বাণিজ্য সম্ভাবনা ॥ ভারতের সঙ্গে ২ হাজার কোটি ডলারের

বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে বছরে ২ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য হওয়ার নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এ লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছে উভয় দেশ। আগামী মার্চ মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠেয় বাণিজ্য সচিব পর্যায়ের বৈঠক সামনে রেখে বিগত ৫০ বছরের অমীমাংসিত বিষয়গুলো সমাধানে সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছে দুই দেশ। মহামারি করোনা থেকে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধার এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মতো কঠিন পরিস্থিতি সামনে রেখে বাংলাদেশ-ভারত যৌথভাবে কাজ করতে আগ্রহী। এ কারণে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগে বাড়াতে হবে নতুন চুক্তি ও সমঝোতা।

এবার পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে অর্ধ শতাধিক বছরের বেশি সময় ধরে শুল্ক ও অশুল্কজনিত, পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ ও বন্দর-অবকাঠামো নিয়ে জিইয়ে থাকা যেসব সমস্যা ও সংকট রয়েছে সেগুলো দূর করা হবে। ভোগ্যপণ্য আমদানিতে কোটা সুবিধা পাবে বাংলাদেশ। একইভাবে বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে ভারতের বাজারে পণ্য রপ্তানিতে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ভারতীয় বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশের ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগে বিশেষ সুবিধা নিয়ে উৎপাদিত পণ্য রপ্তানি করবে নিজ দেশেই।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ বর্তমান প্রায় ১ হাজার ৬০০ কোটি মার্কিন ডলার। এর মধ্যে ভারত থেকে বছরে আমদানি হয় ১ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের পণ্য, বিপরীতে রপ্তানি হচ্ছে মাত্র ২০০ কোটি ডলারের পণ্য সামগ্রী। রপ্তানিতে বাংলাদেশ বরাবরই পিছিয়ে। আর এ কারণেই বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে। কিন্তু বেশ কয়েকটি বিষয়ে শর্ত শিথিল, শুল্কছাড় এবং নীতিগত সহায়তা প্রদান করা সম্ভব হলে ভারতের বাজারে পণ্য রপ্তানি বাড়ানো সম্ভব।

অন্যদিকে, ভারতও বাংলাদেশে রপ্তানি আরও বাড়াতে পারে। বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রধান বাধা ও সমস্যাগুলো প্রায় চিহ্নিত উভয় দেশেই। এবার সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। আশা করা হচ্ছে, বাংলাদেশ ও ভারতের পারস্পরিক সহযোগিতা ও আন্তরিকতায় উভয় দেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ২ হাজার কোটি মার্কিন ডলারে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। আগামী বাণিজ্য সচিব পর্যায়ের বৈঠকে এ বিষয়ে করণীয় ও কৌশল নির্ধারণ করা হবে।
এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ জনকণ্ঠকে বলেন, বাণিজ্য সচিব পর্যায়ের বৈঠকটি এবার বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। একদিকে মহামারি করোনা থেকে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধার, অন্যদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশ-ভারত নিজেদের স্বার্থেই দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়ানোর মতো কর্মসূচি গ্রহণ করতে যাচ্ছে। বাণিজ্য চুক্তি থেকে এবার আমরা বৃহৎ অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তির (কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট -সিপা) কথা ভাবছি। এটি হবে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নতুন মাইলফলক। এছাড়া আমাদের ভোগ্যপণ্য আমদানির বড় বাজার ভারত। সেখানে ইতোমধ্যে কোটা সুবিধা চাওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশী পাট ও পাটজাত পণ্যের ওপর থেকে এন্টি-ডাম্পিং শুল্ক প্রত্যাহার এবং ভারতের ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করার মতো বিষয়গুলো রয়েছে। তিনি বলেন, আগামী সচিব পর্যায়ের বৈঠকে অংশ নিতে ইতোমধ্যে ভারতের কাছে আমন্ত্রণপত্র পাঠানো হয়েছে। আশা করছি, ভারতের বাণিজ্য সচিব মার্চে বাংলাদেশ সফরে আসবেন। জানা গেছে, সচিব পর্যায়ের বৈঠকে যোগ দিতে বাংলাদেশে আসবেন ভারতের বাণিজ্য সচিব শ্রী সুনীল বার্থওয়ালের নেতৃত্বে একটি উচ্চ পর্যায়ের সরকারি প্রতিনিধি দল।
এদিকে, মধ্যমার্চ থেকে পবিত্র রমজান মাস শুরু হচ্ছে। রমজানের মধ্যেই কোটা সুবিধায় ভারত থেকে ভোগ্যপণ্য আমদানি করার চেষ্টা রয়েছে সরকারের। ইতোমধ্যে ভোগ্যপণ্য রপ্তানিতে কোটা সুবিধা প্রদানের বিষয়ে আশ্বাস দিয়েছে প্রতিবেশী দেশটি। ভোগ্যপণ্য আমদানিতে কোটা সুবিধা নিশ্চিত হলে চাল, গম, চিনি, আদা, রসুন ও পেঁয়াজের মতো ছয় পণ্যের সংকট কাটবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ও ভারতের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জামান আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জন্য ভারত সবসময়ই বড় ইস্যু। চীনের পরই একক দেশ হিসেবে সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য হয় ভারত থেকে। এ কারণে ভারতের সঙ্গে যে কোনো চুক্তি করা হলে তাতে আমাদের রপ্তানি বাড়ানোর সুযোগ থাকতে হবে।

