নিজস্ব প্রতিনিধি : চা বাংলাদেশের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ফসল। সিলেটের সবুজে ঘেরা নয়নাভিরাম চা বাগানের দৃশ্য দেখে আমাদের চোখ জুড়িয়ে যায়, অথচ এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখার জন্য যে চা শ্রমিকরা দিনরাত দুর্বিষহ পরিশ্রম করে যাচ্ছে, তাঁদের খোঁজখবর আমরা জানি না। নামীদামী ব্যান্ডের চা খেয়ে আমরা যারা আমাদের প্রাত্যহিক সকালের যাত্রা শুরু করি এবং সেইসাথে সজীবতার নিঃশ্বাস নেই তারা কয়জনই বা জানি এসকল মানুষদের নিষ্পেষিত জীবনব্যবস্থার কথা। কয়জনই বা জানি এই চা উৎপাদন করতে গিয়ে চা শ্রমিকদের কি পরিমাণ হাড়ভাঙা শ্রম দিতে হয়! চা গাছ ছেঁটে ছেঁটে ২৬ ইঞ্চির বেশি যেমন বাড়তে দেওয়া হয় না তেমনি বাড়তে দেওয়া হয় না লেবার লাইনে চা শ্রমিক এবং তাদের বসবাসের জন্য বরাদ্ধকৃত জায়গা। বাড়তে দেয়া হয় না বাগান কর্তৃপক্ষ থেকে ২২২ বর্গফুটের অর্থাৎ ৮ হাত বাই ১২ হাতের ছাউনিকেও। বাস্তবিক অর্থে যারা চা শ্রমিকের জীবনযাত্রা কাছ থেকে দেখেছেন তারাই কেবল বলতে পারবেন চা বাগানে সবুজের ছায়াঘেরা ভাণ্ডারে কতটা অমানবিক ও কষ্টের জীবন কাটাতে হয় শ্রমিকদের।
অধিকারবঞ্চিত এই চা শ্রমিকদের রয়েছে করুণ ইতিহাস। ইংরেজরা ১৮৩৮ সালে ভারতবর্ষে চা চাষের সূচনা করে। পরবর্তীতে ১৮৫৪ সালে মালনীছড়া চা বাগানের মাধ্যমেই এ অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে চায়ের চাষ শুরু হয়। চা শিল্প যেহেতু একটি শ্রমঘন শিল্প, তাই সস্তা শ্রম নিশ্চিত করতে তৎকালীন ইংরেজ বণিকরা প্রতারণার মাধ্যমে আজীবন কাজ করার শর্তে চুক্তিবদ্ধ করে মধ্য ভারতের দারিদ্র্য ও দুর্ভিক্ষপীড়িত আদিবাসী গোষ্ঠী এবং উড়িষ্যা, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, মাদ্রাজ ও উত্তরপ্রদেশ এবং বাকুঁড়া অঞ্চলের চাষীদেরকে চা শ্রমিক হিসেবে সংগ্রহ করে। তাদেরকে এই বলে প্রতারণা করা হয়েছিল যে আসামের বাগানে গাছ নাড়ালে টাকা পড়ে। এরপর প্রায় ১৭০বছর কেটে গেছে, কিন্তু ভাগ্য ফেরেনি এই হতদরিদ্র চা শ্রমিকদের।
দেশে দীর্ঘ সময় ধরে বসবাসরত চা শ্রমিকরা শ্রমে ঘামে প্রায় প্রতিবছর চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেলেও তাদেরকে ছাড়ে না বঞ্চনা আর অভাব। সময়ের গতিধারায় দ্রব্যমূল্য পাল্লা দিয়ে বাড়লেও তাদের মজুরি সেভাবে বাড়ে না। প্রতিদিন ১২০ টাকা মজুরি নিয়ে জীবন কাটাতে হয় চা শ্রমিকদের। তাদের মজুরি নির্ধারণের জন্য মালিকপক্ষ ও শ্রমিকপক্ষের মধ্যে দুই বছর অন্তর অন্তর দ্বিপাক্ষিক চুক্তি হয়। তবে ২০১৯ সালে সরকারের পক্ষ থেকে নিম্নতম মজুরি বোর্ড গঠন করা হয় যারা এই দুপক্ষের আলোচনার প্রেক্ষিতে মজুরি নির্ধারণ করে থাকে। কিন্তু দেখা যায়, এ দ্বিপাক্ষিক চুক্তির সময় শ্রমিক প্রতিনিধিদের মতামত অগ্রাহ্য করে মালিকপক্ষ একতরফাভাবে মজুরি নির্ধারণ করে। এক্ষেত্রে মজুরি বোর্ডের সদস্যরাও নির্বিকার থাকেন। ফলে দিন দিন দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়লেও, আশানুরূপ মজুরি বাড়ছে না চা শ্রমিকদের।
বাংলাদেশ চা সংসদ (মালিকপক্ষ) ও বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের মধ্যে সর্বশেষ চুক্তি হয় ২০২০ সালের ১৫ অক্টোবর (যা ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর) এবং শ্রমিকদের দৈনিক ন্যূনতম মজুরি ঠিক করা হয় ‘এ’ শ্রেণির বাগানের জন্য ১২০ টাকা, ‘বি’ শ্রেণির বাগানের জন্য ১১৮ টাকা এবং ‘সি’ শ্রেণির বাগানের জন্য ১১৭ টাকা (চা বাগানগুলোর বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতার উপর ভিত্তি করে এই ক্যাটাগরি করা হয়ে থাকে)। চুক্তি অনুযায়ী এরপর মালিকপক্ষ ও শ্রমিকপক্ষের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে বাজার দরের সাথে মিল রেখে মজুরি বৃদ্ধির কথা থাকলেও পেরিয়ে গছে দীর্ঘ নয় মাস, কিন্তু মজুরি বাড়ে নি তাদের। বর্তমানের দ্রব্যমূল্যের এই উর্ধগতির সময় ১২০ টাকা মজুরি কোনভাবেই কাম্য নয়। এজন্য এই চুক্তি কালক্ষেপনের প্রতিবাদে এবং দৈনিক মজুরি ৩০০ টাকা করার দাবি নিয়ে গত ৫ দিন ধরে সিলেট বিভাগের সব কয়টি চা বাগানে চা শ্রমিকরা ‘বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন’ এর নির্দেশে কর্মবিরতি ও প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করছে। তাই তাদের এ ন্যায্য দাবির প্রতি সংহতি জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালেরয় সাধারণ শিক্ষার্থীবৃন্দ ১৬ ই আগস্ট, ২০২২ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবস্থিত রাজু ভাস্কর্যের সামনে একটি প্রতিবাদ সভা ও মানববন্ধনের আয়োজন করেছে।
বাংলাদেশের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আপনি চা শ্রমিকদের এই ন্যায্য দাবির প্রতি সংহতি জানাবেন এবং অংশগ্রহন করে উক্ত কর্মসূচিকে সফল করে তুলতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবেন।