সমুদ্র পরিবহনে এগোচ্ছে দেশ বাড়ছে দেশি পতাকাবাহী বিদেশগামী জাহাজ

বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : সমুদ্র পরিবহনে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এগিয়ে আসছেন নতুন নতুন বিনিয়োগকারী। স্বাধীনতা পরবর্তীসময় থেকে ২০১৯ সালের শুরু পর্যন্ত বাংলাদেশি পতাকা বহন করতো সমুদ্রগামী ৪৩টি জাহাজ। সরকারি সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোয় গত তিন বছরে নতুন করে যোগ হয়েছে আরও ৪৮টি জাহাজ। বর্তমানে লাল-সবুজ পতাকাবাহী বিদেশগামী জাহাজের সংখ্যা ৯১টি। এতে বিদেশের মাটিতে যেমন উজ্জ্বল হচ্ছে দেশের নাম, তেমনি বাড়ছে বৈদেশিক মুদ্রা আয়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদেশগামী জাহাজে দেশীয় পতাকা অন্তর্ভুক্তি বৈদেশিক মুদ্রা আয়ে যোগ করবে নতুন মাত্রা। চলমান রিজার্ভ সংকট কাটাতেও এ খাত অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।

জানা যায়, বাংলাদেশ আমদানিনির্ভর দেশ হলেও রপ্তানিতেও পিছিয়ে নেই। দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের ৯০ শতাংশের বেশি হয় সমুদ্রপথে। দেশি জাহাজের স্বল্পতার কারণে আমদানি ও রপ্তানির বেশিরভাগ পণ্য বিদেশি পতাকাবাহী জাহাজে বহন করা হয়। এসব পণ্য পরিবহনে বড় অংকের বৈদেশিক মুদ্রা চলে যেত বিদেশে।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০১৩ সালের পর থেকে খরচ পোষাতে না পেরে অনেক জাহাজ স্ক্র্যাপ (উন্নত ইস্পাত পণ্যের বর্জ্য) হিসেবে বিক্রি করে দেন উদ্যোক্তারা। এরপর বাংলাদেশি পতাকাবাহী ৬৮টি জাহাজ থেকে কমতে কমতে ৪০-এ নেমে আসে। তবে বিগত বছরগুলোতে দেশে মেগাপ্রকল্পের কারণে উন্নয়ন উপকরণ কিংবা কাঁচামাল আমদানি বেড়ে যায় কয়েকগুণ। বিশেষ করে পাথর, সিমেন্ট ক্লিংকার, স্ক্র্যাপের পাশাপাশি এলপিজি আমদানি বাড়ে। যে কারণে পণ্য পরিবহনের জন্য জাহাজ সংগ্রহে হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগে আগ্রহী হয়ে ওঠেন বড় বড় উদ্যোক্তা। এরই মধ্যে দেশের বড় বড় শিল্প গ্রুপ সংগ্রহ করেছে বড় বড় জাহাজ।

নৌ-বাণিজ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশের পতাকাবাহী ৯১টি জাহাজ বিভিন্ন পণ্যসহ গ্যাস, তেল পরিবহন করে আসছে। একেকটি জাহাজ ৩০ হাজার থেকে এক লাখ টন পর্যন্ত পণ্য পরিবহনে সক্ষম। এর মধ্যে আটটি রয়েছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের মালিকানাধীন। অন্য জাহাজগুলোর মধ্যে গত তিন বছরে নতুন করে নিবন্ধন নিয়েছে ৪৮টি জাহাজ। বর্তমানে বাংলাদেশি পতাকাবাহী বিদেশগামী এসব জাহাজে তিন হাজারের মতো নাবিক বিভিন্ন পদে কর্মরত।

সূত্রমতে, বর্তমানে দেশি পতাকাবাহী ছয়টি কনটেইনার জাহাজ চলাচল করছে। এই ছয়টি জাহাজের মালিক বাংলাদেশের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কর্ণফুলী গ্রুপের এইচ আর লাইন্স। জাহাজগুলো একত্রে ১০ হাজার টিইইউ’স (টোয়েন্টি-ফুট ইকুইভালেন্ট ইউনিট) কনটেইনার পরিবহনে সক্ষম। এর মধ্যে দুটি রুটে এই জাহাজগুলো চলাচল করে। এমভি এইচআর হেরা ও এমভি এইচআর রেয়া জাহাজ চলে বাংলাদেশ এক্সপ্রেস সার্ভিস (বিইএস) হিসেবে চট্টগ্রাম-সিঙ্গাপুর-পোর্ট কালাং রুটে। প্রতি সপ্তাহে একবার চলাচল করে জাহাজ দুটি। অন্যদিকে এমভি এইচ আর ফারহা, এমভি এইচআর আরাই, এমভি এইচআর সাহারি ও এমভি এইচআর সারেরা চলাচল করে চট্টগ্রাম কলম্বো এক্সপ্রেস (সিসিই) নামে চট্টগ্রাম-কলম্বো রুটে। এই রুটে জাহাজগুলো সপ্তাহে দুবার যাওয়া-আসা করে।