তিনি বলেন, ভারত থেকে আমরা সহজে যে কোনো ভোগ্যপণ্য ও অন্যান্য জিনিস আমদানি করতে পারি। অনেক বড় রাষ্ট্র, বড় তাদের অর্থনীতি। কিন্তু সেই তুলনায় আমরা এখনো রপ্তানি বাড়াতে পারিনি। তাই বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনার কৌশল থাকতে হবে।
ছয়টি ভোগ্যপণ্যের কোটা সুবিধা নিয়ে আলোচনা ॥ বাংলাদেশ-ভারত সচিব পর্যায়ের বৈঠকে এবার ছয়টি ভোগ্যপণ্যের কোটা সুবিধা নিয়ে আলোচনা করা হবে। রমজানের মধ্যেই ভারত থেকে কোটা সুবিধায় আসবে চাল, গম, চিনি, আদা, রসুন ও পেঁয়াজের মতো ছয় পণ্য। কোটা সুবিধায় ভারত থেকে বছরে ছয়টি পণ্যে ৫৮ লাখ টন আমদানির বিষয়টি চূড়ান্ত করেছে বাংলাদেশ। বিশেষ এই সুবিধায় পণ্য আমদানিতে এবার ভারতকে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দেবে সরকার।

এছাড়া সচিব পর্যায়ের বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আবার আলোচনা করা হবে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ভারত থেকে কোটা সুবিধায় গম আমদানিতে সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে কোটা সুবিধায় বাংলাদেশ বছরে ২৫ লাখ টন গম আমদানির বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে। এছাড়া আমদানিতে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে চাল। বছরে আমদানি হবে ১৫ লাখ টন। এরপরই চাহিদা মেটাতে বছরে ১০ লাখ টন চিনি আমদানির প্রস্তাব দেওয়া হবে। চিনি, পেঁয়াজ, রসুন এবং আদা শুধু বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীরা আমদানি করবেন। এতে বছরে ৬ লাখ টন পেঁয়াজ, ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টন রসুন এবং ১ লাখ টন আদা আমদানি করা হবে।
সিপা চুক্তি নিয়ে আলোচনা হবে ॥ বৃহৎ অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বের চুক্তি (সিপা) নিয়ে ভারতের আগ্রহ সবচেয়ে বেশি। এবার এই চুক্তির বিষয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও আগ্রহ প্রকাশ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ভুটানের সঙ্গে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি করেছে। আরও ১১টি দেশের সঙ্গে এ ধরনের চুক্তি করা হতে পারে। এরই ধারাবাহিকতায় ভারতের সঙ্গে করা হবে সিপা চুক্তি। চলতি অর্থবছরের মধ্যে এই চুক্তিটি করা হতে পারে।

