বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : পদ্মা সেতুর বছরপূর্তি আজ ♦ চলেছে ৫৬ লাখ ৫৪ হাজার ২০৮ যানবাহন ♦ ৭৭৯ কোটি ৮৭ হাজার টাকা টোল ♦ সুদিন ব্যবসা-বাণিজ্যে ♦ বদলেছে দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনীতি
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ২১ জেলার রাজধানীর সঙ্গে সহজ যোগাযোগ স্থাপনের জন্য বাধা ছিল পদ্মা সেতু। দেশ-বিদেশি নানামুখী ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছরের ২৫ জুন উদ্বোধন করেন স্বপ্নের পদ্মা সেতুর। সে হিসেবে আজ পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের প্রথম বছর পূর্তি।
গত এক বছরে পদ্মা সেতুর কারণে পাল্টে গেছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের দৃশ্যপট। অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পপ্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাটসহ এ অঞ্চলের মানুষের জীবন-যাত্রায় এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। সবচেয়ে বড় সুবিধা গ্রামের সঙ্গে যোগাযোগ বেড়েছে শহরের। রাস্তাঘাটের বৈপ্লবিক পরিবর্তন হওয়ায় রাজধানী ঢাকাসহ এ অঞ্চলের জেলা শহরের সঙ্গে গ্রামের যোগাযোগ বেড়েছে। এর ফলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সরাসরি উপকারভোগী হচ্ছেন। কৃষক, জেলে, খামারি, উদ্যোক্তারা তাদের উৎপাদিত পণ্য খুব দ্রুত সময়ে ঢাকাসহ অনেক জেলায় পৌঁছাতে পারছেন কম সময়ে। জীবনমানও বদলে যাচ্ছে এ অঞ্চলের মানুষের। দেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধিতেও অবদান রাখতে শুরু করেছে। গত বছর ২৫ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করার পর দিন ২৬ জুন সকাল ৬টায় সেতুটি যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়। গত এক বছরে সেতু দিয়ে ৫৬ লাখ ৫৪ হাজার ২০৮টি যানবাহন চলাচল করেছে। যানবাহন চলাচল বাবদ সেতু থেকে ৭৭৯ কোটি ৭৫ লাখ ৮৭ হাজার টাকা টোল আদায় করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘স্বপ্নের পদ্মা সেতু নিয়ে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র ছিল। ষড়যন্ত্রকারীদের মুখে ছাই দিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করে বাংলাদেশের ‘সক্ষমতা’ বিশ্ববাসীকে জানান দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
পদ্মা সেতু বাংলাদেশের সাহস-গৌরব-সততার প্রতীক। পদ্মা সেতু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যয়, দৃঢ় মনোবল ও আস্থার প্রতীক। এই সেতু নির্মাণের ফলে দেশের দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। গত এক বছরের ব্যবসা, বাণিজ্যসহ নানা দিকে মানুষের জীবন যাত্রার পরিবর্তন এসেছে। যাতায়াত ব্যবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। মানুষের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নতুন নতুন শিল্প কারখানা গড়ে উঠছে। এই অঞ্চলের সব জেলার মানুষ ইতোমধ্যে পদ্মা সেতুর সুফল পাওয়া শুরু করছে। পদ্মার ফলে দেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধিতেও অবদান রাখতে শুরু করেছে। বৈশ্বিক সংকট কেটে গেলে জিডিপির প্রবৃদ্ধি আরও বাড়বে।’ সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের আরও বলেন, সেতু হওয়ার আগে দক্ষিণাঞ্চলের কেউ অসুস্থ হলে ঢাকায় আনার জন্য ফেরির জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হতো। কখনো ফেরি আসতে দেরি হলে কতজনের মা, বাবা-ভাইবোন, সন্তান ফেরি ঘাটেই মারা যেতেন, এখন সেই পরিস্থিতি নেই। মানুষ সহজেই যাতায়াত করতে পারছে। দক্ষিণাঞ্চলের উৎপাদিত পণ্য ঢাকায় সহজেই নিয়ে আসতে পারছে। পদ্মা সেতুর উপকার শুধু ২১ জেলার মানুষই নয়, গোটা দেশের মানুষও পেতে শুরু করেছে।’ এ বিষয়ে সেতু বিভাগের সচিব মো. মঞ্জুর হোসেন বলেন, এ পর্যন্ত পদ্মা সেতু দিয়ে ৫৬ লাখের বেশি যানবাহন চলাচল করেছে। এ ছাড়া পদ্মা সেতুর টোলের টাকা দিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের চার কিস্তির ৬৩২ কোটি টাকা ঋণ পরিশোধ করেছে সেতু বিভাগ। পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার সঙ্গে ঢাকা যোগাযোগ আরও সহজ হয়েছে।’ আগামী দু-তিন মাসের মধ্যে পদ্মা সেতুতে অটো টোল বুথ চালু হবে বলে জানান তিনি।
