বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : সমুদ্রপথে যেসব পণ্য আমদানি করা হয় তার ৫০ শতাংশ বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের জাহাজে পরিবহন করার বাধ্যবাধকতা আছে। এ জন্য বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ছয়টি জাহাজও কিনেছে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন (বিএসসি)। কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এ বাধ্যবাধকতা মানছে না। এসব পণ্য বিদেশি জাহাজে করে আনতে গিয়ে লাখ লাখ ডলার ভাড়া দিতে হচ্ছে।
ডলারসংকট শুরুর তিন মাস পর বিএসসি এখন এ বিষয়ে আলোচনা তুলেছে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি), বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি), বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি), খাদ্য অধিদপ্তর প্রতিবছর আমদানি করা পণ্য পরিবহন খাতে লাখ লাখ ডলার ব্যয় করছে। ডলারসংকটে থাকায় এখন বিষয়টি সরকারি কর্মকর্তাদের নজরে এসেছে। শীর্ষ কর্মকর্তাদের নির্দেশে বিএসসির জাহাজে পণ্য পরিবহন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে।
এই লক্ষ্যে বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ স্বার্থ রক্ষা আইন, ২০১৯ অনুযায়ী, সরকারি তহবিলের অর্থে পরিবাহিত পণ্য বিএসসির মাধ্যমে পরিবহন নিশ্চিত করতে গতকাল রবিবার নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে বৈঠক হয়েছে। আন্ত মন্ত্রণালয়ের এই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন নৌপরিবহনসচিব মোস্তফা কামাল।
বৈঠকে খাদ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসসির প্রতিনিধি সরাসরি অংশ নেন। অনলাইনে যুক্ত হয়েছিলেন মন্ত্রিপরিষদ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ, বিপিসির প্রতিনিধিরা। বৈঠকে অনলাইনে ও সরাসরি অংশ নেওয়ার সুযোগ রাখা হয়। তবে কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কোনো প্রতিনিধি এতে অংশ নেননি। বৈঠকে যোগ দিতে তাঁদের চিঠি দেওয়া হয়েছিল।
বৈঠক শেষে নৌপরিবহনসচিব মোস্তফা কামাল কালের কণ্ঠকে বলেন, বিপিসি এখন থেকে রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী জাহাজে তেল পরিবহন করবে। এ জন্য বিএসসির সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখবে। সরকারের সঙ্গে সরকারের (জিটুজি) চুক্তির মাধ্যমে যে তেল কেনা হবে তার বেশির ভাগ বিএসসির জাহাজে আনা হবে।
বৈঠকে উপস্থিত একাধিক সদস্য কালের কণ্ঠকে বলেন, বিদ্যমান আইন ও বিধিমালার আলোকে দেশি জাহাজে পণ্য পরিবহনের জন্য বিএসসির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর বাণিজ্যিক চুক্তি করা প্রয়োজন; কিন্তু সরকারি সংস্থাগুলো সেটা করছে না। বিপিসি দেশি জাহাজে তেল পরিবহনের কথা বললেও বৈঠকে এ বিষয়ে চুক্তি নিয়ে কোনো কিছু বলেনি। এ ছাড়া কৃষি ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের কোনো প্রতিনিধি বৈঠকে না থাকায় গম, চাল ও সার আমদানির বিষয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো আলোচনা হয়নি।
জানা যায়, এর আগে ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ স্বার্থ রক্ষা আইন, ২০১৯ অনুযায়ী, সরকারি তহবিলের অর্থে সমুদ্রপথে পরিবাহিত পণ্য বিএসসির মাধ্যমে নিশ্চিত করতে আন্ত মন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় দেশি জাহাজে তেল পরিবহন নিশ্চিত করতে ১১ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিকে ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা ছিল; কিন্তু সেই প্রতিবেদন এখনো জমা দেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (সংস্থা) নজরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, আগের কমিটি কোনো প্রতিবেদন জমা দেয়নি। তাই গত বৈঠকের সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। তবে ডলারসংকট কাটিয়ে ওঠার কৌশল থেকে এই বৈঠক আয়োজন করা হয়। বিপিসি তাদের পরিশোধিত করা পুরো তেল বিদেশি জাহাজে আমদানি করে থাকে। এটা যেন বিএসসির মাধ্যমে করে সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
