বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : উচ্চ আমদানি ব্যয় এবং প্রবাসী আয়ের নিম্নমুখী প্রবণতায় মার্কিন ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশি মুদ্রাও চাপের মুখে পড়েছে। তবে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোয় যতটা শক্তিশালী হয়েছে, সে তুলনায় বাংলাদেশে ডলারের দাপট এখনো কম। গত এক বছরে বাংলাদেশি টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বেড়েছে ৩ দশমিক ১৮ শতাংশ। একই সময়ে পাকিস্তানের মুদ্রা রুপির বিপরীতে দাম বেড়েছে ৩১ দশমিক ৫৬ শতাংশ। ভারতের মুদ্রা রুপির বিপরীতে বেড়েছে ৬ দশমিক ৩২ শতাংশ। আর চরম দুর্দশাগ্রস্ত শ্রীলংকার মুদ্রার বিপরীতে বেড়েছে রেকর্ড ৮৩ শতাংশ। অর্থাৎ গত এক বছরে ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশি টাকার অবমূল্যায়নই হয়েছে সবচেয়ে কম। তবে যেটুকু অবমূল্যায়ন হয়েছে, তাতেই দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশে এখন আমদানির জন্য যে পরিমাণ অর্থ খরচ হচ্ছে তা রপ্তানি ও প্রবাসী আয় দিয়ে মিটছে না। এতে চাপে পড়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। গত সাড়ে আট মাসের ব্যবধানে রিজার্ভ প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার কমে ৪১ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে আসে। মূলত আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য ও সেবার মূল্য এবং জাহাজ ভাড়া বৃদ্ধির কারণে আমদানিতে খরচ বাড়ছে, কমে যাচ্ছে রিজার্ভ। এমন পরিস্থিতিতে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কায় রিজার্ভ সাশ্রয়ে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে কয়েক দফায় ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশি টাকার মান কমানো হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর বন্ধ করা হয়েছে। বিলাসী পণ্য আমদানির লাগাম টানা হয়েছে। কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্ল বাস্তবায়ন পিছিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। কিন্তু তার পরও ডলার বাজারের অস্থিরতা চলছে। অনেকেই বলছেন, শ্রীলংকা থেকে শিক্ষা নিয়ে এ ধরনের পদক্ষেপ আগেই নেওয়া দরকার ছিল।
পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর আমাদের সময়কে বলেন, রিজার্ভ ধরে রাখতে আমাদের আমদানি কমাতেই হবে। রপ্তানি বাড়াতে হবে। রেমিট্যান্স বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। প্রয়োজনে ডলারের বিপরীতে টাকার আরও অবমূল্যায়ন করতে হবে। এতে পণ্যমূল্য আরও বৃদ্ধির আশঙ্কা থাকলেও অর্থনীতির স্বার্থেই এ ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে।
সাধারণত স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন হলে রপ্তানিকারক ও প্রবাসীরা লাভবান হন। কারণ আগের তুলনায় ডলারের বিপরীতে বেশি হারে টাকা পান তারা। এ ছাড়া দেশীয় পর্যটনশিল্প লাভবান হয়, সেই সঙ্গে রপ্তানি খাতে কর্মসংস্থান বাড়ে। তবে বাংলাদেশ বরাবরই রপ্তানির তুলনায় আমদানি খরচ বেশি। ফলে মুদ্রার অবমূল্যায়ন আমদানি খরচ আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। কারণ আমদানিকারকদের আগের তুলনায় বাড়তি অর্থ দিয়ে ডলার কিনতে হচ্ছে। আবার দেশের যেসব রপ্তানিকারক পণ্য উৎপাদনের জন্য কাঁচামাল আমদানি করেন, তারাও পড়েছেন বিপাকে। কারণ কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় পণ্য উৎপাদনের ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। এর চূড়ান্ত প্রভাব ভোক্তার জীবনযাত্রার ওপরই পড়ছে। কারণ তাদের পণ্য ও সেবা পেতে বাড়তি অর্থ খরচ করতে হচ্ছে। এ ছাড়া যারা জরুরি প্রয়োজনে বিদেশ ভ্রমণে যাচ্ছেন, তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মো. হাবিবুর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবসহ সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় পৃথিবীর অনেক দেশই তাদের মুদ্রার ব্যাপক অবমূল্যায়ন করছে। আমরাও টাকার মান কম কমিয়েছি। তবে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে সেটি এখনো কম। উচ্চ আমদানি ব্যয়ের লাগাম টানা এবং রপ্তানিকারক ও রেমিটারদের উৎসাহ দিতেই টাকার অবমূল্যায়ন করা হয়েছে।
