বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন জোটের বাইরে নতুন অর্থনৈতিক জোট ব্রিকসে (BRICS) যোগ দিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আগামী আগস্টে দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্রিকসের শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশের সদস্য পদটি চূড়ান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশ ছাড়াও এই জোটে যোগ দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইন্দোনেশিয়ার। ফলে নতুন করে এই দেশগুলো জোটে যোগ দিলে শুধু অর্থনীতি নয় ভূ-রাজনীতিতেও নতুন মেরুকরণ ঘটবে। চীন ইতোমধ্যে বাংলাদেশকে এই জোটে যোগ দেওয়ার বিষয়ে স্বাগত জানিয়েছে। তবে জোটের প্রভাবশালী রাশিয়া বলেছে, নতুন আরও ২০টি দেশ ব্রিকসে যোগ দিতে চাচ্ছে।
নতুন জোট ব্রিকসে বাংলাদেশ সদস্য হিসেবে যোগ দিলে স্বল্প সুদে ঋণ সুবিধা, সদস্য দেশগুলোর সঙ্গে ব্যবসা ও বাণিজ্য এবং ডলারের বিকল্প মুদ্রা ব্যবহারের সুযোগ নিতে পারবে। পশ্চিমা বিশ্বের আধিপত্যবাদী অর্থনীতির বিকল্প হিসেবে বাংলাদেশ জোটের সদস্য হিসেবে আরও বেশ কিছু সুবিধা নিতে পারবে।
কূটনৈতিক বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ব্রিকসে যোগ দিলে বাংলাদেশ বেশ কিছু সুবিধা পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই সুবিধাগুলো হলো : ব্রিকস জোটের সদস্য হওয়ার পর বিভিন্ন খাতে বাংলাদেশ ঋণ নেওয়ার সুবিধা পাবে। এ ক্ষেত্রে ঋণের সুদের হারও কম হবে। বাংলাদেশ ব্রিকস গেলে এই জোটের সদস্য অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়বে। সম্পর্ক ভালো হওয়ার সুযোগে সদস্য দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়বে।
বিশ্লেষকদের মতে, ব্রিকস জোটে যোগ দিলে বৈশ্বিকভাবে বাংলাদেশের অবস্থান আরও শক্তিশালী হবে। ব্রিকস জোটভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ভবিষ্যতে বিকল্প মুদ্রা বা বিকল্প বাণিজ্যিক ব্যবস্থা চালু করলে এ ক্ষেত্রে সুবিধা নিতে পারবে বাংলাদেশ। ব্রিকস ভবিষ্যতে আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠান হতে পারে। এ ক্ষেত্রে বড় আকারের ঋণ সুবিধা পেতে পারে বাংলাদেশ। অবএব সেই সুযোগটি বাংলাদেশকে নিতে হবে।
ব্রিকস কি ॥ ইজওঈঝ হলো একটি সংক্ষিপ্ত রূপ যা ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন এবং দক্ষিণ আফ্রিকাকে বোঝায়। এটি উল্লেখযোগ্য আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক প্রভাবসহ পাঁচটি উদীয়মান অর্থনীতির একটি গ্রুপকে প্রতিনিধিত্ব করে।
ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত এবং চীনের উদীয়মান অর্থনীতি বর্ণনা করার জন্য ২০০১ গোল্ডম্যান স্যাক্সের অর্থনীতিবিদ জিম ও’নিল প্রথম ইজওঈ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে, এই দেশগুলো তাদের দ্রুত অর্থনৈতিক বৃদ্ধি, বিশাল জনসংখ্যা এবং প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদের কারণে ২১ শতকে প্রভাবশালী বিশ্ব খেলোয়াড় হয়ে উঠবে। দক্ষিণ আফ্রিকা ২০১০ সালে এই গ্রুপে যোগ দেয় এবং সংক্ষিপ্ত রূপটি ইজওঈঝ-এ প্রসারিত হয়।
ব্রিকসে যোগদানে বাংলাদেশের সুবিধার বিষয়ে ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, ব্রিকসে যোগ দিয়ে বাংলাদেশ কতটা সুবিধা পাবে তা নির্ভর করছে এতে যোগদানের পর আমাদের বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নতুন কিছু ঘটার ওপর। যেমন চীন ও ভারত দুটি বড় বাজার, ব্রাজিলও বিরাট। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) হওয়ায় চীন ও ভারতে কিছু সুবিধা পেয়ে থাকে। যদিও এ সুবিধা খুব বেশি নয়। কিন্তু এই সুবিধাটুকু না থাকলে এখন আমরা সেখানে যতটুকু রপ্তানি করতে পারি সেটুকু করা হয়তো কঠিন হয়ে যেত। বাংলাদেশ ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণের পর এলডিসিভিত্তিক যে সুবিধা আছে সেগুলো উঠে যাবে। এখন সেই জায়গায় তারা যদি বলে, তোমরা ব্রিকসের সদস্য, তাই এলডিসির অনুরূপ সুবিধা পাবে, সুবিধা বলতে এটাই।
জাহিদ হোসেন বলেন, ব্রিকস কোনো অর্থনৈতিক জোট নয়, এটা মূলত রাজনৈতিক ফোরাম। এ ফোরামে ভূ-রাজনীতিই বেশি প্রাধান্য পায়, অর্থনৈতিক বিষয়গুলো নয়। সে জন্য এ জোটে যোগ দিলে আমাদের অর্থনৈতিক কোনো সুবিধা হবে কি না তা এখনো পরিষ্কার নয়। তবে ব্রিকসের সদস্য হলে তাদের নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, ইতোমধ্যেই যেটির সদস্য হয়ে আছে বাংলাদেশ সেটিতে যদি সদস্যদের জন্য কোনো আর্থিক জানালা থাকে তাহলে সেখান থেকে আমরা তুলনামূলকভাবে সহজ শর্তে ঋণ পেতে পারি। তবে এসবই জল্পনা-কল্পনা। কিন্তু ব্রিকসে যোগ দিলে এ জোটের রাজনৈতিক পাল্লাটা ভারি হবে। কিন্তু নতুন কোনো বাণিজ্যিক চুক্তি বা বাণিজ্যিক সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি হবে কি না তা এখনো নিশ্চিত নয়।
বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, ব্রিকসে যোগ দেওয়া ইতিবাচক সিদ্ধান্ত। এ জোটে যোগ দিলে জোটভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক আরও গভীর হবে। এরই মধ্যে এই জোটের ব্যাংক নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সদস্য হয়েছে বাংলাদেশ। আগামী অক্টোবরে এ ব্যাংক বিকল্প মুদ্রা চালু করবে। তখন বাংলাদেশও এর সুবিধা পাবে। এ ছাড়া ব্রিকসের সদস্য হলে বাংলাদেশ এ জোটের ব্যাংক থেকে আর্থিক সহযোগিতা পাওয়াসহ এ-সংক্রান্ত একাধিক ইস্যুতে নিজেদের মতামত উপস্থাপন করতে পারবে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেন, বিশ্বে এ মুহূর্তে ভূ-রাজনীতিতে পরিবর্তন ঘটছে। সে হিসেবে বহুপক্ষীয় ফোরামে বাংলাদেশ যুক্ত হতেই পারে। ব্রিকস জোটে অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা রয়েছে। এ জোট বিশ্বে ডলারের দাপট কমাতে বিকল্প মুদ্রা চালুর চিন্তা করছে। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের অসন্তোষ থাকতে পারে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ব্রিকস জোটে যোগদানের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদনও করেছে। আগামী আগস্টে দক্ষিণ আফ্রিকায় শীর্ষ সম্মেলনেই বাংলাদেশের সদস্য পদ চূড়ান্ত হবে। বর্তমানে ব্রিকসের সদস্য ৫টি দেশ হলেও তারা আগামীতে আরও ৮টি দেশকে সদস্য করবে। বাংলাদেশ এই জোটের সদস্য হতে পারে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতোমধ্যে ব্রিকস জোটে যোগ দেওয়ার বিষয়টি সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরেছেন।
জেনেভায় প্যালেস ডি নেশনস এর দ্বি-পক্ষীয় বৈঠক রুমে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট মাতামেলা সিরিল রামাপোশার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকালে বিষয়টি উত্থাপিত হওয়ায় শীঘ্রই বাংলাদেশের ব্রিকসের সদস্যপদ পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে এ কথা বলেন। ড. মোমেন বলেন, ব্রিকস ব্যাংক সম্প্রতি বাংলাদেশকে অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। ভবিষ্যতে ব্রিকস বাংলাদেশকে এতে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ জানাবে। অর্থনৈতিক বৈষম্য সত্ত্বেও, ব্রিকস জোট বিশ্ব বিষয়ে একটি স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গিসহ একটি ভূ-রাজনৈতিক জোটে রূপান্তরিত হয়েছে। উল্লেখযোগ্যভাবে, ইউক্রেনের সঙ্গে বিরোধের সময় ব্রিকস সদস্যরা রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা সমর্থন করেনি।
সম্প্রতি রাশিয়ার ডেপুটি পররাষ্ট্রমন্ত্রী সার্গেই রিয়াবকভ বার্তা সংস্থা তাসকে বলেন, ব্রিকসে যোগ দিতে ইচ্ছুক প্রার্থীর সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। প্রায় ২০টি দেশ ব্রিকসের সদস্যপদ পেতে চাচ্ছে এবং তাদের সংখ্যা বাড়ছে। তিনি বলেন, এর মধ্যে প্রতীয়মান হচ্ছে ব্রিকস বিস্তৃত হচ্ছে এবং সংগঠন হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এর ভূমিকা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ছে। রিয়াবকভ বলেন, ব্রিকস এমন কিছু দেশের গ্রুপ যারা নেতা অনুসারী নীতিতে চলে না। বরং এর অংশীদাররা ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি গঠনমূলক এজেন্ডা তৈরি করে।
সম্প্রতি ঢাকায় অবস্থিত চীনের দূতাবাস জানায়, বেজিংয়ে চীনের নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে গত ১৯ জুন দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাও নিঙ ব্রিকস প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের বলেছেন, বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি ও উন্নয়নের ক্ষেত্র হিসেবে ব্রিকস গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম। ব্রিকস বহুপক্ষীয়তাকে এগিয়ে নিতে অঙ্গীকারবদ্ধ। বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থার সংস্কার কাজকে জোরেশোরে এগিয়ে নিতে চায় ব্রিকস। এ জোট তাদের প্রতিনিধিত্ব আরও বাড়াতে চায় এবং দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনৈতিক দেশগুলোর কথা তুলে ধরতে চায়। ব্রিকসের সম্প্রসারণকে চীন অভিনন্দন জানায় এবং ব্রিকস পরিবারে সমমনা দেশগুলোকে অংশীদার হিসেবে গ্রহণ করতে প্রস্তুত চীন।