জানা যায়, ২০২১ সালের কমিটির কার্যপরিধি ছিল বিপিসির খাতে রিফাইন্ড প্রডাক্ট অয়েল আমদানি প্রক্রিয়া সমজাতীয় পদ্ধতিতে পরিবর্তন করে বিএসসির বিদ্যমান তিনটি প্রডাক্ট অয়েল ট্যাংকারের মাধ্যমে পরিবহনের বিষয়ে পর্যালোচনা করা। সমুদ্রপথে পরিবাহিত ক্রুড অয়েল, পরিশোধিত জ্বালানি তেল এবং কয়লা পরিবহন ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত বিষয়ে বিপিসি, বিসিপিসিএল এবং বিআইএফপিসিএল বা অপরাপর প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিএসসির বিদ্যমান কাজের পদ্ধতি, চুক্তিপত্র, আমদানি প্রক্রিয়া ও অবস্থা, কান্ট্রি ডিমান্ড, পণ্য পরিবহন সংক্রান্ত টেকনিক্যাল ও অপারেশনাল বিষয়ে বিবেচনা নিয়ে বিদ্যমান আইন বিধির আলোকে প্রস্তাবিত জাহাজগুলোর দীর্ঘমেয়াদি বাণিজ্যিক চুক্তি সম্পাদনের রূপরেখা প্রণয়ন করা। পণ্য পরিবহন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ এবং বিদ্যুৎ বিভাগের সঙ্গে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি সমঝোতা স্মারক সম্পাদনের লক্ষ্যে চুক্তি পদ্ধতি বা গাইডলাইন প্রণয়নের কাজ করা। কিন্তু গঠিত কমিটি এসংক্রান্ত কোনো প্রতিবেদনই জমা দেয়নি।
বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের নির্বাহী পরিচালক (বাণিজ্য) পীযুষ দত্ত কালের কণ্ঠকে বলেন, বিএসসির জাহাজে আনলে সরকারের ডলার সাশ্রয় হতো। তাই সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত পণ্য পরিবহনে এই নিয়ম মানা।
বিএসসি সূত্রে জানা যায়, সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের আমদানি পণ্য পরিবহন করতে ক্ষতিগ্রস্ত হলে সাধারণ বীমা করপোরেশনের মাধ্যমে প্রিমিয়াম দেওয়া হয়। এ জন্য দেশি বীমা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে। কিন্তু বিদেশি জাহাজ প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের দেশের সঙ্গে চুক্তি করেনি। তাই দেশীয় জাহাজে পণ্য পরিবহন না করায় ইনস্যুরেন্সের টাকাও অপচয় হচ্ছে।
জানা যায়, বিএসসির ছয়টি জাহাজের মধ্যে তিনটি অয়েল ট্যাংকার এবং তিনটি বাল্ক ক্যারিয়ার (খোলা পণ্য পরিবহন জাহাজ)। প্রতিটি জাহাজে ৩৯ হাজার মেট্রিক টন পণ্য পরিবহন করা যায়। ২০১৮ ও ২০১৯ সালে এসব জাহাজ কেনা হয়। এরপর ২০১৯ সালে বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ স্বার্থরক্ষা আইন পাস হয়। এ আইনে আমদানি পণ্য পরিবহনে ৫০ শতাংশ দেশি জাহাজে আনা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
বিএসসির পরিকল্পনা ছিল ২০২১ সালের মধ্যে দুটি মাদার অয়েল ট্যাংকার এবং দুটি মাদার বাল্ক ক্যারিয়ার জাহাজ কেনার। এসব জাহাজে ৮০ হাজার থেকে এক লাখ পণ্য পরিবহন করা যাবে। এ জন্য চীন সরকার ঋণ দিতে চেয়েছিল। বিএসসি বলছে, করোনা মহামারির কারণে এসব জাহাজ কেনা হয়নি। তবে দাতা সংস্থার সহযোগিতায় বা বৈদেশিক ঋণে শিগগিরই কেনা হবে। এ ছাড়া আরো কয়েকটি কনটেইনার জাহাজ কেনার পরিকল্পনা আছে সংস্থাটির।
সম্প্রতি খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেছিলেন, পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়া চাহিদা অনুযায়ী গম আমদানি করতে পারছি না। দেশীয় জাহাজে আনতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু দীর্ঘদিন বিদেশি জাহাজে চাল ও গম পরিবহন করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) শাহ মো. ইমদাদুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, সার আমদানির সময় পরিবহন ব্যবস্থা নিয়ে বিএসসির সঙ্গে নিয়মিত আলোচনা হয়। তবে সক্ষমতা না থাকায় তাদের জাহাজে সার আমদানি করা যায় না।
জানা যায়, বিপিসি, বিসিআইসি, বিএডিসি ও খাদ্য অধিদপ্তর স্বাধীনতার পর থেকে বিদেশি জাহাজে পণ্য পরিবহন করছে। এ জন্য যেসব প্রতিষ্ঠান পণ্য সরবরাহ করছে তারাই গ্রুপিং করে বিদেশি জাহাজে পণ্য দেশে পৌঁছে দিচ্ছে। এতে আমদানি ও পণ্য সরবরাহ দুইভাবে লাভবান হচ্ছে তারা। দীর্ঘদিন এ প্রক্রিয়া চলতে থাকায় এ পদ্ধতি বাদ দেওয়া যাচ্ছে না। আবার বিএসসির জাহাজেরও সংকট রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, আমদানি করা পণ্য পরিবহন করার মতো সক্ষমতা বিএসসির নেই। তা ছাড়া বিপিসি যাদের কাছ থেকে তেল আমদানি করে, তারাই জাহাজ সরবরাহ করে থাকে। তাই চাইলেও তেল আমদানিতে দেশি জাহাজ ব্যবহারের সুযোগ নেই। তবে বিএসসির নির্বাহী পরিচালক (বাণিজ্য) পীযূষ দত্তের দাবি, তাঁদের সক্ষমতা ধীরে ধীরে বাড়ছে। সামনে আরো বড় পরিকল্পনা আছে।