বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : অফিস শুরুর পর প্রথম ৪০ মিনিট সরকারি কর্মকর্তাদের বাধ্যতামূলকভাবে নিজের দপ্তরে থাকার নিয়ম থাকলেও মাঠ প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তাই তা মানছেন না। ওই সময়ে তারা অফিস কক্ষে না থাকায় সাধারণ নাগরিকরা সরকারি দপ্তর থেকে কাঙ্ক্ষিত বা জরুরি সেবা পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের পুরোনো নিয়ম আবারও মনে করে দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। ২০১৯ এবং ২০২১ সালেও মাঠ প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের একই ধরনের নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল, যা পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি বলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের পর্যবেক্ষণ।
মাঠ প্রশাসনকে দেয়া গত সপ্তাহের ওই আদেশে বলা হয়েছে, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে মাঠপর্যায়ের দপ্তরগুলোর কার্যক্রম নিয়মিত তদারক করা হয়। মাঠপর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জরুরি পরিস্থিতি ছাড়া সকাল ৯টা থেকে ৯টা ৪০ মিনিট পর্যন্ত অফিসে থাকার নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। বিভাগ বলছে, মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে সম্প্রতি অনেককে যথাসময়ে অফিস কক্ষে উপস্থিত পাওয়া যাচ্ছে না। এ জন্য জনসাধারণ এবং অন্যান্য সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রয়োজনীয় সংযোগ স্থাপন অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাতে সাধারণ নাগরিকরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হন, তেমনি সরকারি কাজের গতিও কমে যায়।
তাই সেবাপ্রত্যাশী নাগরিকদের সুবিধা এবং সরকারি কর্মকাণ্ডে গতিশীলতা ও সমন্বয় বাড়াতে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবশ্যই সকাল ৯টায় অফিসে এসে ৯টা ৪০ মিনিট পর্যন্ত অবস্থান করে অফিসের কার্যক্রম পরিচালনা করতে জেলা প্রশাসক এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘মাঠ প্রশাসনের সার্বিক কার্যক্রম সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এই কাজটি করতে গিয়ে আমরা মাঝেমধ্যেই বেশ জটিলতায় পড়ছি। অনেক সময় মাঠ প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভার্চুয়ালি সংক্ষিপ্ত সভা করতে গিয়ে অনেক সময় পারা যায় না। কারণ অফিসের প্রথম ৪০ মিনিট বাধ্যতামূলকভাবে দপ্তরে উপস্থিত থাকার যে নির্দেশনা রয়েছে, প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তাই সেটি মানেন না।’
তিনি বলেন, ওই সময় তারা হয়তো সরকারি কাজে দপ্তরের বাইরে অবস্থান করেন। কিন্তু নিয়ম মেনে কর্মকর্তারা অফিস শুরুর পর প্রথম ৪০ মিনিট নিজের দপ্তরে অবস্থান করলে অন্য সরকারি দপ্তরগুলো তাদের সঙ্গে সমন্বয়ের কাজটি দিনের শুরুতেই করতে পারে। আর এটি করা গেলে কাজেও গতি আসে।
সমাধান কী? মাঠ প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তা অফিস শুরুর পর থেকে প্রথম ৪০ মিনিট নিজের দপ্তরে উপস্থিত না থাকলেও এই নিয়ম না মানায় এখন পর্যন্ত কারও বিরুদ্ধেই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ফলে বারবার তাগাদা দিলেও কর্মকর্তারা নিয়মটি যথাযথভাবে মানছেন না বলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, কাউকে অফিসে পাওয়া না গেলেই ব্যবস্থা নেয়া যায় না। কারণ ওই সময় তিনি সরকারি অন্য কাজে থাকতে পারেন। এটাও ঠিক যে মাঠ প্রশাসনে যারা দায়িত্বে আছেন, তারাই নিজেদের কাজের অগ্রাধিকার ঠিক করেন। তবে অফিস শুরুর প্রথম ৪০ মিনিট বাদ দিয়ে কাজের সূচি ঠিক করলে এই সমস্যা থাকবে না।