এইচআর শিপিং লাইন্সের অপারেশন এক্সিকিউটিভ মো. সাইফুল্লাহ জাগো নিউজকে বলেন, চট্টগ্রাম সিঙ্গাপুর পোর্ট কালাম রুটে দুটি এবং চট্টগ্রাম-কলম্বো রুটে চারটি জাহাজ চলাচল করছে। মূলত ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরগুলো থেকে মাদার ভ্যাসেলে আসা কনটেইনার পরিবহন করা হয় আমাদের জাহাজগুলোতে।

ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিশ্বে এখন শিপিং খরচ বেড়ে গেছে। বুকিং দিয়েও জাহাজ পাওয়া যাচ্ছে না। এতে লিড টাইম বেড়ে যাচ্ছে। বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শিপিং কস্ট ও লিড টাইম কমিয়ে আনতে ইউরোপের সঙ্গে সরাসরি সমুদ্রপথে সংযোগ চালু করেছে বাংলাদেশ। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চট্টগ্রাম থেকে সরাসরি কনটেইনার নিয়ে জাহাজ চীন, পর্তুগাল, স্লোভেনিয়া, ইতালি, সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কার কলম্বো, মালয়েশিয়া, স্পেন যাচ্ছে। এসব রুটে ২৫ কোম্পানির ৮৫টি জাহাজের দেড় লাখ কনটেইনার বহনের সক্ষমতা রয়েছে। এখানে বাংলাদেশি জাহাজের জন্য ব্যবসা করার মতো বড় একটি বাজার রয়েছে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।

বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক শাহেদ সারোয়ার জাগো নিউজকে বলেন, ‘সমুদ্রগামী জাহাজগুলো বাংলাদেশে নিবন্ধিত হওয়ায় বাংলাদেশের পতাকা ব্যবহার করার বিষয়টি খুবই ইতিবাচক। একদিকে জাহাজগুলো থেকে আয় বৈদেশিক মুদ্রা হিসেবে বাংলাদেশে আসছে, অন্যদিকে বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ হওয়ার কারণে বিশ্বে বাংলাদেশের মর্যাদাও বাড়ছে।’

তিনি বলেন, ‘আগে কনটেইনার পরিবহনের জন্য যে ফ্রেইট (জাহাজভাড়া) দেওয়া হতো, তার মধ্যে চার শতাংশ ভ্যাট বাদে সব টাকা বিদেশি জাহাজের মালিকরা পেত। এতে দেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা চলে যেত বিদেশে। এখন বিদেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসছে। আবার দেশি পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে দেশের টাকা দেশেই রয়ে যাবে। এতে লাখ লাখ ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে বাংলাদেশের। তাতে চলমান বৈদেশিক মুদ্রা সংকটেও ইতিবাচক প্রভাব তৈরি করবে।’

নৌ-বাণিজ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও সরকারি ফি পাওয়ার ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সনদ জারি করছে নৌবাণিজ্য অধিদপ্তর। এরই মধ্যে অনলাইনে এনওসি ও ওয়েভার সেবা দিচ্ছে সমুদ্রগামী জাহাজের নিবন্ধন প্রদানকারী চট্টগ্রামে দেশের একমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠানটি।

নৌ-বাণিজ্য দপ্তরের প্রিন্সিপাল অফিসার ক্যাপ্টেন মো. গিয়াসউদ্দিন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাংলাদেশ উন্নত বিশ্বের কাতারে চলে আসছে। ধারাবাহিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে সমুদ্র বাণিজ্যেও ধীরে ধীরে সক্ষমতা বাড়ছে। সমুদ্রগামী জাহাজে বিনিয়োগে এগিয়ে আসছে বড় বড় বিনিয়োগকারীও। বিশেষ করে সরকারি সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর ফলে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছে। যে কারণে গত পৌনে তিন বছরে নতুন করে ৪৮টি জাহাজ নিবন্ধন নিয়েছে। এর মধ্যে কনটেইনার ও এলপিজিবাহী জাহাজ রয়েছে। এখন এসব জাহাজ দেশি লাল-সবুজের পতাকা বহন করেই বিদেশে যাতায়াত করবে।’

তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন মেরিন একাডেমি রয়েছে আমাদের দেশে। আরও বেশি দক্ষ নাবিক তৈরির জন্য বর্তমান সরকার মেরিন একাডেমির সংখ্যা বাড়িয়েছে। বর্তমানে ছয়টি একাডেমি রয়েছে। এসব একাডেমি থেকে দক্ষতা অর্জন করে সমুদ্রগামী জাহাজে সুনামের সঙ্গে কাজ করছে বাংলাদেশের নাবিকরা। বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজের সংখ্যা বাড়লে নাবিকদের কর্মসংস্থানও বাড়বে। আবার দেশি জাহাজে আমদানি-রপ্তানির পণ্য পরিবহন বাড়লে বৈদেশিক মুদ্রারও সাশ্রয় হবে।’

জাহাজ
Comments (0)
Add Comment