বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : করোনার অভিঘাত আর ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে বিশ্ব অর্থনীতির অবস্থা টালমাটাল। দেশের অর্থনীতি নিয়েও নানা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা রয়েছে। এর মধ্যেও আশা জাগাচ্ছে বৈদেশিক বিনিয়োগ, উন্নয়ন সহযোগীদের অর্থছাড়, রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি, আমদানি ব্যয় কমে আসা এবং ডলারের মূল্যে কিছুটা স্থিতিশীলতা। সেই সঙ্গে সরকারের ব্যয় সংকোচন নীতি ও নানামুখী তৎপরতায় অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে মনে করছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, বেশকিছু খাদ্যদ্রব্যের দাম বড় ধাপে কমতে শুরু করেছে। আরও বেশকিছু নিত্যপণ্যের দাম কমার তালিকায় যুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। ইতোমধ্যে ডলারের আকাশছোঁয়া মূল্য বেশখানিকটা নেমে স্থিতিশীল পর্যায়ে পৌঁছেছে। এছাড়া অর্থনীতির কয়েকটি সূচকে উন্নতি ইতিবাচক। তবে এই ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। কারণ এক মাসের উন্নতিতে বলা যাবে না যে অর্থনীতির গতিধারা ঘুরে গেছে।
এদিকে সরকারের নীতি-নির্ধারকদের দাবি, বৈশ্বিক সংকটে ডলার ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি এবং এর প্রভাবে নিত্যপণ্যের বাজারে যে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়েছিল, আগামী এক মাসের মধ্যেই তা অনেকাংশে কেটে যাবে। ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প খাতসহ দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে শিগগিরই সুবাতাস বইবে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকার প্রবৃদ্ধি অর্জনের চেয়ে মূল্যম্ফীতি নিয়ন্ত্রণে জোর দিচ্ছে। এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির প্রকল্পগুলোকে গুরুত্ব বিবেচনায় এ, বি ও সি ক্যাটাগরিতে ভাগ করে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ ক্যাটাগরির প্রকল্পের বাস্তবায়ন স্থগিত করা হয়েছে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ডক্টর এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যায়যায়দিনকে বলেন, ব্যয় কমাতে সরকার ইতোমধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে কম অগ্রাধিকারের প্রকল্প বাস্তবায়ন স্থগিত করেছে। গাড়ি কেনা স্থগিত, বিদেশ ভ্রমণ কমানোসহ নানা উদ্যোগ নিয়েছে। এসব কারণে এখন হয়তো ব্যাংক ঋণের দরকার হচ্ছে না। বর্তমান পরিস্থিতিতে এই ব্যয় সংকোচন নীতি সঠিক বলে তিনি মনে করেন।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের বেশ কিছু উদ্যোগের ফলে সাম্প্রতিক সময়ে রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধির পাশাপাশি আমদানি ব্যয়ও কিছুটা কমেছে। এতে করে ডলারের ওপর চাপ কমায় মুদ্রা বাজার কিছুটা স্থিতিশীলতার দিকে আসছে।
ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ডক্টর আহসান এইচ মনসুর যায়যায়দিনকে বলেন, সরকার ও বাংলাদেশ
ব্যাংকের নেওয়া বেশকিছু সিদ্ধান্ত খুবই ইতিবাচক ছিল অর্থনীতির জন্য। এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। সুফল পাওয়া যাবে সামনের মাসগুলোতে। তবে এভাবে আমদানি বন্ধ রেখে কতদিন চলতে পারবে তা নিশ্চিত নয়। বিলাস পণ্য আমদানিতে যে বাধা তা নিয়মিত পর্যবেক্ষণে রাখার কথা বলেন তিনি।
অর্থনীতিবিদ ডক্টর সেলিম রায়হান বলেন, সরকার আমদানি ও রপ্তানি তদারকির যে কার্যক্রম পরিচালনা করছে তা অব্যাহত রাখতে হবে। একই সঙ্গে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বিশ্ববাজারে কমে আসা পণ্যের দামের প্রভাব যাতে দ্রম্নত দেশের বাজারে দেখা যায়, সেদিকে নজর দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
