বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : দেশের সমুদ্রভ্রমণ পর্যটনকে বিশ্বমানে উন্নীত করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ জন্য সমুদ্র ও উপকূলীয় অঞ্চলের পরিবেশসহ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং পর্যটনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলা করে টেকসই সমুদ্রভ্রমণ পর্যটন উন্নয়ন নিশ্চিত করা হবে। এই লক্ষ্য নিয়ে সমুদ্রভ্রমণ পর্যটন নীতিমালার খসড়া তৈরি করা হয়েছে।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এই নীতিমালার খসড়া সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এবং বেসরকারি উদ্যোক্তাদের কাছে পাঠিয়েছে।
তাদের মতামত পাওয়ার পর শিগগিরই এই নীতিমালা চূড়ান্ত করা হবে। পর্যটন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, অবকাশযাপনের উদ্দেশ্যে প্রমোদতরিতে সমুদ্রের নির্দিষ্ট পথে যাত্রা এবং সমুদ্রতীরবর্তী পর্যটন আকর্ষণ উপভোগ করাই হচ্ছে সমুদ্রভ্রমণ পর্যটন। সুনীল অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত এই সমুদ্রভ্রমণ পর্যটন। বঙ্গোপসাগরে এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার উপকূলীয় সমুদ্রসীমা, উপকূলীয় নদী এবং নদীর মোহনা, দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত, বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনসহ সব মিলিয়ে দেশের সমুদ্রভ্রমণ পর্যটনের সম্ভাবনাকে আরো বিস্তৃত করেছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সমুদ্রভ্রমণ পর্যটন নীতিমালার মূল লক্ষ্য, বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে একটি সমুদ্রভ্রমণ পর্যটনের অন্যতম গন্তব্য হিসেবে গড়ে তোলা। এ জন্য সমুদ্রভ্রমণের পর্যটকদের সেবা সহজ করতে চালু করা হবে ওয়ান স্টপ সার্ভিস। তখন সমুদ্রভ্রমণে ১৩টি মন্ত্রণালয়ের সব সেবা পাওয়া যাবে একসঙ্গে।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে সমুদ্রভ্রমণ পর্যটনকে বিশ্বমানের করা হবে। উন্নয়ন পরিকল্পনা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এরই মধ্যে খসড়া নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে। তিনি বলেন, সমুদ্রভ্রমণ পর্যটনে থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরের মতো ভাসমান হোটেল-রেস্টুরেন্ট, অ্যাকোয়ারিয়ামসহ বিভিন্ন আকর্ষণীয় বিষয় থাকবে।
খসড়া নীতিমালা প্রণয়নে যুক্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সমুদ্রভ্রমণ পর্যটন আকর্ষণীয় করে তুলতে ওয়াটার স্কিয়িং, জেট স্কিয়িং, সার্ফিং, সি কায়াকিং, স্কুবা ডাইভিং, সাঁতারের ব্যবস্থা থাকবে। এ ছাড়া উপকূলীয় এলাকায় পাখি, ডলফিন ও প্রকৃতি উপভোগ, সমুদ্রসৈকত, দ্বীপ ভ্রমণ, ভাসমান হোটেল-রেস্তোরাঁ, ফিশ অ্যাকোয়ারিয়াম, সূর্যস্নান, বিচ কার্নিভাল, জেলেপাড়া, শুঁটকিপল্লী, মৎস্য আড়ত উপভোগ ইত্যাদিও থাকবে।
বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের কালের কণ্ঠকে বলেন, সমন্বিত কোনো উদ্যোগ না থাকায় সমুদ্রভ্রমণ অনেক কঠিন হয়ে পড়েছে। ভারত, শ্রীলঙ্কাসহ কয়েকটি দেশের সঙ্গে সমুদ্রভ্রমণের চুক্তি থাকলেও সহজে চলাচল করা যায় না। তাই দেশি-বিদেশি পর্যটকদের সমুদ্রভ্রমণ সহজ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মোংলা, কর্ণফুলী ও পায়রা বন্দরে প্যাসেঞ্জার জেটি চালু করা হবে।
সমুদ্রভ্রমণ পর্যটন বাস্তবায়ন কৌশল : নতুন নীতিমালায় সমুদ্রভ্রমণ পর্যটন বাস্তবায়নের কৌশলও নির্ধারণ করা হয়েছে। পর্যটনকে আকর্ষণ করতে আধুনিক সুবিধাসংবলিত নতুন প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল তৈরি, স্টেকহোল্ডারদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মানবসম্পদ উন্নয়ন, ভিসানীতি সহজ করাসহ নানা উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
বিনিয়োগে উৎসাহী করতে প্রণোদনা : সমুদ্রভ্রমণ পর্যটনে বিনিয়োগে আকৃষ্ট করতে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের প্রণোদনা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ক্রুজশিপ কেনা, অ্যাকোয়ারিয়াম স্থাপন, ইকো-রিসোর্ট রূপান্তর, সমুদ্রসৈকতের কাছে প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল নির্মাণসহ বিভিন্ন বিনোদন ও সমুদ্র পর্যটনবান্ধব কার্যক্রমে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের প্রণোদনা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে খসড়া নীতিমালায়।
বিশ্ব কর্মসংস্থানে সমুদ্রভ্রমণ পর্যটন : জাতিসংঘের বিশ্ব পর্যটন সংস্থা (ইউএনডাব্লিউটিও) সমুদ্রভ্রমণ পর্যটনকে এসডিজিতে যুক্ত করেছে। যাতে সমুদ্রসম্পদের টেকসই ব্যবহার এবং সমুদ্রভিত্তিক বিনোদন কার্যক্রমের মাধ্যমে সমুদ্রভ্রমণ পর্যটন পরিচালনা করে দেশ ও জনগণের সুফল নিশ্চিত করা যায়। ইউএনডাব্লিউটিএর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৯ সালে বিশ্ব জিডিপি এবং বিশ্ব কর্মসংস্থানের সমুদ্রভ্রমণ পর্যটনের অবদান যথাক্রমে ৫ শতাংশ ও ৬-৭ শতাংশ। সমুদ্রভ্রমণ পর্যটন সুনীল অর্থনীতির অন্যতম প্রধান উপকরণ এবং প্রতিবেশ সংরক্ষণের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। এটিকে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবিকার বিকল্প উপায় এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও পরিবেশ উন্নয়নের নিয়ামক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, ২০২১ সালের জরিপ মতে জিডিপিতে পর্যটন খাতের অবদান ৩.০২ শতাংশ, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৭৭ হাজার কোটি টাকা। আর পর্যটকদের পছন্দের শীর্ষে আছে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত। সর্বোচ্চ ১৭ শতাংশ পর্যটক বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতটিতে ঘুরতে পছন্দ করেন।
ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সিলের (ডাব্লিউটিটিসি) তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে ২০১৯ সালে জিডিপিতে পর্যটন খাতের অবদান ছিল ২.৭ শতাংশ এবং কর্মসংস্থান ছিল ২.৯ শতাংশ।
বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড সূত্র বলছে, দেশে পর্যটনের মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়িত হলে জিডিপি এবং কর্মসংস্থান অনেক বাড়বে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের চেয়ারম্যান সন্তোষ কুমার দেব কালের কণ্ঠকে বলেন, সমুদ্রভ্রমণ পর্যটনে দেশে অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। বিশ্ব পরিমণ্ডলে সেটা ব্র্যান্ডিং করা যায়নি। কক্সবাজার, কুয়াকাটাসহ বিভিন্ন সমুদ্রভ্রমণ ব্র্যান্ডিং করা গেলে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা বাড়বে। এতে কর্মসংস্থানের পাশাপাশি অর্থনৈতিক লাভ হবে। তিনি বলেন, সমুদ্রভ্রমণে ১৩টি মন্ত্রণালয়ের সেবা নিতে হয়। এই সেবা পাওয়ার পথ সহজ করতে হবে। একই সঙ্গে অন-অ্যারাইভাল ভিসা বাড়াতে হবে এবং পুরোপুরিভাবে ই-ভিসা চালু করতে হবে।