বদলে যাচ্ছে কক্সবাজার

বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে বদলে গেছে কক্সবাজার। পর্যটন নগরী হিসেবে কক্সবাজার দেশে-বিদেশে সুপরিচিত। ১২০ কি.মি. দীর্ঘ সমুদ্র সৈকতের কক্সবাজার জেলাটি বর্তমান সরকারের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে শুধু দেশেই নয়, দেশের বাইরেও বিশ্ব সমপ্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। বর্তমানে কক্সবাজার জেলাটি সরকারের উন্নয়নের কেন্দ্র হিসেবে কাজ করছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। তারা মানবজমিনকে জানান, সরকারি গৃহীত নানামুখী উদ্যোগ ও কর্মসূচি বাস্তবায়নের ফলে অবকাঠামোগত খাত ছাড়াও অন্যান্য মৌলিক খাতে এ জেলাটি উল্লেখযোগ্য ও তাৎপর্যপূর্ণ সমৃদ্ধি লাভ করেছে। সেবা ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি অন্যান্য ক্ষেত্রে এই জেলাটি যে দৃশ্যমান অগ্রগতি লাভ করেছে তা বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতির প্রাণশক্তি হিসেবে কাজ করবে এবং দেশের উন্নয়নে জেলার জন্য তা উদাহরণ হিসেবে কাজ করবে।

প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের তত্ত্বাবধানে সরজমিন কক্সবাজারের উন্নয়ন চিত্র দেখানো হয়। উন্নয়নের ধারায় বদলে যাওয়া কক্সবাজারকে দেখাতেই এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ২০০৬-২০০৭ অর্থবছর থেকে শুরু করে বর্তমান ২০২২-২০২৩ অর্থবছর সময় পর্যন্ত কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে উন্নতি হয়েছে সে সম্পর্কে জানান জেলা প্রশাসন। বর্তমান সরকারের আমলে কক্সবাজারে শতাধিক প্রকল্প নেয়া হয়েছে বলে জানানো হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ল্যান্ড বেইজড এলএনজি টার্মিনাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক কক্সবাজার, সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্র, মেরিন অ্যাকুরিয়াম স্থাপন, ইনস্টলেশন অব সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) উইথ ডাবল পাইপ লাইন, মাতারবাড়ি বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প, দোহাজারি থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু থেকে মিয়ানমারের নিকটে গুনদুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েল গেজ ট্র্যাক নির্মাণ, মাতারবাড়ি ২*৬০০ মেগাওয়াট আল্ট্রাসুপারক্রিটিক্যাল কোল ফায়ার্ড পাওয়ার প্রজেক্ট, কক্সবাজার বিমানবন্দর উন্নয়ন প্রকল্প, খুরুশকুল বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্প ইত্যাদি।

এসব প্রসঙ্গে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, সরকারের নেয়া নানা উন্নয়নমূলক প্রকল্প বদলে দিয়েছে পুরো কক্সবাজারকে। সবচেয়ে বেশি মেগা প্রকল্প নেয়া হয়েছে রাজধানী ঢাকায়।

এরপরই নেয়া হয়েছে কক্সবাজারে। কয়েকটি মেগা প্রকল্প সম্পর্কে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরে বলা হয়, দেশের সর্বপ্রথম গভীর সমুদ্র বন্দর মাতারবাড়ির অবস্থান মহেশখালী অঞ্চলে। জাপানের দুইটি ব্যস্ততম বন্দর নিগাতা এবং কাশিমার’র আদলে নির্মাণ করা হচ্ছে এই বন্দরটি। জাপানি আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা এই বন্দর নির্মাণের চুক্তি পেয়েছে। মেরিন অ্যাকুরিয়াম স্থাপন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট। এ সম্পর্কে জানানো হয়, বঙ্গোপসাগরে বিস্তৃত একান্ত অর্থনৈতিক অঞ্চলে সামুদ্রিক সম্পদ আহরণে বাংলাদেশের রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা। বঙ্গোপসাগরের অপার সম্ভাবনা ও সম্পদ চিহ্নিতকরণ, পরিমাণ নির্ধারণ ও জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে যথাযথভাবে ব্যবহারসহ বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, আবহাওয়ার পরিবর্তন ও দূষণ ইত্যাদি বিষয়ে গবেষণার জন্যই সরকার ‘বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ প্রতিষ্ঠা করেছে।

ফলে, দেশি ও বিদেশি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পর্যায়ক্রমে সহযোগিতা ও গবেষণা পরিচালনার মাধ্যমে এক্ষেত্রে যেমন আমাদের নিজস্ব দক্ষ জনবল তৈরি হবে, তেমনি দক্ষিণ এশীয় সমুদ্র অর্থনীতির উল্লেখযোগ্য অংশ আমরা আমাদের দেশীয় অর্থনীতির অংশ করতে পারবো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক কক্সবাজার সম্পর্কে বলা হয়, ১৯৮২ সালে অবিভক্ত কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের কক্সবাজার জেলার চকরিয়া উপজেলাধীন ডুলাহাজারা ব্লকের ৪২.৫ হেক্টর বনাঞ্চল নিয়ে একটি হরিণ প্রজনন কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। পরবর্তীতে ২০০১ সালে উঁচু-নিচু টিলাসমৃদ্ধ চিরসবুজ এ বনাঞ্চলের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও আবাসস্থলের টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে এর আয়তন ৩০০০ হেক্টর বৃদ্ধি করে দেশের প্রথম সাফারি পার্ক হিসেবে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক কক্সবাজার’-এর যাত্রা শুরু হয়।