রাজধানী ঢাকার সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ স্থাপনে পদ্মা নদীই ছিল একমাত্র বাধা। পদ্মায় সেতু হওয়ায় সে বাধা কেটেছে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের। পদ্মা সেতু চালুর পর দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া রয়েছে। তার মধ্যে একটি হলো গ্রামের সঙ্গে শহুরে মানুষের যোগাযোগ বেড়েছে। পদ্মা সেতুর ফলে রাজধানী ঢাকায় বসবাসকারী দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ বারবার শিকড়ে ফিরতে পারছে। নিজ গ্রামে যখন-তখন আসার সুযোগ তৈরি হয়েছে। রাজধানী ঢাকায় যেতে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের যে অসহনীয় ভোগান্তি, তার অবসান ঘটেছে। দীর্ঘদিনের একঘেয়েমি নৌযাত্রা আর ঘাটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষার চিত্র নিমিষেই বদলে যায়। যে কোনো প্রয়োজনেই রাজধানীমুখী হতে থাকে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ। কাজ শেষে ঘরে ফিরতেও তাড়া নেই, গাড়িতে চড়ে বসলেই বাড়ি পৌঁছাতে পারছেন। ফলে গ্রামের বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ছে। শুক্র-শনিবার ছুটির দিনকে সামনে রেখে বৃহস্পতিবারই বাড়ি ফিরতে থাকেন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন জেলার মানুষ। দুই দিন বাড়ি থেকে রবিবার ঢাকা গিয়ে সরাসরি অফিস করেন তারা। এ প্রসঙ্গে শরীয়তপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য ও পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম টেলিফোনে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একক প্রচেষ্টায় পদ্মা সেতু দৃশ্যমান হয়েছে। দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ আজ পদ্মা সেতুর সুফল ভোগ করছেন। সবচেয়ে বড় কথা গ্রামের সঙ্গে শহরের যোগাযোগ বেড়েছে। দক্ষিণাঞ্চলের উৎপাদিত পণ্য এখন রাজধানীসহ সারা দেশে যাচ্ছে। এমনকি বিদেশেও যাচ্ছে। আমূল পরিবর্তন হতে চলেছে দক্ষিণাঞ্চলে। কাজেই এই অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য শেখ হাসিনার বিকল্প নেই। জাতীয় কিংবা স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে তারা কিন্তু নৌকায় ভোট দেবেন, শেখ হাসিনাকে ভোট দেবেন, আওয়ামী লীগকে ভোট দেবেন। এই অঞ্চলের মানুষের প্রতি কিন্তু আওয়ামী লীগেরও বিশ্বাস আছে।’
দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার ৩ লাখ জেলের এখন সুদিন। পদ্মা সেতু চালুর পর থেকে ৬ ঘণ্টায় তারা তাজা ইলিশ রাজধানীতে পৌঁছানোর সুযোগ পাচ্ছেন। প্রতিদিনের মাছ প্রতিদিনই ঢাকাসহ রাজধানীর আশপাশের জেলায়ও নিয়ে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। পটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলা, বরিশাল, খুলনা, সাতক্ষীরাসহ ২১ জেলার জেলেরা সাগরের ইলিশসহ বিভিন্ন প্রকারের মাছ ধরে দ্রুত ঢাকাসহ চট্টগ্রামে নিয়ে যেতে পারছেন। বরগুনার পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র (বিএফডিসি) দেশের সামুদ্রিক মাছের সব থেকে বড় পাইকারি বাজার। এ কেন্দ্রে প্রতিদিন হাজার টন ইলিশসহ বিভিন্ন প্রকার মাছ নদী, সাগর থেকে ধরে নিয়ে আসে জেলেরা। এ কেন্দ্রের মাছ সড়ক পথে নিয়ে যায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। মাওয়া পার হয়ে ঢাকাসহ দেশের ৪০টি জেলায় ইলিশসহ বিভিন্ন মাছ সরবরাহ করেন আড়তদার-পাইকাররা। এতদিন ফেরিঘাটে যানজটের বিড়ম্বনায় যথাসময়ে আড়তে পৌঁছাতে পারত না। পথেই নষ্ট হতো। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর এ সমস্যার সমাধান হয়েছে বলে জানিয়েছেন বরগুনা ও পাথরঘাটার ব্যবসায়ীরা। তারা পাচ্ছে এসব পণ্যের বাড়তি দামও। এর সুফল পাচ্ছেন পাইকার থেকে শুরু করে প্রান্তিক জেলেরাও। দেশের রপ্তানি আয়ও বাড়ছে। সমৃদ্ধি ঘটছে অবহেলিত এলাকার মানুষের।
শরীয়তপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের প্রশাসক ছাবেদুর রহমান খোকা বলেন, এক সময় পদ্মা সেতু নির্মাণ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের প্রাণের দাবি ছিল। কারণ পদ্মা সেতু না থাকায় এই অঞ্চলের মানুষের চরম দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে। অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিকসহ নানা দিক থেকে পিছিয়ে ছিল। কিন্তু পদ্মা সেতু নির্মাণের কারণে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের সেই দুঃখ, কষ্ট ও বেদনা কিন্তু আর নেই। এখন শরীয়তপুর, মাদারীপুরসহ দক্ষিণের উৎপাদিত মাছ, সবজি সহজেই ঢাকায় নিয়ে বিক্রি করতে পারছে। শুধু রাজধানীতে নয়, বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে মাছ ও সবজি। ঢাকায় বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত পিরোজপুরের বাসিন্দা রেজাউল কবির বলেন, সেতু হওয়ার আগে বাড়িতে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় আনতে কমপক্ষে ১০ ঘণ্টা লেগে যেত। আর কখনো রাতে ঘনকুয়াশা, আবহাওয়ার জটিলতায় ফেরিই চলত না। অন্যদিকে রাজবাড়ী আরিচা-পাটুরিয়া ঘাট হয়ে ঢাকায় আসতে অতিরিক্ত ২-৪ ঘণ্টা লাগত। ফলে রোগীকে বাঁচানো কঠিন। পদ্মা এখন আমাদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছে। আমার বাবা সম্প্রতি স্ট্রোক করায় দ্রুততম সময়ের মধ্যে ঢাকায় নিয়ে আসায় সঠিক সময়ে হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা দিতে পারছি। পদ্মা সেতু যে আশীর্বাদ হিসেবে দেখা দিয়েছে তা বলে বোঝানো যাবে না।’ কাওসার নামের মাদারীপুরের এক বাসিন্দা বলেন, পরিবারের সবাই গ্রামে থাকে। তাই ইচ্ছে হলেই বাড়ি চলে আসি। বৃহস্পতিবার অফিস করে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই গ্রামে আসি। আবার রবিবার গিয়ে অফিস করি। গত এক বছরে অসংখ্যবার গ্রামে যাওয়া হয়েছে। পদ্মা সেতুর বড় সুফল আমার কাছে এটাই।
এক বছরে পদ্মা সেতুর গাড়ি ও টোল : গত বছর ২৫ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন পদ্মা সেতু। উদ্বোধনের পরের দিন ২৬ জুন সকাল ৬টায় সেতুটি যানবাহন চলাচলের জন্য খৃুলে দেওয়া হয়। গত এক বছরে সেতু দিয়ে ৫৬ লাখ ৫৪ হাজার ২০৮টি যানবাহন চলাচল করেছে। ২০২৩ সালের ১৫ জুন পর্যন্ত যানবাহন চলাচল বাবদ সেতু থেকে ৭৭৯ কোটি ৭৫ লাখ ৮৭ হাজার টাকা টোল আদায় করে কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া গত ১৯ জুন পদ্মা সেতু নির্মাণে নেওয়া ঋণের তৃতীয় ও চতুর্থ কিস্তি বাবদ ৩১৬ কোটি ২ লাখ টাকা পরিশোধ করেছে সেতু বিভাগ। এর আগে গত ৫ এপ্রিল প্রথম ও দ্বিতীয় কিস্তিতে আরও ৩১৬ কোটি ৯০ লাখ ৯৭ হাজার ৪৯ টাকা ঋণ পরিশোধ করেছিল সেতু বিভাগ। এ নিয়ে মোট ৬৩২ কোটি টাকার বেশি ঋণ পরিশোধ করা হয় বলে সেতু বিভাগ সূত্র জানায়।
২০২২ সালের ২৬ জুলাই অর্থ বিভাগের সঙ্গে একটি সংশোধিত চুক্তি অনুসারে, বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ ৩৫ বছরের মধ্যে ১৪০ কিস্তির (প্রতি বছর চারটি কিস্তি) মাধ্যমে ঋণ পরিশোধ করবে। ২০৫৬-৫৭ অর্থবছর পর্যন্ত এই ঋণ পরিশোধ অব্যাহত থাকবে।