বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : বৈশ্বিক সংকটের মুখে রোজার ঈদের পর থেকে ফের অস্থির হয়ে পড়ে নিত্যপণ্যের বাজার। বিশ্ববাজারে বেশকিছু ভোগ্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ও আমদানি কম হওয়ার কারণে অভ্যন্তরীণ বাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। চলতি মাসের শেষ সপ্তায় দেশে উদ্যাপিত হবে কোরবানির ঈদ। ঘন ঘন লোডশেডিং এবং বিদ্যুৎ সংকটের কারণে চিনি ও ভোজ্যতেলসহ অন্যান্য নিত্যপণ্যের উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে বলে মিল মালিকরা দাবি করছেন। এ অবস্থায় চিনি, ভোজ্যতেল, পেঁয়াজ, আদা, রসুন ও মসলাপাতির দাম বাড়ানোর কারসাজি করছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। ফলে বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে।
তবে ভোগ্য ও নিত্যপণ্যের দাম কমাতে আমদানি বাড়ানো, কৃষিপণ্য সংরক্ষণসহ সাত বিষয়ে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনায় গঠিত টাস্ক ফোর্সের আগামীকাল রবিবারের বৈঠকে নিত্যপণ্যের দাম কমাতে নতুন কৌশল নির্ধারণ করা হবে। আশা করা হচ্ছে, সরকারি উদ্যোগগুলো বাস্তবায়িত হলে ভোগ্যপণ্যের দাম আর বাড়বে না।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ডলার সংকট তৈরি হওয়ায় কয়েক মাস ধরে ভোগ্যপণ্য আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। এ কারণে চাহিদার তুলনায় পণ্যের সরবরাহে কিছুটা ঘাটতি রয়েছে বাজারে। অন্যদিকে পেঁয়াজ ও আদার মতো পণ্যের দেশীয় উৎপাদন ভাল হওয়ার পরও কোরবানি সামনে রেখে মজুত বাড়িয়ে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। তবে, ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানির ফলে বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে পেঁয়াজের দাম কমেছে খুচরা বাজারে। বিদ্যুৎ সংকটের কথা বলে চিনি ও আলুর দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে ব্যবসায়ীরা। ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা করা হচ্ছে। কয়েক দফা বেড়েছে মসলাপাতির দাম। এ অবস্থায় কোরবানির আগে দ্রব্যমূল্য কমাতে চায় সরকার।
আগামীকাল রবিবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে টাস্ক ফোর্সের সপ্তম সভা আহ্বান করা হয়েছে। মূলত বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা এবং দ্রব্যমূল্য কিভাবে কমিয়ে এনে সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দেওয়া যায় সেই বিষয়ে কৌশল নির্ধারণ করে থাকে টাস্ক ফোর্স কমিটি। বাণিজ্য সচিবের সভাপতিত্বে এ কমিটিতে সরকারি-বেসরকারি খাতের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা প্রতিনিধিত্ব করে থাকেন।
দ্রব্যমূল্য কমিয়ে আনতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সাত উদ্যোগ হচ্ছেÑ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের উৎপাদন, আমদানি ও মজুত পরিস্থিতি পর্যালোচনা, পণ্য উৎপাদন, আমদানি, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সরবরাহ চেনে বিভিন্ন পর্যায়ে পার্থক্য হ্রাসকরণ, পেঁয়াজ, আদা, রসুন ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় কৃষিপণ্য সংরক্ষণের উদ্যোগ, বাজারে স্থিতিশীলতা অর্জনে টিসিবির ভূমিকা বাড়ানো, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি এলসি খোলা ও নিষ্পত্তিতে অগ্রাধিকার প্রদান এবং প্রয়োজনীয় ডলার সরবরাহ নিশ্চিতকরণ, নিত্যপণ্যের আমদানিকৃত খাদ্যদ্রব্য দ্রুত খালাসের ব্যবস্থা এবং বাজারে শক্তিশালী মনিটরিং ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
