বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : নদীর ওপর দিয়ে নয়, সুড়ঙ্গপথে চলবে যানবাহন। এ এক স্বপ্ন। কিন্তু সে স্বপ্ন বাস্তব হয়ে যেতে আর বেশি সময় অপেক্ষা নয়। চলতি বছরের মধ্যেই চালু হয়ে যাবে কর্ণফুলীর তলদেশে নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধু টানেল। ছিল অনেক চ্যালেঞ্জ। এখন সেই চ্যালেঞ্জ আর নেই। স্বপ্ন যখন বাস্তব হয়ে যায়, তখন তা রূপ নেয় গর্বে। টানেল চালু হওয়ার মধ্য দিয়ে বন্দরনগরীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে পাল্টে যাবে আনোয়ারাসহ দক্ষিণ চট্টগ্রাম। তখন দু’পাড়েই হবে শহর। গড়ে উঠবে শিল্প কারখানা, সৃষ্টি হবে কর্মসংস্থান।
চীন থেকে আনা বোরিং মেশিনের মাধ্যমে কর্ণফুলীর তলদেশ ফুটো করে প্রায় আড়াই বছর আগে যে সুড়ঙ্গ পথ সৃষ্টির কাজ শুরু হয়েছিল তা এখন শেষদিকে। ওই বছরের আগস্ট মাসে শেষ হয় প্রথম টিউবের কাজ। এরপর গতবছরের অক্টোবর মাসে দ্বিতীয় টিউব। এতেই নদীর দুপাড়ের মুখ খুলে যায়। এরপর শুরু হয় সড়ক নির্মাণ, আলোকায়নসহ আনুষাঙ্গিক কাজগুলো। চ্যালেঞ্জিং আসল কাজ শেষ হয়ে যাওয়ায় বাকি থাকে প্রধানত যান চলাচলের উপযোগী অবস্থা তৈরি করা।
প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এরমধ্যে শেষ হয়েছে ৮৮ শতাংশ কাজ। বাকি আছে আর মাত্র ১২ শতাংশ। সকল প্রতিকূল অবস্থা কেটে যাওয়ায় বাকি কাজটুকু নির্ধারিত মেয়াদের মধ্যেই শেষ করা হবে বলে আশা করা হচ্ছে। সে লক্ষ্যেই কাজ করছেন তারা। মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম শুক্রবার চট্টগ্রামে এসে প্রশাসনের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। সভার পর সাংবাদিকদের বলেন, এ বছরের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু টানেল চালু করা হবে। একটি টিউব অক্টোবরের শেষে খুলে দেয়া হবে। বাকি টিউব উন্মুক্ত হবে ডিসেম্বরের মধ্যে। তার এ বক্তব্যেই পরিষ্কার যে, ডিসেম্বরের মধ্যে টানেল পুরোপুরি চালু হয়ে যাবে। তিনি বলেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এ রকম একটি চ্যালেঞ্জিং কাজ শেষ করতে পারা একটি বড় সাফল্য। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর ওপরে এখন একটি সেতু রয়েছে, যা শাহ আমানত সেতু হিসেবে পরিচিত। কালুরঘাট এলাকায় আরেকটি সেতু থাকলেও সেটি শতবর্ষ প্রাচীন রেলসেতু। শিল্পায়ন ও পর্যটনের দিক বিবেচনা করে কর্ণফুলীর মোহনা অর্থাৎ পতেঙ্গা এলাকায় আরেকটি সংযোগ তৈরি করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে সরকার। কারণ, আনোয়ারা, কর্ণফুলীসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামে রয়েছে বিরাট শিল্প সম্ভাবনা। কিন্তু এ নদীতেই অবস্থান চট্টগ্রাম বন্দরের।