বাংলাদেশে ডলার ও টাকার বিনিময় হার স্বাধীনতার পর থেকে সরকার নির্ধারণ করে দিত। টাকাকে রূপান্তরযোগ্য ঘোষণা করা হয় ১৯৯৪ সালের ২৪ মার্চ। আর ২০০৩ সালে এই বিনিময় হারকে করা হয় ফ্লোটিং বা ভাসমান। এরপর থেকে আর ঘোষণা দিয়ে টাকার অবমূল্যায়ন বা পুনর্মূল্যায়ন করা হয় না। তবে বিনিময় হার ভাসমান হলেও পুরোপুরি তা বাজারভিত্তিক থাকেনি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সব সময়ই এতে পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ রেখে আসছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক এখনো ‘ম্যানেজড ফ্লোটিং রেট নীতি অনুসরণ করে আসছে। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার (১৭ মে) বাংলাদেশ ব্যাংক আন্তঃব্যাংকে ডলারের রেট নির্ধারণ করে ৮৭ টাকা ৫০ পয়সা। এরপর নতুন করে টাকার অবমূল্যায়ন করেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত বৃহস্পতিবার টাকা ও ডলারের আনুষ্ঠানিক বিনিময় হার ছিল ৮৭ টাকা ৫০ পয়সা। এক বছর আগে গত বছরের ১৯ মে এই বিনিময় হার ছিল ৮৪ টাকা ৮০ পয়সা। এ হিসাবেই গত এক বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে ২ টাকা ৭০ পয়সা বা ৩ দশমিক ১৮ শতাংশ।
যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারণ করা এই রেটে কোথাও ডলার মিলছে না। খোলাবাজারে গত মঙ্গলবার প্রতি ডলারের দাম সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে ১০২ টাকায় ওঠে। একদিন পর ব্যাংকেও নগদ ডলারের দামে সেঞ্চুরি হয়। তবে সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার ডলারের দাম কিছুটা কমে ১০০ টাকার নিচে নেমেছে। তার পরও আন্তঃব্যাংকে নির্ধারণ করা রেটের সঙ্গে খোলাবাজারে রেটের ব্যবধান এখনো ১০ টাকা বেশি।
ভারতীয় মুদ্রার বড় পতন : সাম্প্রতিক সময়ে ভারত সরকারও ডলারের বিপরীতে তাদের মুদ্রার ব্যাপক অবমূল্যায়ন করেছে। সবশেষ বৃহস্পতিবারও রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া বড় দরপতন করেছে রুপির। এখন ডলার ও ভারতীয় রুপির বিনিময় হার হচ্ছে প্রায় ৭৭ রুপি ৭২ পয়সা। এক বছর আগে ২০২১ সালের ১৯ মে ছিল ৭৩ রুপি ২২ পয়সা। এ হিসাবেই ডলারের বিপরীতে রুপির মান কমেছে ৬ দশমিক ১৪ শতাংশ। জানা যায়, রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের কয়েকদিন পর এ বছরের মার্চ মাসে প্রথমবারের মতো রুপির দামের রেকর্ড সর্বনিম্ন হার ছুঁয়ে যায়। এর পর থেকে ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের মাধ্যমে রুপিকে রক্ষা করেছে। সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি, পিটিআই ও রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, চীনের করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে লকডাউন ঘোষণায় নিরাপদ বিনিয়োগের শঙ্কা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং উচ্চ সুদের হারের শঙ্কায় বাজারে রুপির এমন দরপতন হয়। রুপির আরও দরপতন হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।
রেকর্ড পতনে পাকিস্তানি রুপিও : ডলারের বিপরীতে সবচেয়ে বেশি দরপতন হয়েছে পাকিস্তানের মুদ্রা রুপির। পাকিস্তানে এক ডলার কিনতে ব্যয় করতে হচ্ছে ২০১ রুপি ১৫ পয়সা। মুদ্রার এত বড় দরপতন এর আগে কখনো দেখেনি দেশটি। এক বছর আগে ২০২১ সালের ১৮ মে লাগত ১৫২ রুপি ৮৯ পয়সা। এ হিসাবে এক বছরে পাকিস্তানের মুদ্রা রুপির মান কমেছে ৩১ দশমিক ৫৬ শতাংশ। বিশ্লেষকদের মতে, চাহিদার তুলনায় বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ কম, বিশ্বব্যাপী নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে দেশটির অর্থনীতিতে।
অন্যান্য মুদ্রার পতন : আর্থিক সংকটে চরম দুর্দশাগ্রস্ত দেশ শ্রীলংকার রুপির দরপতন হয়েছে সবচেয়ে বেশি, রেকর্ড ৮৩ শতাংশ। এ ছাড়া ইউরোর দরপতন হয়েছে ১৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ। ব্রিটিশ পাউন্ডের ১২ দশমিক ২৪ শতাংশ। জাপানি ইয়েনের ১৫ দশমিক ৪৪ শতাংশ। চীনের মুদ্রা চায়না ইয়ানের ৪ দশমিক ৯৮ শতাংশ। আর নেপালি রুপির ৫ দশমিক ৮৩ শতাংশ।