আগামী দিনগুলোতেও রপ্তানি বাড়ার আশা করছেন দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাকশিল্প-মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ। তিনি যায়যায়দিনকে বলেন, নানা ধরনের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যেও দুই মাসে সার্বিক রপ্তানিতে ২৫ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অবশ্যই একটা ভালো দিক। তৈরি পোশাক রপ্তানিতেও প্রবৃদ্ধি ২৬ শতাংশের বেশি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে এই প্রবৃদ্ধি আমাদের আশান্বিত করেছে। এই সংকটের সময় রেমিট্যান্সের পাশাপাশি রপ্তানি আয় বাড়াটা খুবই দরকার ছিল। এর মধ্য দিয়ে আগামীতে রিজার্ভ বাড়বে। ডলারের বাজারে যে অস্থিরতা চলছে, সেটাও কেটে যাবে বলে আশা করছি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, সংকটময় অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা চলছে। রেমিট্যান্স বাড়ানোর জন্য প্রণোদনাসহ নানা সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের নানা পদক্ষেপের কারণে আগস্ট মাসে দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে।
তিনি আরও বলেন, তারা বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছেন, যা এখন কাজ করছে বলে উলেস্নখ করেন তিনি। একই সঙ্গে চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই রেমিট্যান্সের ইতিবাচক ধারা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এই সময়ে রেমিট্যান্স বৃদ্ধির খুবই দরকার ছিল। নানা পদক্ষেপের কারণে আমদানি ব্যয় কমতে শুরু করেছে। রপ্তানির পাশাপাশি রেমিট্যান্স বৃদ্ধির কারণে আশা করছি এখন মুদ্রাবাজার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে।
রেমিট্যান্স ও রপ্তানি
এদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, চলতি বছরের সদ্যবিদায় হওয়া মাস আগস্টে ২০৩ কোটি ৮০ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। গত বছরের আগস্টে এসেছিল ১৮১ কোটি ডলার। সে হিসাবে গত বছরের একই সময়ের ব্যবধানে রেমিট্যান্স বেড়েছে ১২ দশমিক ৬ শতাংশ। চলতি বছরের জুলাই মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ২০৯ কোটি ডলার।
অন্যদিকে, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের মতো রপ্তানি আয়েও সুবাতাস বইছে। গত আগস্ট মাসে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে ৪৬০ কোটি ৭০ লাখ ডলার আয় করেছেন বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা।
ইপিবির তথ্যে দেখা যায়, ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয় মাস আগস্টে ৪৬০ কোটি ৭০ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছেন দেশের রপ্তানিকারকরা। লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৩০ কোটি ডলার। গত বছরের আগস্টে রপ্তানি হয়েছিল ৩৩৮ কোটি ৩১ লাখ ডলারের পণ্য। এ হিসাবেই লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেড়েছে ৭ দশমিক ১৪ শতাংশ। আর প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৬ দশমিক ১৮ শতাংশ। জুলাই মাসে ৩৯৮ কোটি ৪৮ লাখ ২০ হাজার (প্রায় ৪ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য রপ্তানি করছে বাংলাদেশ। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি করে ৫২ দশমিক শূন্য আট বিলিয়ন ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ। আগের অর্থবছরের (২০২০-২১) চেয়ে বেশি আয় হয়েছিল ৩৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৫৮ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি আয়ের লক্ষ্য ধরেছে সরকার।
উন্নয়ন সহযোগীদের অর্থছাড় : চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) হালনাগাদ তথ্যানুযায়ী, জুলাইয়ে মাসে বাংলাদেশে চলমান বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ৪৮ কোটি ৮০ লাখ ডলারের ঋণ ছাড় করেছে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ও দেশগুলো। দেশীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় ৪ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে অনুদান হিসাবে এসেছে ৯১ লাখ ২০ হাজার ডলার। আর ৪৭ কোটি ৮৯ লাখ ডলার ছাড় করা হয়েছে ঋণ হিসাবে। জুলাইয়ে ছাড় হওয়া এই বৈদেশিক ঋণ গত অর্থবছরের একই মাসের তুলনায় ১৫ কোটি ৯৩ লাখ ডলার বা ৪৮ শতাংশ বেশি। গত অর্থবছরের জুলাই মাসে ছাড় হয়েছিল ৩২ কোটি ৮৬ লাখ ডলার। গত অর্থবছরের ১২ মাসে রেকর্ড ১ হাজার কোটি ডলার বা ১০ বিলিয়ন ডলার ছাড় হয়েছিল। অবশ্য ওই অঙ্কের মধ্যে কোভিড- ১৯ মহামারি থেকে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য হওয়া বাজেট সহায়তার অর্থও ছিল। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় ঋণ ও অনুদান মিলে মোট ৯৩ হাজার কোটি টাকা বা প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার পাওয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছে।