বদলে যাচ্ছে ঢাকার পূর্বাঞ্চল

বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : বদলে যাচ্ছে ঢাকার পূর্বাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা। রাজধানীর সঙ্গে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের সংযোগ করতে পূর্বাচলে নির্মাণ করা হচ্ছে সাড়ে ১২ কিলোমিটার দীর্ঘ ১৪ লেনের এক্সপ্রেসওয়ে (বিরতিহীন সড়ক)। এটি হবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম দৃষ্টিনন্দন ও আকর্ষণীয় এক্সপ্রেসওয়ে। রাজধানীর প্রগতি সরণি ও বিমান বন্দর সড়কের সঙ্গে পূর্বের ইস্টার্ন বাইপাসকে সংযুক্ত করবে এই সড়কটি।
পাশাপাশি ওই এলাকায় জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল খনন ও সংস্কার করা হচ্ছে। ‘কুড়িল-পূর্বাচল লিংক রোডের উভয় পাশে ১০০ ফুট চওড়া খাল খনন ও উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় এটি বাস্তবায়ন করছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। নির্মাণ কাজ করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। সড়ক নির্মাণ ও খাল সংস্কারের কাজ শেষ হলে এই এলাকাটি ঢাকার নিকটতম পর্যটন স্পটে রূপ নেবে বলে জানান স্থানীয়রা।

প্রকল্প সূত্র জানায়, সাড়ে ১২ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে রাজধানীর কুড়িল হতে বালু নদী পর্যন্ত সাড়ে ৬ কিলোমিটার সড়কটি নির্মাণ করা হচ্ছে ১৪ লেন বিশিষ্ট। এরমধ্যে ৮ লেন সড়ক হবে এক্সপ্রেসওয়ে। বাকি ৬ লেন সড়ক হবে স্থানীয় যানবাহন চলাচলের জন্য সার্ভিস রোড। এছাড়া বালু নদী থেকে কাঞ্চন সেতু পর্যন্ত ৬ কিলোমিটার সড়ক হবে ১২ লেনের। এরমধ্যে ৬ লেন সড়ক হবে এক্সপ্রেসওয়ে। বাকি ৬ লেন হবে সার্ভিস রোড। এ পর্যন্ত প্রকল্পের ৯৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। চলতি মাসের শেষদিকে পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ হবে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান।

এ বিষয়ে রাজউকের চেয়ারম্যান মো. আনিছুর রহমান মিঞা জনকণ্ঠকে বলেন, কুড়িল-পূর্বাচল লিংক রোডের উভয় পাশে ১০০ ফুট চওড়া খাল খনন ও উন্নয়ন প্রকল্পে বেশিরভাগ কাজ শেষ হয়েছে। আশা করছি চলতি মাসের মধ্যে প্রকল্পের পুরো কাজ শেষ হবে। প্রধানমন্ত্রী সময় দিলে প্রকল্পটি উদ্বোধন করা হবে। এই সড়ক নির্মাণ হলে রাজধানীর সঙ্গে পূর্বাচলের যোগাযোগ সড়ক ও আধুনিক হবে। রাস্তায় পর্যাপ্ত নিরাপত্তা প্রদানে রাজউক ও পুলিশ যৌথভাবে কাজ করছে। অতি দ্রুতই ওই রাস্তার নিরাপত্তায় পর্যাপ্ত পুলিশসহ পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন করা হবে বলে জানান তিনি।

প্রকল্প সূত্র জানায়, ‘কুড়িল-পূর্বাচল লিংক রোডের উভয় পাশে (কুড়িল-বালু নদী পর্যন্ত) ১০০ ফুট চওড়া খাল খনন ও উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পটি ২০১৮ সালের ৪ নভেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। আবাসন প্রকল্পের বাইরে এটিই রাজউকের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন প্রকল্প। প্রকল্পটি সর্বপ্রথম মেয়াদ ছিল ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৮ সালের আগস্ট। তিন বছরের প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কথা ছিল।

২০১৫ সালে প্রকল্পটির প্রাক্কলিত ব্যয় ছিল ৫ হাজার ২৮৬ কোটি ৯১ লাখ টাকা। এরসঙ্গে আরও তিনটি খাল, সড়ক, সেতুসহ আনুষঙ্গিক বিষয় যুক্ত হওয়ায় সংশোধিত প্রকল্পের ব্যয় প্রায় ৫ হাজার ৪২ কোটি ৭৫ লাখ টাকা বৃদ্ধি করা হয়। এতে প্রকল্পের মোট ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৩২৯ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। প্রকল্পের মেয়াদ ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে।

এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক এম.এম. এহসান জামিল জনকণ্ঠকে বলেন, ‘এই প্রকল্পের মাধ্যমে ৩০০ ফুট সড়কটি এক্সপ্রেসওয়ে করা হচ্ছে। এছাড়া ১০০ ফুট খাল খনন, ১৩টি আর্চ ব্রিজ, ৫টি এ্যাটগ্রেড ইন্টার সেকশন, বিদ্যমান ৬টি ব্রিজ প্রশস্ত করা, কুড়িল থেকে বালু নদী পর্যন্ত ১৪ লেন সড়ক উন্নয়ন, বালু নদী থেকে কাঞ্চন পর্যন্ত ১২ লেন উন্নয়ন করা হচ্ছে। পাশাপাশি এডি-৮ খাল, বোয়ালিয়া খাল ও ডুমনি খাল উন্নয়ন হচ্ছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে বাউন্ডারি ওয়াল, ইউড্রেন নির্মাণ, জিআরপি পাইপ লাইন স্থাপন ও নিকুঞ্জ লেক উন্নয়নের কাজ শেষ হয়েছে।’
জলাবদ্ধতা নিরসনে সংস্কার হচ্ছে তিনটি খাল ॥ বর্ষা মৌসুমে নিকুঞ্জ, বারিধারা, বারিধারা ডিওএইচএস, জোয়ারসাহারা, সেনানিবাস, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, কালাচাঁদপুর, কাওলা, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকাসহ বিস্তীর্ণ এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য ১০০ ফুট খালটি খননের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে শুধুমাত্র কুড়িল-পূর্বাচল লিংক রোডের উভয় পাশে ১০০ ফুট খাল দিয়ে বিশাল এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসন সম্ভব নয়। তাই প্রকল্পের সঙ্গে নতুন করে ডুমনি, বোয়ালিয়া ও এডি-৮ খাল তিনটি যুক্ত করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান।

জানা গেছে, হোটেল লা মেরিডিয়ানের পেছনের এডি-৮ খালের সঙ্গে যুক্ত বোয়ালিয়া খাল। খাল দুটির বড় অংশ ভরাট হয়ে গেছে। নতুন করে খাল দুটি খনন করা হচ্ছে। খননের পর বোয়ালিয়া খালের সঙ্গে যুক্ত হবে ১০০ ফুট খাল। খননের পর এডি-৮ খালের দৈর্ঘ্য হবে ৪ দশমিক ১ কিলোমিটার এবং বোয়ালিয়া খালের দৈর্ঘ্য হবে ৫ দশমিক ২ কিলোমিটার। দুটি খালেরই প্রস্থ হবে ১০০ ফুট করে। এই দুই খালের পানি ১০০ ফুট খাল হয়ে বালু নদে গিয়ে পড়বে। এ ছাড়া ডুমনি এলাকার ডুমনি খালটিও সংস্কার করা হবে। এই খালটিও প্রায় ভরাট হয়ে গেছে।

খননের পর এই খালেরও প্রস্থ হবে ১০০ ফুট, দৈর্ঘ্য হবে ৪ দশমিক ৪ কিলোমিটার। এই খালটি পাশের কাঁঠালিয়া খালের সঙ্গে যুক্ত হবে। ফলে ডুমনি খালের পানিও বালু নদ পর্যন্ত যাবে। খাল তিনটি খননের পাশাপাশি পাড় বাঁধাইসহ আনুষঙ্গিক কাজ করা হচ্ছে। এসব কাজ শেষ হলে নিকুঞ্জ-১, নিকুঞ্জ-২, জোয়ারসাহারা, সেনানিবাস, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, কালাচাঁদপুর, কাওলা, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় আর জলাবদ্ধতা হবে না বলে প্রকল্পের সংশ্লিষ্টরা জানান।

এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক এহসান জামিল জনকণ্ঠকে বলেন, ‘রাজধানীর পূর্বাংশের গুরুত্বপূর্ণ তিনটি খাল ডুমনি, বোয়ালিয়া ও এডি-৮। এগুলো দিয়ে এক সময় বিমানবন্দর, নিকুঞ্জ, বারিধারাসহ আশপাশের এলাকার বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন হতো। কিন্তু তিনটি খালই প্রায় ভরাট হয়ে গেছে। এখন এসব খাল সংস্কারের জন্য এই প্রকল্পে যুক্ত করা হয়েছে। তাই প্রকল্পটি সংশোধন করা হয়েছে। এই খালের মাধ্যমে বর্ষা মৌসুমে কুড়িল ডিওএইচএস, বারিধারা, সেনানিবাস ও শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকাসমূহের পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা হবে।’
সড়কের ১৪ লেন হবে এক্সপ্রেসওয়ে ॥ সাড়ে ১২ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে রাজধানীর কুড়িল হতে বালু নদী পর্যন্ত সাড়ে ৬ কিলোমিটার সড়কটি নির্মাণ করা হচ্ছে ১৪ লেন বিশিষ্ট। এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৭৬৪ কোটি টাকা। এছাড়া এক্সপ্রেসওয়েতে যান চলাচলের জন্য ১০টি বড় সেতু নির্মাণ করা হবে (২০১৫ সালের মূল প্রকল্প সেতু ছিল ৬টি)। সেতুগুলো নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৮৮ কোটি টাকা।

এ ছাড়া হাতিরঝিলের আদলে ১৩টি আর্চ ব্রিজ (বাঁকানো সেতু) নির্মাণ করা হবে। এতে ব্যয় হবে ২২৭ কোটি টাকা। এক্সপ্রেসওয়ের পাশের এলাকার লোকজন যাতে গাড়ি নিয়ে সার্ভিস লেন থেকে মূল সড়কে ঢুকতে পারে। সেজন্য ৫টি এ্যাটগ্রেড ইন্টার সেকশন নির্মাণ করা হচ্ছে। ইন্টার সেকশনের নিচ দিয়ে পাতাল সড়ক যুক্ত হবে এক্সপ্রেসওয়েতে।

এছাড়া প্রকল্প এলাকায় চার কিলোমিটার বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের লাইন, ২টি কালভার্ট, ১২টি ওয়াটার বাসস্ট্যান্ড নির্মাণ করা হবে। এছাড়া ২০১৫ সালের মূল প্রকল্পে উল্লেখ থাকা পথচারী-সেতুর সংখ্যা ৪টি থেকে বাড়িয়ে ১২টি, পাম্প হাউস ১টি থেকে বাড়িয়ে ৫টি, স্লুুইসগেট ৪টি থেকে বাড়িয়ে ১০টি করা হয়েছে।

এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক এহসান জামিল বলেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। ইতোমধ্যে প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি ৯৫ শতাংশ। আর্থিক অগ্রগতি ৯০ শতাংশ। চলতি মাসের মধ্যে পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে বিমানবন্দর থেকে পূর্বাংশের বিস্তীর্ণ এলাকায় জলাবদ্ধতা হবে না। কুড়িল থেকে কাঞ্চন পর্যন্ত ট্রাফিক সিগন্যাল ছাড়াই লোকজন যাতায়াত করতে পারবেন। এতে ওই এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেক উন্নত হবে।

সরেজমিনে প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, কুড়িল বিশ্বরোড থেকে কাঞ্চন ব্রিজ পর্যন্ত পুরো এলাকায় সড়ক নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়। এখন চলছে সড়ক ও খালের পাশে ড্রেন নির্মাণের কাজ চলছে। অনেক স্থানে সড়কের মাঝে ডিভাইডার নির্মাণের কাজ করা হচ্ছে। সেনাবাহিনীর ২৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড প্রকল্প নির্মাণ কাজ বাস্তবায়ন করছে। কাজ নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করতে দেখা গেছে নির্মাণ শ্রমিকদের।

আব্দুস সালাম নামের পূর্বাচলের এক বাসিন্দা জনকণ্ঠকে বলেন, এই এলাকাটি ঢাকার খুব কাছে হওয়ার কারণে অনেকেই এই এলাকায় ঘুরতে আসে। আগে তিন শ’ ফিট সড়কে অনেকেই গাড়ি নিয়ে ঘুরতে আসত। এখনো এই সড়ক আরও অনেক বড় করা হচ্ছে। এছাড়া সড়কের পাশে খাল নির্মাণ করা হচ্ছে। এর ফলে মানুষের কাছে এই এলাকার আকর্ষণ আরও বেড়ে গেছে।’ তাই সড়ক ও খালের কাজ শেষ হলে এটা একটি পর্যটন স্পটে রূপ নেবে বলে জানান তিনি।

পূর্বাঞ্চল
Comments (0)
Add Comment