বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : বিদেশে অর্থ পাচার প্রতিরোধে তুলে দেওয়া হচ্ছে মৌজার দরে জমি রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতি। এর বদলে রেজিস্ট্রেশন হবে মার্কেট বেজড (বাজারভিত্তিক) পদ্ধতিতে। অর্থাৎ যে দামে জমি কেনাবেচা হবে, সে দামেই হবে নিবন্ধন বা দলিল। বাজারভিত্তিক মূল্যে জমি রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতি কার্যকর করতে গত রোববার সাত সদস্যের একটি উপকমিটি গঠন করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। কমিটি আগামী পহেলা ডিসেম্বরের মধ্যে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবসহ প্রতিবেদন দাখিল করবে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের (এফআইডি) সচিবের কাছে।
সম্প্রতি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের (এফআইডি) সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকে উল্লিখিত উপকমিটি গঠন করা হয়। ওই বৈঠকে ভূমি মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয়, নিবন্ধন অধিদপ্তর এবং এনবিআরের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। উল্লেখ্য, জমি রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও রাজস্ব বাড়াতে বাজারভিত্তিক মূল্য পদ্ধতিটি নির্ণয় এবং বাস্তবায়নের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয় এফআইডি সচিবকে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।
এর আগে একই বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ২০১৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত চারটি বৈঠক করলেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি। জমির প্রকৃত বাজার ও মৌজা দরের তারতম্য দুর্নীতিকে উৎসাহিত করে জানিয়ে ২০২০ সালের ২৩ জুলাই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে একটি চিঠি দিয়েছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এতে বাজারমূল্য নির্ধারণ বিধিমালা সংশোধনের সুপারিশ করা হয়েছিল।
এছাড়া গত ১৫ জুন সরকারি ক্রয় কমিটির বৈঠকের পর অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, রাজধানীর গুলশান এলাকায় জমির যে দাম দেখিয়ে নিবন্ধন করা হয়, প্রকৃত দাম তার চেয়েও বেশি। কিন্তু বেশি দামে তো নিবন্ধন করানো যাচ্ছে না, প্রতিটি মৌজার জন্য দাম ঠিক করে দেওয়া আছে। সুতরাং কালোটাকা তো সেখানেই সৃষ্টি হচ্ছে। তিনি আরও বলেন-বাস্তবতা হচ্ছে, যে ফ্ল্যাট দুই কোটি টাকায় নিবন্ধিত হচ্ছে, সেটির প্রকৃত দাম ১০ কোটি টাকা। ফলে সরকার বাড়তি নিবন্ধন মাসুল পাচ্ছে না। ঢাকা শহরে যার জায়গা আছে কিংবা যে ব্যক্তি জায়গা কিনেছেন, শুধু তিনিই বলতে পারবেন, কত টাকায় নিবন্ধন হয়েছে এবং জমির প্রকৃত বাজারদর কত?
সূত্রমতে, জমির রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও রাজস্ব বাড়ানোর লক্ষ্যে বাজারভিত্তিক জমির নিবন্ধন মূল্য বাস্তবায়নে গঠিত উপকমিটির আহ্বায়ক হলেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের যুগ্মসচিব (কেন্দ্রীয় ব্যাংক) রুখসানা হাসিন এবং সদস্য সচিব উপসচিব (কেন্দ্রীয় ব্যাংক) মো. জেহাদ উদ্দিন। অন্য সদস্যরা হলেন ভূমি মন্ত্রণালয়, লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এবং নিবন্ধন অধিদপ্তরের প্রতিনিধি।
গঠিত কমিটিকে প্রয়োজনীয় সব তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে নিবন্ধন অধিদপ্তরকে। পাশাপাশি কমিটিকে সার্বিক সহায়তা করবে বিএফআইইউ। এ কমিটি জমি রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও রাজস্ব বাড়াতে বাজারভিত্তিক মূল্যে জমির নিবন্ধন পদ্ধতি বাস্তবায়নে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবসহ প্রতিবেদন তৈরি করবে।
নিবন্ধন অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে সারা দেশে জমি রেজিস্ট্রেশন বা নিবন্ধন হয়েছে ৩২ লাখ ১৩ হাজার ৫২৪টি। আর এই নিবন্ধন থেকে সরকার বছরে সাত হাজার থেকে আট হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় করছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, বাজার মূল্য পদ্ধতি করা হলে এ খাত থেকে সরকারের আয় বেড়ে দ্বিগুণের কাছাকাছি হবে।
জানতে চাইলে দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান সোমবার যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রে জমি যে মূল্যে বিক্রি হয়, তা নিবন্ধনে দেখানো হয় না। এতে এ খাতে কালোটাকা সৃষ্টি হয়। পরে তা বিদেশে পাচার করা হয়। এ অবস্থায় মৌজা অনুসারে জমির দাম তুলে দেওয়ার ব্যাপারে সরকারের সিদ্ধান্ত ইতিবাচক। এতে বিদেশে অর্থ পাচার কিছুটা হলেও প্রতিরোধ হবে। তবে তার মতে, অর্থ পাচার সবচেয়ে বেশি হয়, বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে। আমদানি-রপ্তানিতে জালজালিয়াতির মাধ্যমে এসব অর্থ পাচার হয়ে থাকে।
এটি বন্ধ করা জরুরি। তিনি বলেন, বাণিজ্যের আড়ালে এই অর্থ পাচার বন্ধে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
জানা গেছে, বর্তমানে মৌজা দর (রেট) অনুযায়ী সারা দেশে জমি কেনাবেচা এবং নিবন্ধন হচ্ছে। মৌজা দর হচ্ছে জমির সর্বনিম্ন একটি দর, অর্থাৎ মৌজা দরের চেয়ে কম দাম দেখিয়ে কেউ জমি কেনাবেচা করতে পারবেন না। মৌজা দর নির্ধারণের কাজটি হয় ‘সর্বনিম্ন বাজারমূল্য বিধিমালা’ অনুযায়ী। সারা দেশের বিভিন্ন এলাকার মৌজা দর সর্বশেষ নির্ধারণ করা হয় ২০১৬ সালে, এখনো সেই দরে নিবন্ধন চলছে। সে হিসাবে ঢাকার গুলশান সাবরেজিস্ট্রার কার্যালয়ের অধীন মৌজা আছে ১৪টি। এ ১৪ মৌজায় ৮ ধরনের জমি আছে। মৌজা দর অনুযায়ী ধরনভেদে এ এলাকার ১ শতাংশ জমির দাম ১ লাখ থেকে ৫৮ লাখ টাকা। কিন্তু গুলশানের কোথাও কোটি টাকার নিচে ১ শতাংশ জমি কেনাবেচা হয় না। ধানমন্ডি এলাকার মৌজা দর অনুযায়ী ১ শতাংশ জমির দাম ৪৩ লাখ ৯৩ হাজার ৩০০ টাকা। কিন্তু বাস্তবে ধানমন্ডির কোথাও এ দামে জমি বেচাকেনা হয় না।
এই জমি রেজিস্ট্রেশনের অন্তরালে এক ধরনের কৌশল অবলম্বন করা হয়। বিশেষ করে বেশি মূল্যের জমি কম দাম দেখিয়ে নিবন্ধন করা হচ্ছে। পরে ওই টাকা পাচার করা হয় বিদেশে। এ বিষয়টি উঠে আসে মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা এবং নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গঠিত জাতীয় সমন্বয় কমিটির সর্বশেষ বৈঠকে। গত ২৯ আগস্ট অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। সেখানে তিনি বলেছেন, উচ্চমূল্যের জমি অতি কম মূল্য দেখিয়ে বিপুল পরিমাণ বৈধ অর্থ অবৈধ হয়, যা কিনা পরে বিদেশে পাচারও হয়। বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ অনেক বৈঠক করলেও কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। তিনি আরও বলেন, দেশ থেকে পাচার হয়ে যাওয়া অর্থ উদ্ধার করে আনার চেয়ে পাচার রোধ করা ভালো। জমি নিবন্ধন বাজারভিত্তিক হলে মানি লন্ডারিং বা মুদ্রা পাচার কমে আসবে।
ওই বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেছেন, জমি নিবন্ধনের সময় প্রকৃত মূল্য না দেখানোর কারণে অনেক সময় বৈধ অর্থ অবৈধ হয়ে যায়। বাজারভিত্তিক লেনদেনের মাধ্যমেই এ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।