিয়ে আমার সেকশনে কাজ করা খুব কষ্টসাধ্য। সরকারের উচিৎ পর্যাপ্ত জনবল নিয়োগ দেওয়া। বাংলাদেশ রেলওয়ে একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। সরকার যদি পর্যাপ্ত জনবল নিয়োগ দেয় তাহলে আমরা আরও বেশি মানুষকে সেবা দিতে সক্ষম হব।
একই শপের শ্রমিক মিজানুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, কারখানায় মেরামতের জন্য যে কোচগুলো আসে, সেগুলোর ইনজুরি হয় সাধারণত এক বছর থেকে ছয় মাস ব্যবহারের পর। এই কোচগুলো একদম রুগ্ন অবস্থায় আসে। আমরা প্রচুর কাজ করে সেগুলোকে নিখুঁত করে মেরামত করার চেষ্ট করি। মেরামতের জন্য যে কোচগুলো আসে, সেগুলোর ৯০ শতাংশ অকেজো থাকে। এসব কোচগুলোকে আমরা শতভাগ মেরামত করে থাকি। ঈদের কারণে বর্তমানে এক ঘণ্টা অতিরিক্ত সময় পরিশ্রম করতে হচ্ছে।
হুইল শপের শ্রমিক ইলিয়াস হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, সাধারণ সময়ে দিনে ২ থেকে ৩টি চাকার কাজ করা যায়। কিন্তু ঈদের চাপ থাকায় বর্তমানে অতিরিক্ত সময় এবং বাড়তি পরিশ্রম মিলিয়ে প্রতিদিন ৫টি চাকার কাজ করতে হচ্ছে। যাত্রীদের নিরাপদ ভ্রমণের কথা ভেবে এখন আমরা কোনো ছুটি কাটাচ্ছি না।
পেইন্ট শপের শ্রমিক আউয়াল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের শপের কাজ হচ্ছে কোচগুলো রং করে সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা। অল্প সংখ্যক লোক নিয়ে আমরা কাজ করছি। কর্তৃপক্ষ যদি জনবল নিয়োগ দেয় তাহলে আমরা বেশি গাড়ি দিতে পারব। লোকসংখ্যা কমের কারণে খুব কষ্টের মধ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি, সেটা কর্তৃপক্ষের চাপে হোক কিংবা আমাদের দায়িত্ব থেকে হোক । রেল যেহেতেু সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। আমরা সেবার জন্য সবসময় বেশি করে শ্রম দেই। যাতে যাত্রীদের কোনো ভোগান্তি না হয়।
ক্যারেজ শপের সুপারভাইজার আব্দুর রশিদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, কথা বললে তো দোষ হয়ে যাবে। আমরা খুব বিপদের মধ্যে আছি। লোকবল নেই। এক বছর-ছয় মাস করে চাকরি আছে আমাদের। আমি একজন সুপারভাইজার, আমি টেবিলে বসে লেখালেখি করব, কিন্তু আমি করতেছি ওয়েল্ডিংয়ের কাজ। লোকবল বলতে কিছু নেই, সেটা কর্তৃপক্ষকে বললে তারা কর্ণপাতও করে না।
কারখানার বগি শপের ইনচার্জ সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী জহুরুল হাবীব ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা বগি শপে হুইল, ব্রেকিং সিস্টেমসহ যত সেফটি আইটেম আছে সবগুলোরই কাজ করে থাকি। রিপিয়ার, রিকনডিশন, বিল্ডআপ করা হয় এখানেই। আমরা মাত্র ২৫ শতাংশ জনবল নিয়ে কাজ করতেছি। সেজন্য লক্ষ্যমাত্রা ঠিক রাখতে আমাদের প্রত্যেক শ্রমিককে অধিক পরিমাণে কাজ করতে হচ্ছে। রোজা থেকে তাদের দ্বিগুণ কাজ করতে হচ্ছে। কাজ করতে করতে তারা ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছেন।
কারখানার ঊর্ধ্বতন উপ-সহকারী প্রকৌশলী মমিনুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রতিবছরই ঈদকে সামনে রেখে অধিক সংখ্যক কোচ মেরামতের টার্গেট হাতে নেওয়া হয়। আমাদের এবারের লক্ষ্যমাত্রা এ মাসেই ৫০টি কোচ তৈরি করব। ইতোমধ্যে আমরা ৮০ শতাংশ কোচ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছি। এই সপ্তাহের মধ্যে বাকিটা সম্পন্ন হবে। যাতে করে যাত্রী সাধারণ নির্বিঘ্নে বাড়িতে ফিরতে পারে।
কারখানার উৎপাদন মেশিন শপের ইনচার্জ প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, জনবল সংকট প্রধান সমস্যা এখানে। প্রয়োজনীয় জনবল থাকলে কারখানাটি আরও উন্নত সেবা দিতে পারবে রেল বিভাগকে। ঈদের সময় আমরা সবাই বাড়তি কষ্ট নিয়ে কাজ করি। লক্ষ্য বাস্তবায়নে তখন আমরা সেসব আমলে নেই না। যে যার মতো মেধা ও শ্রম দিয়ে কাজ শেষ করার ব্রত নিয়েই দিন কাটাই।
সৈয়দপুর কারখানার বিভাগীয় তত্ত্বাবধায়ক সাদেকুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আসন্ন ঈদুল ফিতর উপলক্ষে যাত্রীরা যাতে সহজেই নির্বিঘ্নে তাদের গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে পারেন এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ রেলওয়ের পক্ষ থেকে দুটি বিশেষ ট্রেন পরিচালনা করা হবে। বিশেষ ট্রেনসহ অনান্য ট্রেনসমূহে অতিরিক্ত কোচ লাগানোর জন্য আমরা এ মাসেই ৫০টি কোচ তৈরি করে দেওয়ার পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। লক্ষ্যমাত্রার ৫০টি কোচের মধ্যে ইতোমধ্যে ৪২টি কোচ হস্তান্তর করা হয়েছে রেলের পাকশী ও লালমনিরহাট বিভাগে। বাকি ৮টি কোচ নির্ধারিত সময়ের আগে হস্তান্তর করা হবে।
তিনি আরও বলেন, মাত্র ২৫ শতাংশ জনবল নিয়ে কারখানা চলছে। পর্যাপ্ত জনবল না থাকায় আমরা ওভারটাইমের মাধ্যমে নির্ধারিত সময়ের পরে শ্রমিকদের এক ঘণ্টা করে কাজ করিয়ে কাজগুলো আদায় করছি। যদিও তাদের রোজা রেখে কাজ করতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। শুধুমাত্র যাত্রীরা যাতে নির্বিঘ্নে নিরাপদে গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে পারেন এ লক্ষ্যে কারখানার এই উদ্যোগ।
জনবল নিয়োগের বিষয়ে সাদেকুর রহমান বলেন, আমাদের নিয়োগ প্রক্রিয়া কয়েকটি কারণে সম্পন্ন হয়নি। ইতোমধ্যে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে- এই নিয়োগ সম্পন্ন হলে আমাদের ঘাটতি কিছুটা কমে আসবে। আমাদের যেহেতু জনবলের ঘাটতি, সেহেতু ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অনুযায়ী আমরা এই মুহূর্তে ২০০ জন অনিয়মিত শ্রমিক দিয়ে কাজ করাচ্ছি। আরও যদি শূন্য পদের বিপরীতে অনিয়মিত শ্রমিক বাড়ানো যায় তাহলে কারখানার উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব।