নিজস্ব প্রতিনিধি : পাবনায় পদ্মা নদীতে কুষ্টিয়ার বিটু নামের এক বালু ব্যবসায়ী ও তার লোকজন অবৈধ ভাবে পদ্মা নদীর পাবনা সীমান্ত থেকে ড্রেজার লাগিয়ে বালি অবৈধভাবে উত্তোলনের কারণে পাবনা সদও উপজেলার চরভবানীপুর, জয়েনপুর, খাস জয়েনপুর ও চরকুরুলিয়াসহ বেশ কয়েকটি গ্রামের শত শত বিঘা ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন গেছে। হুমকির মুখে পড়েছে নদীপাড়ের ফসলী জমিসহ চরাঞ্চলের বসবাসরত মানুষের বাড়ি-ঘর,মসজিদ-মাদ্রাসা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
গত পহেলা আগষ্ট সোমবার পদ্মা নদীতে পাবনা-কুষ্টিয়া সীমানার বাংলাবাজার, চরকোষাখালী ও শিলাইদহ ঘাট থেকে পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রীজ পয়েন্ট পর্যন্ত সরেজমিনে নৌপথে ঘুরে দেখা যায় প্রায় অর্ধশত ছোট-মাঝারী ও বড় ড্রেজার মেশিন দিয়ে মাঝ নদী ও তীরের কাছাকাছি স্থান থেকে বালি উত্তোলন করা হচ্ছে। উত্তোলনের পর সেখান থেকে বালি বড় বড় বলগেড দিয়ে অন্যত্র স্থানান্তর ও বিক্রির উদ্দেশ্যে পাঠানো হচ্ছে। পাবনার বেড়া থেকে পাকশী হার্ডিঞ্জ পয়েন্টসহ পুরো পদ্মায় বড় বড় বালি বোঝাই বলগেডের সমারোহে পরিণত হয়েছে।
মাঝ নদীতে ৫০০০ ফুট, ৪০০০ ফুট, ৩০০০ ফুট ও ২৫০০ ফুট বালি বোঝাই বলগেডে থাকা বলগেড মালিক ও শ্রমিকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, পাবনা সদরের হেমায়েতপুর ইউনিয়নের ভবানীপুর পদ্মানদীর পয়েন্ট থেকে বালি বোঝাই করে তারা কুষ্টিয়ার বিভিন্ন ডাইকে নিয়ে যাচ্ছেন। আবার কেউ কেউ নৌপথে এই বালি পৌছে দিচ্ছেন বিক্রেতার কাছে। কে বালি কাটছেন এ বিষয়ে জানতে চাইলে তারা বলেন, মূলত এই বালির মালিক হানিফ সাহেবের মামা বিটু। তিনি বিভিন্ন বালি বিক্রেতার কাছে বিক্রি করে থাকেন। আমরা ভাড়ায় চালিত। তাদের কাছে পৌঁছে দেই মাত্র।
ভবানীপুরে পদ্মানদীর পাড়ের কলাচাষি ইসমাইল মন্ডল বলেন, নদীপাড়ের মানুষ আমরা, কলাই হচ্ছে এই চরের প্রধান ফসল। বালি দস্যুদের অব্যাহত বালি কাটার কারণে প্রতিদিন নদীগর্ভে চলে যাচ্ছে ফসলি জমি। এদের রুখে দেবার কে আছে। কথায় কথায় বৃষ্টির মতো গুলি ছুঁড়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে।
বাদাম চাষি আব্দুল কুদ্দুস বলেন, প্রতিবছর কষ্ট করে ফসল ফলাই। ঘরে তোলার আগেই বালি দস্যুদের ছোবলে সর্বশান্ত হয়ে যাই। ফসল আর ঘরে তুলতে পারিনা। এদের বিরুদ্ধে কোন কথাই বলা যায় না। বালি উত্তোলন বন্ধের কথা মুখে আনার সাথে সাথে হানিফ সাহেবের ভাগ্নে সন্ত্রাসীদের নিয়ে এসে আমাদের উপর জুলুম চালায়। গুলি করে। মারধর করে বাড়িঘর তছনচ করে শাসিয়ে চলে যায় যায়।
কলা চাষি আসলাম প্রামানিক বলেন, চরাঞ্চল ও নদীপাড়ের মানুষের জীবন কিভাবে চলে সেটা আপনাদের না জানা নয়। দেশ বর্তমানে অনেক আধুনিক হয়েছে। তবুও আমরা নানা সমস্যা জর্জরিত। কিন্তু প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে এই বালি উত্তোলন। আমাদেরকে প্রতিনিয়ত সর্বশান্ত ও হুমকির মুখে ফেলেছে। প্রভাবশালী রাজনৈতিক ছত্রছায়া আর আত্মীয়তার বন্ধনে হয়তো এদে রুখে দেয়া সম্ভব নয়। সরকারের এই দস্যুদের কঠোর হস্তে দমন জরুরী হয়ে পড়েছে।
শাকিল মালিথা বলেন, আমরা আজ এই বালি দস্যুদের কবলে পড়ে চরম অসহায় ও নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে পড়েছি। কোন কিছু বললেই অস্ত্রের ঝনঝনানি। হুমকি ধামকি ও প্রাণনাশের চেষ্টা। হাজার হাজার বিঘা জমিসহ ফসল নদীগর্ভে চলে গেলেও এরা কোন মানবিক নয়। থামছে না। এদের থামাতে সরকারের অতিদ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
নদীতে মৎস্যজীবীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, বালি দস্যুরা তাদের মাছ শিকারের বাধা দিচ্ছে। তাদের ধারণা, মাছ শিকারের আড়ালে এরা কোন সংস্থার লোক কিনা এই কারণে মাঝে মধ্যে নদীতে নামতেও দেয় না।
পদ্মা নদীতে মাছ শিকার কালে ৫০ বছর বয়সের এক মৎস্যজীবি বলেন, পেটের তাগিদে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে নদীতে নেমেছি মাছ ধরতে। মাছ ধরতে না পারলে খাবো কি। যারা বালি তুলছে মাঝে মধ্যেই ছোট ছোট ইঞ্জিন চালিত বোট ও স্পীডবোট নিয়ে এসে আমাদের দিকে সুচারু দৃষ্টি দেয়।
শিলাইদহ ঘাটে স্থানীয় একাধিকজনের সাথে আলাপকালে তারা বলেন, ক্ষমতাধর নেতার আত্মীয়স্বজনদের অত্যাচারে আমরা পাবনা সীমানার মানুষরা অসহায় হয়ে পড়েছি। পাবনা সীমানায় তাদের রাজত্ব তৈরী করেছে। এখানকার বালি অবৈধ ভাবে তুলে নিয়ে যায় কুষ্টিয়া সীমানায়। কোন কিছু বললেই ঝামেলা পাকিয়ে চলে যায়।
তাদের কথা ধরেই নৌপথ ধরে যাওয়া হয় কুষ্টিয়া সীমানায়। নদীর পাড়ে দেখা মেলে অসংখ্য বালির ডাইক। সেখান থেকে এসকেভেট দিয়ে ড্রাম ট্রাকসহ বালি সরবরাহের বিভিন্ন গাড়ীতে বালি তুলে দেয়া হচ্ছে। বালি ডাইকের কয়েকজনের সাথে আলাপ করার চেষ্টা হলেও তারা কথা বলতে চাননি। উল্টো সেখান থেকে চলে যাওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সরকারি ভাবে বৈধ ইজারা নেয়া জনৈক ইজারাদার বলেন, কোটি কোটি টাকা দিয়ে সরকারের কাছ থেকে বালি উত্তোলনের ইজারা নিয়ে আমরা আজ সর্বশান্ত। সরকারি রেটে বালি বিক্রি করতে পারছি না। অথচ প্রভাবশালীরা অবৈধ ভাবে বালি কেটে স্বল্প মূল্যে বিক্রি করার আমাদের বালি বিক্রি বন্ধ হয়ে গেছে। প্রতিদিন কমপক্ষে ৩ লাখ টাকার ক্ষতি হচ্ছে দাবী জানিয়ে ওই বালি মহালের ইজারাদার বলেন, অবিলম্বে সরকারি ভাবে অবৈধ বালি উত্তোলন বন্ধ করতে হবে।
পাবনা সদরের সহকারী কমিশনার (ভূমি) কায়ছার আহমেদ বলেন, কয়েকদিন আগেই সেখানে খবর পেয়ে অভিযান চালিয়ে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করা হয়। বন্ধ করে দেয়া হয় অবৈধ ভাবে বালি উত্তোলন। নৌপথে অভিযান চালানোর কারণে প্রশাসন যাওয়ার আগেই বালি দস্যুরা সটকে পড়ে। ফলে আমাদের অভিযান সফল করতে পারিনা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন জনপ্রতিনিধি বলেন, পাবনার হেমায়েতপুরের ভবানীপুরস্থ পদ্মা নদীতে কুষ্টিয়া থেকে এসে যারা বালি কাটে তারা ৪০/৫০টি ড্রেজার একসাথে করে কাটে। খুব দ্রুত স্বল্প সময়ে অধিক পরিমান বালি কাটে। প্রশাসনের অভিযানের খবর আগেই তাদের কাছে পৌছে যায়। মুহুর্তের মধ্যে ড্রেজারগুলো নিরাপদ স্থানে নিয়ে যায়। সেখানে থাকে না কোন অস্তিত্ব।
স্থানীয়দের অভিযোগ, অবৈধ ভাবে এই বালু উত্তোলন ও বিক্রির সাথে সরাসরি নৌ পুলিশের কতিপয় অসৎ কর্মকর্তাদের হাত রয়েছে। এ ব্যাপারে নৌ পুলিশের ঈশ^রদীস্থ পদ্মা নদীর দেখভালে নিয়োজিত কর্মকর্তা গোলাম মোস্তফা জানান, পাকশীস্থ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প এলাকার ৭ কিলোমিটারের মধ্যে কোন বালি উত্তোলনের সুযোগ নেই। এছাড়াও অবৈধ ভাবে যেখানেই বালি উত্তোলন করা হচ্ছে সেখানেই অভিযান পরিচালনা করে বন্ধ করে আইনগত পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।
পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রীজ ও পাশর্^বর্তী কয়েকটি স্থানে অবৈধ ভাবে বালু উত্তোলনের বিষয়ে তিনি বলেন, সেগুলো অনেক আগেই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। নৌ পুলিশের সাথে এই অবৈধ বালু দস্যুদের যোগসূত্রতার বিষয়ে তিনি এড়িয়ে গিয়ে বলেন, এ ধরণের কথার কোন ভিত্তি নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রুপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের আশপাশে ৭ কিলোমিটারের মধ্যে কোন বালি কাটা যাবে না এমন পরিপত্র জারি করা হয়। পরিপত্র উপেক্ষা করে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্ট ও আশপাশে অবৈধ ভাবে বালি উত্তোলন চলছিল। ১৫/২০ দিন আগে সেটি বন্ধ করে দিয়েছে। তবে হার্ডিঞ্জ ব্রীজের তলদেশ সংলগ্ন স্থানে অন্য স্থান থেকে বালি এনে সেখানে ডাইক করে বিক্রি করা হচ্ছে।
হেমায়েতপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন মালিথ বলেন, কুষ্টিয়ার প্রভাবশালীদের কাছে আমরা বড় অসহায় হয়ে পড়েছি। আমি চেয়ারম্যান থাকাকালে অনেকবার চেষ্টা করেও বন্ধ করতে পারিনি। তিনি বলেন, শুনেছি আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এক নেতার আত্মীয় পরিচয় দিয়ে এই অপকর্ম করা হচ্ছে। এলাকার স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে এবং ভূমি সম্পদের স্বার্থে এই বালি উত্তোলন বন্ধের জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
অভিযোগের ব্যাপারে মুঠোফোনে একাধিক বার যোগাযোগ করা হলেও অবৈধ ভাবে বালি উত্তোলনকারী বিটু ফোন রিসিভ করেননি। এ কারণে তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পাবনার জেলা প্রশাসক বিশ্বাস রাসেল হোসেন বলেন, মাঝে মধ্যেই সেখানে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অভিযান চালানো হচ্ছে। বালি দস্যুদের আটক করে ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে অর্থদন্ডে দন্ডিত করা হচ্ছে। ড্রেজার বা বলগেড জব্দ করা হচ্ছে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি কোন বক্তব্য না দিয়ে অফিসে যোগাযোগ করতে বলেন। বক্তব্যের জন্য গণমাধ্যম কর্মিরা তার কার্যালয়ে গেলেও তাঁর ব্যস্ততার কারণে কোন বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি । সর্বশেষে তিনি মুঠোফোনে জানিয়েছে এটা কুষ্টিয়া সিমান্ত এলাকা ।