টাস্ক ফোর্সের সভায় এ বিষয়গুলোর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা এবং তা বাস্তবায়নের ওপর জোর দেওয়া হবে বলে জানা গেছে। কৃষিপণ্য বিশেষ করে পেঁয়াজ, আদা ও রসুনের দেশীয় উৎপাদন ও মজুত বাড়ানো হবে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এ বিষয়ে বেশ কয়েকটি কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। সম্প্রতি গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ উৎপাদনে ১৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এছাড়া এসব পণ্য সারাবছর সংরক্ষণে কৃষক পর্যায়ে প্রশিক্ষণ ও গুদামঘর নির্মাণে কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে।
এদিকে, জিনিসপত্রের দাম বাড়ার জন্য ব্যবসায়ীরা আমদানি ব্যাহত হওয়াকে দায়ী করছে। তাদের মতে, ডলারের দাম বৃদ্ধি এবং ব্যাংকগুলোর এলসি বা ঋণপত্র খোলার চরম অনীহার কারণে চাহিদামতো ভোগ্য ও নিত্যপণ্য আমদানি হতে পারছে না। ফলে বাজারে সরবরাহ কম হচ্ছে এবং অসাধু ব্যবসায়ীরা এর সুযোগ নিচ্ছে। বাংলাদেশ গরমমসলা ব্যবসায়ী সমিতির পক্ষ থেকে সংগঠনটির সভাপতি হাজি মো. এনায়েত উল্লাহ জনকণ্ঠকে জানান, কোরবানি সামনে অথচ মসলাপাতি আমদানিতে ব্যাংকগুলো এলসি নিচ্ছে না। একই সঙ্গে যতটুকু আমদানি হচ্ছে তার ওপর ভ্যাট ও ট্যাক্স বাড়ানো হয়েছে। ফলে অসাধু ব্যবসায়ীরা সুযোগ নিয়ে পণ্যের দাম আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, ডলারের দাম বৃদ্ধি পাওয়া ব্যাংকগুলোর এলসি নিতে অনীহাই এখন বড় সমস্যা। এই সমস্যা দূর হলে ভোগ্যপণ্যের আমদানি বাড়বে। বাজারে পণ্যের সরবরাহ বাড়িয়ে দ্রব্যমূল্য কমানো সম্ভব।
ইতোপূর্বে টাস্ক ফোর্সের সভায় এ বিষয়গুলোর ওপর জোর দেওয়া হলেও বাজারে সেটির প্রতিফলন হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে নতুন নতুন সংকট তৈরি হচ্ছে। সম্প্রতি পেঁয়াজের দাম ১০০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। অথচ রোজার ঈদের পর দাম বাড়তে শুরু করলে পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দিতে কৃষি মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু এর পরও অনুমতি দেওয়া হচ্ছিল না। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সিদ্ধান্তে পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি পান ব্যবসায়ীরা।
ইতোমধ্যে ৫ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেওয়া হলেও দেশে এসেছে মাত্র ১৫ হাজার টন। যা দিয়ে সারাদেশে মাত্র দুই দিনের চাহিদা মেটানে সম্ভব। ফলে মসলা জাতীয় এ পণ্যটির দাম কমছে ধীরে ধীরে। কোরবানির সময় সাড়ে তিন লাখ থেকে ৪ লাখ টন পেঁয়াজের বাড়তি চাহিদা তৈরি হবে। এই চাহিদা পূরণে আরও বেশি পেঁয়াজ আমদানি করতে হবে। এ খাতের আমদানিকারকরা বলছেন, দ্রুত আমদানি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হলে এলসি দ্রুত নিষ্পত্তি এবং বন্দরে পণ্য খালাস দ্রুত করতে হবে। অন্যথায় কোরবানির সময় সংকট তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ জনকণ্ঠকে বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ডলার সংকটের প্রভাবে ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। তবে ভোগ্য ও নিত্যপণ্যের আমদানি যাতে ব্যাহত না হয় সেদিকে সরকারের নজর রয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং এনবিআরের সহযোগিতা চাওয়া হয়। আশা করছি, ব্যবসায়ীরা সহজে এলসি খুলতে পারবেন। তিনি জানান, ৫০ টাকার ওপর গেলেই পেঁয়াজ আমদানির সুযোগ দেওয়া হয়। এবারও ব্যবসায়ীরা সুযোগ পেয়েছেন। এছাড়া ভোগ্য ও নিত্যপণ্যের দাম কমাতে আরও কিছু কৌশল রয়েছে। আশা করছি, নিত্যপণ্যের দাম বাড়বে না। বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকবে।
অভিযোগ রয়েছে, দ্রব্যমূল্য অস্থিরতার পেছনে অসাধু ব্যবসায়ীদের বড় ভূমিকা রয়েছে। পণ্যের মজুত করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বেশি নেওয়া হয়। তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে এ ব্যাপারে কঠোর বাজার মনিটরিং করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে যেসব ব্যবসায়ী ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ানোর সঙ্গে জড়িত থাকবে তাদের ট্রেড লাইসেন্স বাতিল, ডিলারশিপ বাতিল ও আর্থিক জরিমানা করা হবে। এমনকি জেল, জরিমানার মতো শাস্তি দেওয়া হতে পারে। এছাড়া যেসব বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেশি নেওয়া হবে সেসব বাজারে ব্যবসায়ী সংগঠনের কমিটি ভেঙে দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে ভোক্তা অধিদপ্তর।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, বাজারে অভিযান জোরদার করা হবে। অসাধু ব্যবসায়ীদের ছাড় দেওয়া হবে না। তিনি জানান, যেসব ব্যবসায়ী পণ্যের মজুত বাড়িয়ে দাম বাড়াচ্ছেন তাদের নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে। এছাড়া পণ্যের দাম কমাতে সমুদ্র ও স্থলবন্দর এবং শুল্ক স্টেশন দিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য খালাসে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বাজারে স্থিতিশীলতা আনয়নে সরকারি বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা টিসিবিকে আরও শক্তিশালী করা হবে। বর্তমান এক কোটি পরিবার টিসিবি থেকে ভর্তুকি মূল্যে ভোগ্যপণ্য কিনতে পারছেন। এর ফলে উপকৃত হচ্ছে দেশের ৫ কোটি মানুষ। আগামীতে টিসিবির তালিকায় আরও কয়েকটি ভোগ্যপণ্য যুক্ত করা হতে পারে। ফ্যামিলি কার্ডের সংখ্যা বাড়ানোর ওপরও জোর দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া চাল, ডাল, গম (আটা), ভোজ্যতেল, চিনি, ছোলা, পেঁয়াজ ও মসলাপাতিসহ ১৭ অত্যাবশ্যকীয় পণ্যসামগ্রী আমদানি বাড়ানোর তাগিদ দেওয়া হবে। এদিকে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি খোদ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে আমদানির বিষয়টির নজরদারি রাখা হচ্ছে।
এদিকে, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমাতে সরকারি উদ্যোগের প্রভাবসহ চার কারণে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। প্রস্তাবিত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় তিনি বলেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি, খাদ্যপণ্য ও সারের মূল্য কমে আসা, দেশে জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় এবং খাদ্য সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্য সরকারি উদ্যোগের প্রভাবে আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত থাকবে। এছাড়া বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের কাছাকাছি দাঁড়াবে বলে আশা করছি।
অর্থমন্ত্রী বলেন, কৃষি খাতের উৎপাদন অব্যাহত রাখার স্বার্থে সুলভমূল্যে সার সরবরাহ নিশ্চিত করার দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে জনকল্যাণমুখী শেখ হাসিনার সরকার। এছাড়া, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের জন্য ভর্তুকি বাবদ ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য নীতি সুদের হার অর্থাৎ রেপো সুদের হার কয়েক দফা বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এছাড়া চালের মূল্যের ওপর শুল্ক প্রত্যাহার, রেগুলেটরি ডিউটি ২৫ থেকে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। ডিজেলের মূল্য কমাতে ডিজেলের আগাম কর অব্যাহতি ও শুল্ক ১০ শতাংশ হতে ৫ শতাংশ হ্রাস করা হয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও স্বল্প আয়ের জনগণের ওপর মূল্যস্ফীতির প্রভাব প্রশমনের জন্য সরকার খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি, খোলাবাজারে চাল বিক্রি (ওএমএস) এবং ১ কোটি ফ্যামিলি কার্ড বিতরণের মতো কার্যক্রমসমূহ পরিচালনা করছে।