পিলার সেতু হলে পলি জমে নাব্য যদি হারায় কর্ণফুলী, তবে বন্দর অচল হয়ে যাবার সমূহ আশঙ্কা। সে বিবেচনায় গ্রহণ করা হয় কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ প্রকল্প। দক্ষিণ এশিয়ায় নদীর তলদেশে সড়ক টানেল আর নেই। বাংলাদেশের মতো একটি দেশ এমন একটি টানেল নির্মাণ করতে পারবে, তা ছিল একটি স্বপ্ন। কিন্তু সরকারের বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসিকতায় এ প্রকল্প গ্রহণ এবং বাস্তবায়নের শেষ পর্যায়ে। বর্তমান সরকারের আমলে প্রচুর উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে, তারমধ্যে কর্ণফুলী টানেল একটি অনন্য স্থাপনা হয়ে থাকবে। প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, কর্ণফুলীর তলদেশে দুটি টিউবের মাধ্যমে হবে দুইলেন করে মোট চারলেন সড়ক। প্রতিটি টিউবের দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার। তবে টানেলের মোট দৈর্ঘ্য হবে ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। এরসঙ্গে থাকছে দু’পাড়ে সংযোগ সড়ক। এরমধ্যে শহর প্রান্তে সিটি আউটার রিং রোড এবং আনোয়ারা প্রান্তে প্রায় ১০ কিলোমিটার সড়ক, যা কক্সবাজার মহাসড়কের সঙ্গে মিলিত হবে। মহেশখালীর মাতারবাড়িতে নির্মিত হচ্ছে গভীর সমুদ্র বন্দর। এ টানেলে যোগাযোগ স্থাপিত হবে সেই সমুদ্র বন্দরের সঙ্গেও।
স্বপ্নের এ প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় হচ্ছে ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি ৪২ লাখ টাকা। এরমধ্যে বাংলাদেশ সরকার দিচ্ছে ৪ হাজার ৪৬১ কোটি ২৩ লাখ টাকা এবং চীন সরকার থেকে সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা হিসেবে পাওয়া যাচ্ছে ৫ হাজার ৯১৩ কোটি ১৯ লাখ টাকা। প্রকল্পের কাজ শেষ করতে সময় ধরা হয়েছিল ২০২২ সালের জুন মাস। কিন্তু করোনা মহামারীর কারণে ধাক্কা খেতে হয় এ কাজে। চীন থেকে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নিয়ে আসা বাধাগ্রস্ত হয়। এছাড়া ছুটিতে যাওয়া চীনা প্রকৌশলী ও কর্মকর্তারা আটকা পড়ে যান মহামারীতে। তাছাড়া শুরুর দিকে ভূমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত জটিলতাও ছিল। কিন্তু এখন আর কোন প্রতিবন্ধকতা নেই। ফলে কাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে সমাপ্তির দিকে। নতুন করে নির্ধারণ করা সময়ের মধ্যেই কাজ শেষ করা সম্ভব হবে বলে আশা করছেন কর্মকর্তারা। টানেল চালু হলে এর রক্ষণাবেক্ষণ এবং টোল আদায়ের কাজটি করবে নির্মাণকারী চীনা প্রতিষ্ঠান। কর্ণফুলীর তলদেশে নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধু টানেল বা সুড়ঙ্গপথটি যাচ্ছে ১৮ থেকে ৩১ মিটার গভীরতায়।
পতেঙ্গা প্রান্ত থেকে শুরু হওয়া এ টানেল তলদেশ ফুঁড়ে বেরিয়েছে দক্ষিণ পাড়ের সিইউএফএল (চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড) এবং কাফকো (কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড) কারখানার মাঝামাঝি স্থান দিয়ে। দুই টিউব মিলে এ টানেলের প্রশস্ততা ৩৫ ফুট আর উচ্চতা হবে ১৬ ফুট, যার মধ্যদিয়ে বড় বড় যানবাহন অনায়াসেই পারাপার হতে পারবে। দুই টিউবের মধ্যে দূরত্ব ১২ মিটার। একটি টিউব থেকে আরেকটি টিউবে যাতায়াতের জন্য থাকছে বিশেষায়িত পথ, এ কাজটি বেশ জটিল ছিল। কিন্তু এখন আর সমস্যা নেই।