বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : ব্যবসায়ীরা যখন নিত্যপণ্যের এলসি খুলতে সমস্যায় পড়ছেন, তখনই আগামী মার্চে শুরু হতে যাওয়া রমজানের চাহিদা মেটাতে সাতটি ভোগ্যপণ্য আমদানিতে ২৫০ কোটি ডলার ব্যয় করতে হবে বলে হিসাব করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া ব্যবসায়ীরা তাদের সমস্যাগুলো যাতে সরকারকে জানাতে পারেন, সেজন্য বড় ব্যবসায়ীদের নিয়ে একটি কো-অর্ডিনেশন কমিটি গঠন করার কথা ভাবছে বাণিজ্যমন্ত্রণালয়।
এই বাস্তবতায় দেশে নিত্যপণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে ব্যবসায়ীদের এলসি খুলতে যাতে কোনো সমস্যা না হয়, সেজন্য ‘ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট সেল’ গঠন করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সঙ্গে পবিত্র রমজান মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ ও সরবরাহ নিশ্চিত করতে আমদানিতে সর্বোচ্চ সহায়তা দিতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ জন্য ব্যাংকগুলোকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির ঋণপত্র (এলসি) সহজ করতে বলা হয়েছে।
গত রবিবার বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীদের নিয়ে গঠিত ‘বাণিজ্য সহায়ক পরামর্শক কমিটি’র সভায় আমদানি-রপ্তানিসহ দেশের সার্বিক ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়ে এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন তুলে ধরেন বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের মার্চ পর্যন্ত সময়ে ছোলা, মসুর ডাল, খেজুর, অপরিশোধিত সয়াবিন ও পাম তেল, চিনি ও গম আমদানিতে ২৫০ কোটি ডলার ব্যয় হবে।
আগামী মার্চে শুরু হতে যাওয়া রমজানে বাজার স্বাভাবিক রাখতে এ পরিমাণ পণ্য আমদানি প্রয়োজন বলে মনে করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে ৮১ কোটি ২ লাখ ডলার ব্যয়ে ২২.১৯ লাখ টন গম, ৯৭ কোটি ৪ লাখ ডলার ব্যয়ে ৭ লাখ টন ভোজ্যতেল এবং ৮ লাখ টন চিনি আমদানিতে ৩৮ কোটি ৫ লাখ ডলার ব্যয় হবে। এ ছাড়া ছোলা আমদানিতে ১৩ কোটি ৪৪ লাখ ডলার, খেজুর আমদানিতে ৫ কোটি ২৬ লাখ ডলার এবং মসুর ডাল আমদানিতে ১৪ কোটি ৬ লাখ ডলার ব্যয় হবে বলে জানান বাণিজ্য সচিব।
ওই সভায় বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, এলসি খোলাসহ ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন সমস্যার কথা জানিয়েছেন। এসব সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে জানানো হবেন। সমস্যা সমাধানে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, তা দ্রুত বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নেবে। তিনি বলেন, রোজায় ভোক্তাদের যাতে কষ্ট না হয়, সেজন্য প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির জন্য ব্যবসায়ীদের অনুরোধ করেছি।
রপ্তানিকারকরা সভায় জানিয়েছেন, ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি খুলতে তাদের সমস্যা হওয়ার কথা না থাকলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন সার্কুলার জারির কারণে নতুন করে সমস্যায় পড়ছেন তারা। সভায় উপস্থিত ছিলেন এমন একজন শীর্ষ রপ্তানিকারক জানান, গত ২০ অক্টোবর বাংলাদেশ ব্যাংক সার্কুলার জারি করে বলেছে যে, কোনো ব্যাংক নির্ধারিত সময়ে এলসি নিষ্পত্তি করতে ব্যর্থ হলে ওই ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াসহ অথরাইজড ডিলার (এডি) লাইসেন্স বাতিল করা হবে।
ওই রপ্তানিকারক বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে বিদেশি ক্রেতারা সময়মতো পণ্যের দাম দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে আমরাও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ব্যাক-টু-ব্যাক এলসির পেমেন্ট করতে পারছি না। আগের এলসির পেমেন্ট না করে নতুন করে কোনো ব্যাংকে ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি খুলতে গেলে ব্যাংকগুলো এলসি খুলতে রাজি হচ্ছে না।’ তবে বিষয়টি মানতে নারাজ বাংলাদেশ ব্যাংকের আব্দুর রউফ তালুকদার। কোনো পণ্য আমদানিতে বাধা নেওয়া হচ্ছে না, তবে কঠোর নজরদারি রয়েছে বলে সম্প্রতি এক সভায় তিনি জানান।
এদিকে গত রবিবার বাংলাদেশ ব্যাংকে অনুষ্ঠিত ব্যাংকার্স সভায় রমজানে নিত্যপণ্য আমদানিতে এলসি সহজ করার নির্দেশ দিয়েছেন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, ‘অর্থ পাচার রোধে অপ্রয়োজনীয় পণ্যের এলসি বন্ধ রাখা হয়েছে। আর রোজার সময় কোনো পণ্যের যাতে ঘাটতি না হয় এবং মূল্য স্থিতিশীল থাকে সে জন্য তেল, চিনি, ডাল ও ছোলার এলসি খুলতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
‘সভায় উপস্থিত ব্যাংকাররা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা মেনে চলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর কোনো নীতি-সহায়তা দরকার হলে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে দেওয়া হবে।’ মুখপাত্র বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মোতাবেক খাদ্যপণ্য উৎপাদন বাড়াতে কৃষি ঋণ বিতরণের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। গত চার মাসে ব্যাংকগুলো লক্ষ্যমাত্রার ৩৩ শতাংশ কৃষি ঋণ বিতরণ করেছে। এটা বাড়ানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত ২০২১-২২ অর্থবছরে পণ্য আমদানির জন্য মোট ৯২ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলারের নতুন এলসি খোলা হয়েছিল, যা এর আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩৭ দশমিক ৫৯ শতাংশ বেশি ছিল। গত অর্থবছরের পুরোটা সময়েই নতুন এলসি খোলার পরিমাণ বেশি হয়েছিল এলসি নিষ্পত্তির চেয়ে।
গত অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে নতুন এলসি খোলার পরিমাণ ছিল ২৮ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার, সেখানে নিষ্পত্তির পরিমাণ ছিল ২২ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন ডলার। চলতি অর্থবছরের অক্টোবর পর্যন্ত চার মাসে এলসি খোলার পরিমাণ হচ্ছে ২৪ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলার, সেখানে নিষ্পত্তি হয়েছে ২৭ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলারের।
অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘এখন যে দায় মেটানো হচ্ছে, তা গত এপ্রিল-মে মাস সময়ের খোলা এলসি। নতুন এলসি খোলার পরিমাণ কমেছে তার ফল আগামী ডিসেম্বর-জানুয়ারি নাগাদ পাওয়া যাবে। তখন দেখা যাবে এলসির নিষ্পত্তি ও খোলার পরিমাণ কাছাকাছিই চলে আসছে।’
এদিকে পুরনো এলসির দায় আপাততো না মিটিয়ে আগামী বছরের জুন পর্যন্ত সময় বাড়িয়ে নিতে উদ্যোক্তাদের সুযোগ দিয়ে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু ডলারের দাম বেড়ে যাওয়া ও সুদ ব্যয় এড়াতে উদ্যোক্তারা চাইছেন পুরনো দায় এখনই মেটাতে। এজন্য নতুন এলসি খোলার পরিমাণ বাড়লেও পুরনো দায় মেটাতে গিয়ে বাড়ছে ডলারের খরচ। এ প্রসঙ্গে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, ‘এখন যেসব এলসি নিষ্পত্তি হচ্ছে সেগুলো ৬ মাস বা এক বছর আগের খোলা।
অনেকগুলো ডেফার্ড (এলসির বিপরীতে প্রদেয় দায় পরিশোধের সময় বাড়িয়ে নেওয়া বা দেরিতে দেওয়া) এলসি। এর ফলে ব্যয় বাড়ছে। তারপরও পবিত্র রমজান মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ ও সরবরাহ নিশ্চিত করতে আমদানিতে সর্বোচ্চ সহায়তা দিতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এজন্য ব্যাংকগুলোকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির এলসি সহজ করতে বলা হয়েছে। এজন্য আমরা পণ্য আমদানিতে জোর দিয়েছি।’