বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : দেশ থেকে টাকা পাচার বন্ধে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনসহ অন্যান্য আইনের প্রয়োগ আরও কঠোরভাবে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় টাস্কফোর্স। একই সঙ্গে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন সংশোধন করে আইন লঙ্ঘনের ঘটনায় জরিমানা ও অন্যান্য শাস্তির মাত্রা আরও বাড়ানোর সিদ্ধান্তও হয়েছে। অর্থ পাচারের ঘটনা দক্ষতার সঙ্গে এবং দ্রুত তদন্ত করার জন্য তদন্তকারী সংস্থাগুলোর সক্ষমতা আরও বাড়ানো হবে। বিদেশে পাচার করা টাকা দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে গঠিত টাস্কফোর্সও পুনর্গঠন করা হবে। সম্প্রতি মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে গঠিত কেন্দ্রীয় টাস্কফোর্সের সভায় এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
সম্প্রতি টাস্কফোর্সের সভাপতি অ্যাটর্নি জেনারেলের সভাপতিত্বে এ সভায় বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ), প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, দুর্নীতি দমন কমিশন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনসহ (বিএসইসি) সংশিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
সূত্র জানায়, দেশ থেকে সাম্প্রতিক সময়ে টাকা পাচার বেড়ে গেছে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার চলতি হিসাবে অব্যাহত ঘাটতি থেকেও এটি আঁচ করা যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) মতে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর গড়ে ৭০ হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষক আউয়াল সরকারের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রতি বছর গড়ে ১১ হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে। এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তেও বিভিন্নভাবে ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা পাচারের ঘটনা উদ্ঘাটন হচ্ছে। এসব কারণে টাকা পাচার বন্ধ করতে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
টাকা পাচার প্রতিরোধে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন, আমদানি নীতি, জয়েন্ট স্টক আইনসহ আরও যেসব আইন রয়েছে সেগুলো সংশোধন করা হবে। এজন্য কাজ শুরু হয়েছে। প্রচলিত মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন লঙ্ঘনের দায়ে সর্বনিু ৩ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ২০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। এছাড়া মানি লন্ডারিংয়ের অর্থমূল্যের দ্বিগুণ জরিমানার বিধান রয়েছে। সর্বনিু জরিমানা আরও বাড়ানো হবে। একই সঙ্গে সর্বোচ্চ জরিমানাও বাড়ানো হবে। এছাড়া আইনের কিছু ক্ষেত্রে আরও স্পষ্টীকরণ করা হবে।
এ প্রসঙ্গে বিএফআইইউর একজন কর্মকর্তা জানান, আইনটি সংশোধনের কাজ শুরু হয়েছে। এবার জরিমানার হার বাড়ানো হবে বেশ। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে আরও কিছু নতুন বিষয়ও যুক্ত করা হবে।
মানি লন্ডারিং আইনের আওতায় বিভিন্ন ঘটনা তদন্ত করতে পারে সরকারের ১৭টি সংস্থা। এর মধ্যে যেসব তদন্তকারী সংস্থা হতে মানি লন্ডারিং অপরাধের তদন্ত ও মামলা হচ্ছে না সেসব সংস্থার কর্মকর্তাদের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য প্রশিক্ষন দেওয়া হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট সংস্থাগুলোকে সহায়তা করবে।
সূত্র জানায়, আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থ পাচার রোধে অধিকতর সতর্ক থাকার বিষয়ে ব্যাংকগুলোকে দেওয়া হয়েছে নির্দেশনা। এ বিষয়ে আইনের কিছু ধারাও সচল করা হয়েছে গত বছরের জুলাই থেকে। এর আওতায় বিধান রাখা হয়েছে জেল জরিমানার। আগে ওই ধারাগুলো সচল ছিল না। বর্তমানে শেল ব্যাংকের (অনুমোদনবিহীন অনলাইন ব্যাংক) মাধ্যমে আমদানি-রপ্তানির আড়ালে টাকা পাচার হচ্ছে। মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড নির্ধারণকারী সংস্থা ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্স (এফএটিএফ) আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শেল ব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন না করার নির্দেশনা দিয়েছে। বিএফআইইউ থেকে সার্কুলার জারি করে শেল ব্যাংকের সঙ্গে কোনো লেনদেন না করার জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তারপরও কয়েকটি ব্যাংক এ ধরনের বেআইনি ব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে লেনদেন করেছে। বিশেষ করে রপ্তানি বিল দেশে আনার ক্ষেত্রে শেল ব্যাংক ব্যবহার করছে কিছু উদ্যোক্তা। শেল ব্যাংকের সঙ্গে বৈদেশিক বাণিজ্য করায় দুটি ব্যাংককে ৩৭ লাখ টাকা জরিমানা করেছে বিএফআইইউ। এর মধ্যে একটি ব্যাংককে ২২ লাখ টাকা এবং অপর একটি ব্যাংককে ১৫ লাখ টাকা। ব্যাংকিং খাতে এটিই সবচেয়ে বেশি জরিমানা। একই অভিযোগে আরও কয়েকটি ব্যাংকের বিরুদ্ধে জরিমানা করার প্রক্রিয়া চলছে।
বিএফআইইউ গত বছরের মার্চ থেকে ৯৪টি বিশেষ পরিদর্শন কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। এর মধ্যে ৪৬টি ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় এবং ৫০টি বৈদেশিক বাণিজ্যের শাখা রয়েছে। এতে ২টি শেল ব্যাংকের সঙ্গে কয়েকটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের সম্পর্ক স্থাপনের তথ্য পেয়েছে। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এখন পর্যন্ত ৮টি শেল ব্যাংকের সঙ্গে দেশের কয়েকটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের সম্পর্ক স্থাপনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। সূত্র জানায়, সম্প্রতি টাস্কফোর্সের সভায় শেল ব্যাংকের একটি তালিকা করে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে দেওয়া সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে বিএফআইইউ কাজ করছে।
এদিকে বিদেশে পাচার করা টাকা দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে কার্যক্রম জোরদার করতে গঠিত টাস্কফোর্স পুনর্গঠন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অ্যাটর্নি জেনারেলকে আহ্বায়ক করে এতে সদস্য হিসাবে রাখা হচ্ছে, বিএফআইইউর প্রধান কর্মকর্তা, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) একজন কমিশনার, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে মহাপরিচালক, দুর্নীতি দমন কমিশনের (মানি লন্ডারিং) মহাপরিচালক, অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের (কেন্দ্রীয় ব্যাংক) যুগ্ম পরিচালক, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের যুগ্ম সচিব, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেলের মহাপরিচালক, কাস্টমস গোয়েন্দা ও শুল্ক তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের (জাতিসংঘ) পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা নীতি বিভাগের নির্বাহী পরিচালক ও বিএফআইউর উপপ্রধান। আগের টাস্কফোর্স থেকে কয়েকজন বাদ দিয়ে এবার সদস্য সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। একই সঙ্গে আগের চেয়ে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, টাকার পাচার রোধে অবকাঠামো ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানোর সিদ্ধান্তটি ইতিবাচক। কিন্তু এ ব্যাপারে রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকতে হবে। এছাড়া পাচার করা টাকা ফেরানো সম্ভব হবে না। কারণ আন্তর্জাতিক আইন এখন বেশ কঠোর। ইচ্ছে করলে অনেক টাকা ফেরানো সম্ভব।
সূত্র জানায়, আমদানি-রপ্তানির অনেক অর্থ সঠিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে না। বিশেষ করে বিদেশি ব্যাংক নানা অনিয়ম করছে। এ কারণে বিদেশি নতুন কোনো বাণিজ্যিক ব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের আগে প্রতিটি ব্যাংককে বিদেশি ব্যাংকের ক্রেডিট রিপোর্ট সংগ্রহ করতে হবে। রেটিং ভালো থাকলেই শুধু সম্পর্ক স্থাপন করা যাবে। রেটিং খারাপ হলে ওই ব্যাংকের সঙ্গে বৈদেশিক বাণিজ্য করা যাবে না।
দেশ থেকে বিভিন্নভাবে টাকা পাচার হচ্ছে। এগুলো ঠেকাতে আইনের প্রয়োগ যথাযথভাবে করতে প্রতিটি তদন্তকারী সংস্থায় বিশেষ উইং স্থাপন করতে হবে। ইতোমধ্যে বিএসইসি একটি বিশেষ উইং স্থাপন করেছে। রপ্তানির নামে দেশ থেকে টাকা পাচার বন্ধে এখন থেকে রপ্তানির যেসব কনটেইনার বিদেশে যাচ্ছে সেগুলোকে স্ক্যানিং রিপোর্ট ব্যাংকগুলোকে সংগ্রহ করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কেননা কনটেইনারে কি যাচ্ছে সেটি দেখতে হবে। অভিযোগ রয়েছে, কনটেইনারে পণ্যের বদলে বৈদেশিক মুদ্রা ও স্বর্ণ পাচার হচ্ছে।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশ হতে ৬ থেকে ৭টি দেশে বেশি অর্থ পাচার করা হয়। বাকি দেশগুলোতে কম পাচার হয়। যেসব দেশে অর্থ পাচার বেশি হয় ওইসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এখন পর্যন্ত ৬৮টি দেশের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে বিএফআইইউ। এগুলোর বেশিরভাগ দেশেই বাংলাদেশ থেকে তেমন কোনো অর্থ পাচার হয় না।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশ থেকে সাধারণ চারটি উপায়ে বাণিজ্যভিত্তিক অর্থ পাচার হয়। এর মধ্যে রয়েছে-শেল ব্যাংকের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, আন্ডার ইনভয়েসিং বা মূল্য কম দেখানো, ওভার ইনভয়েসিং বা মূল্য বেশি দেখানো এবং নন পেমেন্ট বিল বা যেসব বকেয়া বিলের দায়দেনা পরিশোধিত হয় না। এসব ক্ষেত্রে ব্যাংক ও কাস্টমসকে আরও সতর্ক থাকা এবং তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে আরও দক্ষ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বেসরকারি কোম্পানিগুলোর কার্যক্রমে স্বচ্ছতা আনতে রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মস (আরজেএসসি) কোম্পানি আইন সংশোধন করে মানি লন্ডারিং বিষয়ক তথ্য প্রদানে বাধ্যতামূলক করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।