ইনস্টলেশন অব সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) উইথ ডাবল পাইপ লাইন প্রকল্প বিষয়ে জেলা প্রশাসন জানায়, দেশের ক্রমবর্ধমান জ্বালানি তেলের চাহিদা যথাযথভাবে পূরণ এবং জ্বালানি নিরাপত্তা অধিকতর নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে আমদানিকৃত ক্রুড অয়েল ও ফিনিসড প্রডাক্ট দ্রুত, ব্যয়সাশ্রয়ী, সুষ্ঠু, নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব উপায়ে খালাস করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ সরকার ‘ইন্স্‌টলেশন অব সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) উইথ ডাবল পাইপলাইন’ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। বাংলাদেশ ও চীন সরকারের মধ্যে জি-টু-জি ভিত্তিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ/ বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)-এর পক্ষে ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। এদিকে মাতারবাড়ি বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পর (সওজ অংশ) অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ও অন্যান্য প্রভাব সম্পর্কে জানানো হয়-চট্টগ্রাম বিভাগের মাতারবাড়ী, মহেশখালী ও চকরিয়া এলাকাগুলোকে নিয়ে ন্যাশনাল হাইওয়ে (এন-১) এর সঙ্গে বন্দর সংযোগ নির্মাণের মাধ্যমে টেকসই ও নিরাপদ আন্তঃদেশীয় বাণিজ্যিক সম্পর্ক সমপ্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

প্রশস্ত সড়ক এবং নতুন সেতু নির্মাণের মাধ্যমে সড়ক ব্যবহারকারীদের খরচ হ্রাস করতে সহায়তা করবে। এতে সামাজিক ও অন্যান্য প্রভাব সম্পর্কে বলা হয়, এই এলাকায় একটি লজিস্টিক পার্ক, পাওয়ার প্লান্ট, এলএনজি টার্মিনাল ইত্যাদি সহ একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার মাধ্যমে স্থানীয় জনগণের পুনর্বাসন এবং কর্মসংস্থান তৈরিতে সহায়তা করবে। একটি নতুন সমুদ্র বন্দর নির্মাণের ফলে মালবাহী পরিবহন তৈরি হবে যা আন্তর্জাতিক সীমানা অতিক্রম সহ দেশের অন্যান্য অংশে নিয়ে যাওয়া সহজতর হবে। বাংলাদেশ আন্তঃদেশীয় প্রবেশদ্বার হিসেবে কাজ করবে এবং দেশে সমন্বিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি প্ররোচিত করবে। দোহাজারি থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু থেকে মিয়ানমারের নিকটে গুনদুম পর্যন্ত প্রকল্পের প্রভাব বিষয়ে জানানো হয়, দেশি ও বিদেশি পর্যটকদের যাতায়াত সুবিধা বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে। প্রস্তাবিত ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে করিডোরের গুরুত্বপূর্ণ রেল-নেটওয়ার্ক হিসেবে বিবেচিত হবে যা রেল যোগাযোগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান এই রেলপথটি গুরুত্বপূর্ণ সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করবে। এতে বলা হয়, অধিকতর দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ সহজতর হবে।

এতে করে সামষ্টিক উন্নয়নসূচক বৃদ্ধির (জিডিআই) মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা সহজতর হবে। যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ- কৌশলগত বিবেচনায় সমগ্র বাংলাদেশই দক্ষিণ-পূর্ব ও পূর্ব এশিয়ার মধ্যে স্বর্ণদুয়ারে রূপান্তরিত হবে। সার্বিকভাবে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশে বিনিয়োগের গুরুত্ব বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে। খুরুশকুল বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্প সম্পর্কে জেলা প্রশাসন জানায়, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত দেশসমূহের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, নদী ভাঙন ও জলোচ্ছ্বাস বাংলাদেশের নিত্যনৈমিত্তিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যা মানুষের জীবন ও সম্পত্তির ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে থাকে। বাংলাদেশের মানুষ প্রতিবছর এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে তাদের সহায় সম্পত্তি হারিয়ে ফেলে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা অর্জনের পর দেশের ভূমিহীন-গৃহহীন-ছিন্নমূল অসহায় মানুষের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ১৯৯৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত ভূমিহীন-গৃহহীন-ছিন্নমূল-অসহায় মানুষের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে আশ্রয়ণ প্রকল্প গ্রহণ করেন। তারই অংশ হিসেবে কক্সবাজার জেলার জলবায়ু উদ্বাস্তু ভূমিহীন-গৃহহীন-ছিন্নমূল অসহায় মানুষের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে “খুরুশকুল বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্প’’ গ্রহণ করা হয়। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস আক্রান্ত উপকূলীয় অঞ্চল কক্সবাজারের মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি)-এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় ৫তলাবিশিষ্ট ১৩৯টি বহুতল ভবন নির্মাণ করে ৪৪০৯টি জলবায়ু উদ্বাস্তু পরিবারকে পুনর্বাসন করা হবে এবং পুনর্বাসিত পরিবারগুলোর অর্থনৈতিক সচ্ছলতা নিশ্চিত করা হবে। প্রকল্পটি বিশ্বের বৃহত্তম জলবায়ু উদ্বাস্তু পুনর্বাসন প্রকল্প হিসেবে দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।

কক্সবাজার
Comments (0)
Add Comment