‘বারবার তাগাদা দেয়ার পরও মাঠ প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তা এই নিয়ম মানছেন না। এর কারণ হলো অফিস শুরুর প্রথম ৪০ মিনিট বাধ্যতামূলকভাবে অফিসে থাকার নিয়ম মান্য না করায় এখন পর্যন্ত কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধেই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ফলে নিয়মের কথা মনে করিয়ে দেয়ার পর কিছুদিন তারা বিষয়টি খেয়াল রাখেন, এরপর আবার ভুলে যান।’
সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহিদ খান মনে করেন, মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বারবার তাগাদা দিয়ে নয়, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হলে তারা সঠিক সময়ে অফিসে উপস্থিত থাকবেন।
শনিবার দৈনিক বাংলাকে তিনি বলেন, শিশুদের বারবার কোনো বিষয় স্মরণ করিয়ে দিতে হয়। মাঠ প্রশাসনে যারা কাজ করছেন তারা তো কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে চাকরিতে যোগ দিয়েছেন। এরপর তাদের আইন, নিয়মকানুন, জনকল্যাণসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এর পরও তারা নির্দেশনা মানেন না, অফিসে থাকেন না, এটি তাদের বারবার মনে করিয়ে দিতে হয়, এটি জাতির জন্য খুবই দুর্ভাগ্যজনক।
‘আমাদের জন্য খুবই দুর্ভাগ্যজনক যে স্বাধীনতার ৫২ বছর পরও গণকর্মচারীরা আইনকানুন মানেন না, নিয়মনীতি মানেন না। তারা জনকল্যাণের বিষয়টা খেয়াল করেন না বলে বিষয়গুলো তাদের বারবার মনে করিয়ে দিতে হয়। এসব বন্ধের উপায় হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা। কিন্তু শাস্তিমূলক ব্যবস্থা কে গ্রহণ করবে? জেলা পর্যায়ে যদি সমস্যা থাকে, তাহলে উপজেলা পর্যায়ে এসব কীভাবে বাস্তবায়ন করবেন?’
মাঠ প্রশাসনের সব কর্মকর্তাকে সঠিক সময়ে অফিসে উপস্থিত থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করতে জেলা পর্যায়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের উদ্যোগ নিতে হবে বলে মনে করেন শহিদ খান। তিনি বলেন, জেলা পর্যায়ে ডিসি, এসপি, সিভিল সার্জন, কৃষি কর্মকর্তাসহ যারা আছেন, তাদেরই কঠোরভাবে বলতে হবে এসব নিয়ম না মানলে অবশ্যই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। কয়েকজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হলে হয়তো ঠিক হবে। কিন্তু আদৌ ঠিক হবে কি না সেই প্রশ্ন থাকছে। কারণ স্বৈরশাসনের সময় জেনারেল এরশাদ হেলিকপ্টার নিয়ে উপজেলায় চলে যেতেন, তিনি দেখতেন সকাল ৯টায় কর্মকর্তারা অফিসে এসেছেন কি না। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে হেলিকপ্টার নিয়ে সব উপজেলায় তদরক করা সম্ভব হবে না।
মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নিয়েও কীভাবে এই সমস্যার সমাধান হতে পারে, সে বিষয়ে পরামর্শ রেখেছেন সাবেক সচিব শহিদ খান। কর্মকর্তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘নিজেকে শুদ্ধ করতে হবে, শুদ্ধাচার কৌশল আছে, আত্মশুদ্ধির ব্যাপার আছে, আত্মোপলব্ধির ব্যাপার আছে। জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় আপনার বেতন-ভাতা চলে, সবকিছুই চলে তার পরও জনগণ কাঙ্ক্ষিত সেবা পাবে না, সঠিক সময় আপনি অফিসে থাকবেন না, এটি খুবই দুঃখজনক।’