সচিব পর্যায়ের বৈঠকে সিপা চুক্তির বিষয়টিও গুরুত্ব পাচ্ছে। ইতোমধ্যে সিপা চুক্তির বিষয়টির সম্ভাব্যতা যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। এছাড়া বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্প্রসারণ, বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাধা দূরীকরণ ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি, দুদেশের মধ্যকার বিরাজমান ট্যারিফ ও নন-ট্যারিফ বাণিজ্য বাধা দূরীকরণ, কতিপয় বাংলাদেশী পণ্যের ওপর ভারত সরকার কর্তৃক আরোপিত এন্টি ডাম্পিং বিষয়ে আলোচনা, বর্ডার হাটের সংখ্যা সম্প্রসারণ ও সীমান্ত বাণিজ্য বৃদ্ধি, বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যকার বন্দর সুবিধা সম্প্রসারণের বিষয়ে আলোচনা হবে।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ-ভারতের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ১৬ বিলিয়ন ডলার। এরমধ্যে ভারত থেকে আমদানি হয় ১৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য এবং বিপরীতে রপ্তানি হয় ২ বিলিয়ন ইউএস ডলারের পণ্যসামগ্রী। রপ্তানিকৃত পণ্যসামগ্রীর মধ্যে বেশিরভাগই হচ্ছে তৈরি পোশাক। এর পাশাপাশি পাট ও পাটজাতপণ্য, জামদানি, ইলিশমাছ ও হ্যান্ডিক্রাফট প্রধান রপ্তানিকৃত পণ্য। অন্যদিকে, ভারত থেকে গার্মেন্টস মেশিনারিজ, তুলা, হোম অ্যাপ্লায়েন্স, ওষুধ, থ্রিপিস, পেঁয়াজ, চাল ও গমসহ বিভিন্ন ধরনের ভোগ্যপণ্য আমদানি হয়ে থাকে। এছাড়া ভারতের সেভেন সিস্টার ্যাত সাতটি রাজ্যে বাংলাদেশে উৎপাদিত সিরামিকস ও খাদ্যপণ্য জনপ্রিয়।
পাটপণ্য রপ্তানিতে এন্টি ডাম্পিং শুল্ক প্রত্যাহার চাওয়া হবে ॥ প্রায় দীর্ঘ সাত বছর আগে হঠাৎ করে ভারত বাংলাদেশের পাট ও পাটপণ্য রপ্তানির ওপর এন্টি ডাম্পিং শুল্ক আরোপ করে। এরপর এই ইস্যুতে একাধিক বৈঠক করা হলেও ভারত তা আমলে নেয়নি। বরং দেশটির অভিযোগ ছিল, বাংলাদেশ ভারতের স্থানীয় বাজারের চেয়ে কম দামে পাট রপ্তানি করছে। এই অভিযোগের কারণ দেখিয়ে প্রতি টনে বাংলাদেশকে ৩৫১ দশমিক ৭২ ডলার পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করে।

এতে করে বাংলাদেশের পাট রপ্তানিতে বিপর্যয় দেখা দেয়। দেশের পাট ও পাটজাত পণ্যের দাম কমে যায়। বাংলাদেশের পাট ও পাটপণ্যের প্রধান ক্রেতা ভারতের এন্টি ডাম্পিং শুল্ক আরোপের ফলে দেশের কৃষক এবং এ শিল্প খাতের সঙ্গে জড়িতরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এরপর থেকে সরকারি পর্যায়ে বহু দেনদরবার করে সমস্যা সুরাহার কোন পথ বেরিয়ে আসেনি।
এ্যান্টি-ডাম্পিং আরোপ প্রত্যাহারের বিষয়টি এখন ভারতের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করছে। কারণ পাট পণ্য রফতানিতে ভারত যে অভিযোগ এনেছে তা সঠিক নয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া ভারতের অভিযোগের কোন প্রমাণও পাওয়া যায়নি। বিষয়টি ভারতের সংশ্লিষ্টরাও এখন অনুধাবন করতে শুরু করেছেন। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে বড় অঙ্কের বাণিজ্য ঘাটতি বাংলাদেশের। বাংলাদেশে পণ্য রফতানিতে ভারতের অবস্থান দ্বিতীয়।

এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) সেলের মহা পরিচালক মো. হাফিজুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, পাটপণ্য রফতানিতে ভারতের অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক আরোপ প্রত্যাহারের বিষয়টি সর্বোচ্চ জোর দিয়ে আলোচনা করা হবে। এর একটি স্থায়ী সমাধান হওয়া উচিত। তিনি বলেন, ভারত বড় দেশ, তাদের বাণিজ্যও বড়। এ কারণে দেশটির সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে। এই ঘাটতি কমিয়ে আনতে হলেও পাটপণ্য রফতানি সহজ করা প্রয়োজন। আগামী সচিব পর্যায়ের বৈঠকে বিষয়টি ভারত সরকারের কাছে আবারও তুলে ধরা হবে।

ডলার
Comments (0)
Add Comment