বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : দক্ষিণের দ্বীপজেলা ভোলার গ্যাস নিয়ে বড় একটি পরিকল্পনা বাস্তবায়নে হাত দিয়েছে সরকার। এই পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য পাইপলাইনের মাধ্যমে ভোলার গ্যাস দেশের মূল ভূখণ্ডে আনা। এই লক্ষ্যে ভোলায় তিনটি নতুন কূপ (টবগি-১, ইলিশা-১ ও ভোলা নর্থ-২) খনন শুরু করছে রাশিয়ান কোম্পানি গ্যাজপ্রম। গতকাল শুক্রবার থেকে এই খননকাজ শুরু হয়ে গেছে।
পাশাপাশি ভোলা থেকে বরিশাল হয়ে খুলনা পর্যন্ত একটি এবং পদ্মা সেতুর জাজিরা প্রান্ত পর্যন্ত আরেকটি পাইপলাইন করার জন্য মার্কিন কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জিকে আহ্বান জানিয়েছে পেট্রোবাংলা। পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান এই প্রতিবেদককে বলেছেন, এক্সিলারেট এনার্জি তাঁদের আহ্বানে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। ইতিমধ্যে তারা পাইপলাইন স্থাপনের ব্যয়, রুট নির্ধারণসহ সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের প্রস্তুতি শুরু করেছে।
নতুন কূপ খনন কেন: প্রায় ২৫ বছর আগে ভোলা গ্যাসক্ষেত্রটি আবিষ্কার করে রাষ্ট্রীয় কোম্পানি বাপেক্স। তারপর থেকে এখন পর্যন্ত সেখানে ছয়টি কূপ খনন করা হয়েছে। এই ছয়টি কূপের দৈনিক মোট উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ১২০ মিলিয়ন (১২ কোটি) ঘনফুট। কিন্তু বিদ্যমান দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বর্তমানে ভোলায় দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৪৫ থেকে ৫০ মিলিয়ন ঘনফুট। ফলে তিনটি কূপ থেকে গ্যাস তুলে সেখানকার চাহিদা মেটানো হচ্ছে। অবশিষ্ট তিনটি কূপ অলস পড়ে আছে।
তাহলে এখন আরও তিনটি কূপ খনন কেন? কারণ, দেশের মূল ভূখণ্ডে আনার জন্য ভোলায় কী পরিমাণ গ্যাস মজুত থাকতে পারে, তা নির্ধারণ করা প্রয়োজন। এ জন্য সেখানকার বিদ্যমান ছয়টি কূপের বাইরেও অনুসন্ধান কূপ খনন অপরিহার্য। ভোলায় এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত গ্যাসের মজুত নির্ধারণ করা হয়েছে প্রায় দেড় টিসিএফ (ট্রিলিয়ন ঘনফুট)। কিন্তু দীর্ঘ পাইপলাইনে সমগ্র দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ২০-২৫ বছর সরবরাহের জন্য এই গ্যাস যথেষ্ট নয়। তাই নতুন অনুসন্ধান কূপ খনন করে ভোলার প্রকৃত মজুত সম্পর্কে জানা প্রয়োজন।
মজুত সম্পর্কে আশাবাদ: আমাদের দেশে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য দুটি ভূতাত্ত্বিক কাঠামো সম্ভাবনাময়। এর একটি সুরমা বেসিন, অন্যটি বেঙ্গল বেসিন। বৃহত্তর সিলেট, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নরসিংদীসহ যেসব এলাকায় বিদ্যমান সব গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে, তারা সুরমা বেসিনের অন্তর্ভুক্ত। মূলত ওই অঞ্চলেই অনুসন্ধান, আবিষ্কার ও উত্তোলন করে আসা হয়েছে।
সেই তুলনায় বেঙ্গল বেসিনে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান অবহেলিত বা উপেক্ষিতই রয়ে গেছে। ফলে একমাত্র ভোলা ছাড়া বেঙ্গল বেসিনে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো আবিষ্কার হয়নি। অথচ ভূতাত্ত্বিক, ভূপদার্থবিদ, বিশেষজ্ঞ গবেষক ও প্রকৌশলীরা বেঙ্গল বেসিনকে অত্যন্ত সম্ভাবনাময় মনে করেন। তাঁদের মতে, এই বেসিনভুক্ত ভোলা এবং তার আশপাশের মনপুরাসহ অন্যান্য দ্বীপাঞ্চল, মেঘনা নদীবক্ষ, শরীয়তপুর প্রভৃতি অঞ্চলের গ্যাসের সম্ভাব্য মজুত দেশের জ্বালানি খাতের চেহারা বদলে দিতে পারে। তাঁরা মনে করেন, দেশে এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত গ্যাসের চেয়ে অনাবিষ্কৃত মজুত বেশি। শুধু প্রয়োজন অনুসন্ধান করে তা আবিষ্কার করা।
সুতরাং নতুন অনুসন্ধান কূপ খননের মাধ্যমে ভোলায় গ্যাসের আবিষ্কৃত মজুত যে বাড়বে, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাই মোটামুটি নিশ্চিত। তাই আশা করা যায়, ভোলা অঞ্চলের গ্যাস দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের তো বটেই, সমগ্র দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের চিত্র পাল্টে দেবে।
ব্যয় নিয়ে বিতর্ক: গ্যাজপ্রমকে এই তিনটি কূপ খননের কাজ দেওয়া হয়েছে অস্বাভাবিক উচ্চমূল্যে। প্রতিটি কূপ প্রায় ২১ দশমিক ২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দামে। এত বেশি দামে এখন পর্যন্ত এ দেশে কোনো কূপ খনন হয়নি। বেশি দাম দেওয়ার যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছে, ভোলা ক্ষেত্রে গ্যাসের চাপ (রিজার্ভার প্রেশার) বেশি, ৪ হাজার ৫০০ থেকে ৫ হাজার পিএসআই। ফলে সেখানে কূপ খনন ঝুঁকিপূর্ণ। তা ছাড়া, এ কাজের জন্য গ্যাজপ্রমকে ড্রিলিং কন্ট্রাক্টরসহ ছয়টি প্রকৌশল সেবা (ডিএসটি, সিমেন্টিং, মাড লগিং, ওয়্যারলাইন লগিং, টেস্টিং অ্যান্ড কমপ্লিশন) সংগ্রহ করতে হবে। কোভিড-১৯-এর কারণে সমুদ্র ও আকাশপথে চলাচল স্বাভাবিক না থাকায় মালামাল ও জনবল আনা-নেওয়ার ব্যয়ও বাড়বে।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই কূপগুলো অন্য যেকোনো কোম্পানি খনন করলেই উক্ত প্রকৌশল সেবাগুলো তাদেরও একই প্রক্রিয়ায় সংগ্রহ করতে হতো। আর এ কাজের জন্য বিদেশ থেকে হাজার হাজার টন মালামাল আনা কিংবা শত শত লোক আনা-নেওয়ারও কোনো বিষয় নেই, যাতে প্রতিটি কূপ খননের পেছনে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ব্যয় বেড়ে যাবে। কাজটা করাও হচ্ছে কোভিড-১৯-পরবর্তী প্রায় স্বাভাবিক সময়ে। তা ছাড়া, বাপেক্স ওই কূপগুলো খনন করতে পারে। আগে করেছেও। কাজেই সেখানে এত দামে বিদেশি কোম্পানিকে কাজে লাগানো অযৌক্তিক। গ্যাজপ্রম এর আগেও ১৭টি কূপ খনন করেছে। তাতে তাঁদের ঠিকাদার ছিল আজারবাইজানের কোম্পানি এরিয়েল। এর প্রতিটি কূপের ব্যয় ছিল সর্বোচ্চ ১৯ এবং সর্বনিম্ন সাড়ে ১৬ মিলিয়ন ডলার।
২০১৮ সালের ৩০ আগস্ট বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের জন্য বর্তমান তিনটি কূপ খননের যে প্রস্তাব সারসংক্ষেপ আকারে পাঠায়, তাতে স্পষ্ট উল্লেখ করা হয় যে, গ্যাজপ্রম ‘হ্রাসকৃত মূল্যে’ এই তিনটি কূপ খনন করবে। প্রধানমন্ত্রী সেই প্রস্তাব অনুমোদন করেন। কিন্তু এখন তিনটি কূপের যে চুক্তিমূল্য চূড়ান্ত করা হয়েছে, তা বাংলাদেশে গ্যাস কূপ খননে সর্বোচ্চ মূল্যের রেকর্ড করেছে। গ্যাজপ্রমকে এই কাজ দেওয়া হচ্ছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনের আওতায়, অযাচিত (আনসলিসিটেড) প্রস্তাবের ভিত্তিতে। এই তিন কূপের কাজ পাওয়ার জন্য গ্যাজপ্রমের পক্ষে তদবিরকারী (লবিস্ট) সক্রিয় ছিল বলে সংশ্লিষ্ট মহলে সুবিদিত।
ভোলা-খুলনা পাইপলাইন: সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী, ভোলা থেকে নদীর তলদেশ দিয়ে পাইপলাইন যাবে বরিশাল। সেখান থেকে যাবে খুলনা পর্যন্ত। এই পাইপলাইনের একটি অংশ ফরিদপুর অঞ্চলের সুবিধাজনক কোনো স্থান থেকে যাবে পদ্মা সেতুর জাজিরা প্রান্ত পর্যন্ত। ঢাকা থেকে একটি পাইপলাইন যাবে পদ্মা সেতুর মাওয়া প্রান্তে। পরে এ দুই অংশ যুক্ত হয়ে জাতীয় গ্যাস গ্রিডে একটি রিং তৈরি করবে।
এ ছাড়া, কলকাতা বন্দর থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে আরএলএনজি (রিগ্যাসিফাইড এলএনজি) আনার প্রকল্পটি দীর্ঘদিন পর আবার পুনরুজ্জীবিত করা হয়েছে। ওই পথে এলএনজি এনে যুক্ত করা হবে বরিশাল থেকে খুলনায় যাওয়া পাইপলাইনে।
দেশের গ্যাসক্ষেত্র উন্নয়ন, গ্যাস উত্তোলন বাড়ানো এবং শক্তিশালী ও দেশব্যাপী বিস্তৃত গ্যাস নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের এই ধরনের প্রকল্প বলা যায় এটাই প্রথম। এর সুষ্ঠু বাস্তবায়ন জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা ও আর্থসামাজিক উন্নয়ন নিঃসন্দেহে ত্বরান্বিত করবে।