বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : বিদ্যুৎ সংকটে টানা প্রায় ছয় মাস দুর্বিষহ সময় কাটিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। জুন-জুলাই মাসে যখন তীব্র গরমে নাকাল জনজীবন তখনই জ্বালানি সংকটে উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়া হয় ডিজেলচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো। শুধু তাই নয়, গ্যাসচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রেও কমিয়ে আনা হয় উৎপাদন। সংকট কাটাতে বাধ্য হয়ে লোডশেডিংসহ নানা ধরনের কৃচ্ছ্র নীতি গ্রহণ করতে হয় সরকারকে। তবে বছর শেষে যেন শুভ সূচনা হচ্ছে বিদ্যুৎ খাতের।
আমিনবাজার-গোপালগঞ্জ সঞ্চালন লাইন চালু হয়ে যাওয়ায় পায়রার বিদ্যুৎ যোগ হতে যাচ্ছে জাতীয় গ্রিডে। শুধু তাই নয়, বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, চলতি মাসেই উৎপাদনে যাবে রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম ইউনিট। ফলে বছরের শেষ সপ্তাহে রামপাল থেকেও বিদ্যুৎ যোগ হবে জাতীয় গ্রিডে। তবে আদানির বিদ্যুৎ ১৬ ডিসেম্বর আসার কথা থাকলেও বিদ্যুৎ বিভাগ জানিয়েছে, আগামী বছরের মার্চের আগে পাওয়া যাবে না।
এতে করে ওই সময়ের গ্রীষ্মের পিক চাহিদা অনেকটাই মিটবে আদানির বিদ্যুৎ থেকেও। সব মিলিয়ে ২০২৩ সাল বিদ্যুৎ খাত লোডশেডিংমুক্ত হবে বলেই আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
গত বৃহস্পতিবার পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেডের (পিজিসিবি) নবনির্মিত আমিনবাজার- গোপালগঞ্জ সঞ্চালন লাইনটি সফলভাবে চালু হয়েছে। ৪০০ কেভির লাইনটি গোপালগঞ্জ গ্রিড সাবস্টেশন প্রান্ত থেকে চালু করা হয়।
পিজিসিবি জানায়, গোপালগঞ্জ থেকে আমিনবাজার গ্রিড সাবস্টেশন পর্যন্ত লাইনটির দৈর্ঘ্য ৮২.৫ কিলোমিটার। যার মধ্যে পদ্মা নদীতে ৭.৫ কিলোমিটার রিভারক্রসিং রয়েছে। গোপালগঞ্জ থেকে আমিনবাজার লাইনটিতে মোট ২২৬টি টাওয়ার রয়েছে। তার মধ্যে খরস্রোতা পদ্মা পাড়ির জন্য নদীতে এবং নদীর দু’ প্রান্ত মিলে মোট ১১টি সুউচ্চ টাওয়ার নির্মাণ করা হয়েছে। নবনির্মিত লাইনটি চালু করায় ইতিপূর্বে নির্মিত পায়রা-গোপালগঞ্জ ৪০০ কেভি লাইন এবং গোপালগঞ্জ-মোংলা ৪০০ কেভি লাইন ঢাকার উপকণ্ঠের আমিনবাজার গ্রিড উপকেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত হলো।
এতে বৃহত্তর খুলনা ও বরিশাল অঞ্চলের সঙ্গে জাতীয় গ্রিডের সংযোগ শক্তিশালী ও অধিকতর নির্ভরযোগ্য হয়েছে উল্লেখ করে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন জনকণ্ঠকে বলেন, দেশজুড়ে যখন বিদ্যুৎ সংকট চরমে তখন সংশ্লিষ্ট সবার সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল সঞ্চালন লাইন। শুধু সঞ্চালন লাইন প্রস্তুত না হওয়ার কারণে উৎপাদনের পরও জাতীয় গ্রিডে যোগ করা যাচ্ছিল না পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদিত বিদ্যুৎ। শংকায় ছিল রামপালের বিদ্যুৎ নিয়েও।
তবে এবার কেটে যাচ্ছে সব শংকা। পদ্মার ওপর দিয়ে কাজ শেষে চালু হয়েছে আমিনবাজার-গোপালগঞ্জ ৪০০ কেভির ডাবল সার্কিট লাইনটি। এটি সফলভাবে উদ্বোধন হওয়ায় শুধু পায়রা নয়, রামপালের বিদ্যুৎও উৎপাদনের সঙ্গে সঙ্গেই জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে।
চলতি বছরের ২১ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের সর্বোচ্চ উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন ১ হাজার ৩শ’ ২০ মেগাওয়াট পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উদ্বোধন করেন। পরিবেশবান্ধব আল্ট্রা-সুপারক্রিটিক্যাল প্রযুক্তিসহ কয়লাভিত্তিক এই তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম ইউনিট থেকে ৬৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু হয় ২০২০ সালে এবং দ্বিতীয়টি ২০২১ সালের ডিসেম্বরে উৎপাদন শুরু করে।
তবে সঞ্চালন অবকাঠামো নির্মাণ শেষ না হওয়ায় কেন্দ্রটির পুরো বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা এতদিন কাজে লাগানো যায়নি। এখন যেহেতু সঞ্চালন লাইনটি চালু হয়েছে তাই শীঘ্রই জাতীয় গ্রিডে পুরো ১ হাজার ৩শ’ ২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যোগ হবে জানিয়ে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিইউবো) পরিচালক (জনসংযোগ পরিদপ্তর) মো. শামীম হাসান জনকণ্ঠকে বলেন, বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির উৎপাদন ক্ষমতার বিষয়টি মাথায় রেখেই সেখানকার উৎপাদিত বিদ্যুৎ যথাসময়ে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করতে ২টি সঞ্চালন লাইন নির্মাণের প্রকল্পও হাতে নেয়া হয়েছিল।
প্রথমে গোপালগঞ্জ থেকে বিদ্যুৎ কেন্দ্র পর্যন্ত ১৬০ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করা হয়। এবার গোপালগঞ্জের গ্রিড থেকে ঢাকার আমিনবাজার পর্যন্ত সঞ্চালন লাইন নির্মাণকাজ শেষে চালু হলো। গত দুই দিন যাবৎ খুব অল্প পরিমাণে এই লাইন দিয়ে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ আসছে। তবে খুব দ্রুততম সময়ে এই সঞ্চালন লাইন দিয়ে পায়রার উৎপাদিত ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের পুরোটাই জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে। তবে শীতকালে চাহিদা কম থাকায় পুরো বিদ্যুৎ আনা হবে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে বলেন, চাহিদা অনুযায়ীই আনা হবে। সেক্ষেত্রে কোম্পানিকে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে।
এদিকে বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, রবি বা সোমবার বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের একটি কারিগরি প্রতিনিধি দল যাচ্ছে রামপাল কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজের অগ্রগতি দেখতে। প্রতিনিধি দলটির সম্মতির প্রেক্ষিতে চলতি সপ্তাহেই বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির।
এ বিষয়ে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক বলেন, বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের যৌথ বিনিয়োগে রামপাল কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের একটি ইউনিট চলতি মাসেই বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনে যাচ্ছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট থেকে এরই মধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে দেওয়া হচ্ছে। লোড টেস্টও সফলভাবে শেষ করা হয়েছে। এবার কারিগরি পরিদর্শক দলের সম্মতি মিললেই উৎপাদন শুরু করা যাবে। আর যেহেতু সঞ্চালন লাইন প্রস্তুত রয়েছে তাই জাতীয় গ্রিডে যোগ হতেও আর বাধা নেই।
এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিষয়ে বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের উপ মহাব্যবস্থাপক আনোয়ারুল আজিম সাংবাদিকদের বলেন, বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে পরীক্ষামূলকভাবে জাতীয় গ্রিডে ৫৪০ থেকে ৫৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ দেওয়া হচ্ছে। এখন ৬০০ মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ গ্রিডে দেয়া সম্ভব, কিন্তু চাহিদা কম থাকায় পুরোটা উৎপাদন করা যাচ্ছে না জানিয়ে তিনি বলেন, এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র এখন বাণিজ্যিক উৎপাদনের জন্য প্রস্তুত।
চলতি সপ্তাহে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের ও পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেডের (পিজিসিবি) প্রতিনিধি দল এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রে আসার কথা রয়েছে। তারা পরীক্ষামূলক বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজটি পর্যবেক্ষণ করে বাণিজ্যিক উৎপাদনের তারিখ নির্ধারণ করবে।
বাগেরহাটের রামপাল উপজেলায় অবস্থিত এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দুটি ইউনিট থেকে ৬৬০ মেগাওয়াট করে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে। প্রথম ইউনিটের বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনে যাওয়ার ছয় মাসের মধ্যে দ্বিতীয় ইউনিট বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করবে। এরই মধ্যে দ্বিতীয় ইউনিটের সার্বিক কাজের ৮০ শতাংশের বেশি শেষ হয়েছে।
এর আগে গত ১৫ আগস্ট বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু করে। প্রথম ইউনিটের পরীক্ষামূলক উৎপাদন ৪০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত পৌঁছালে ২৪ অক্টোবর দেশে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং। সে সময় সর্বোচ্চ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে উৎপাদন বন্ধ রাখা হয়। ২৫ নভেম্বর থেকে আবার পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু করে কেন্দ্রটি।