বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : অবশেষে আলোর মুখ দেখছে সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি। বহুল আলোচিত এই কর্মসূচিটি আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হতে যাচ্ছে আগামী ১৭ আগস্ট। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ কর্মসূচির উদ্বোধন করবেন। প্রগতি, সুরক্ষা, সমতা ও প্রবাস এই চার নামে বেসরকারি চাকরিজীবী, স্বকর্মে নিয়োজিত অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কর্মী, প্রবাসী বাংলাদেশী এবং অসচ্ছল ব্যক্তি- এ চার শ্রেণির ব্যক্তিদের নিয়ে চালু হচ্ছে সরকারের সার্বজনীন পেনশন কর্মসূচি। যাতে বিভিন্ন শ্রেণির বয়স্ক নাগরিকদের জন্য একটি টেকসই সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা যায়। উদ্বোধনের দিন থেকেই সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি উন্মুক্ত হবে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ইতোমধ্যে এই কর্মসূচি চালুর ব্যাপারে সব প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। উদ্বোধনের জন্য সময় চাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে প্রথমবারের মতো সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু করতে ১৭ আগস্ট সময় দিয়েছেন। সে অনুযায়ী এখন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন চলছে। আর এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি বাজেট প্রদানকারী প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের স্বপ্ন বাস্তবায়ন হতে চলেছে। সেই সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকার বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অবসরকালীন আর্থিক নিরাপত্তার জন্য আরেকটি যুগান্তকারী দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চলছে।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জানিয়েছেন, সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। শীঘ্রই এটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর ইচ্ছাতেই শেষ পর্যন্ত এটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়েছে। দেশের পিছিয়ে পড়া মানুষটিও এখন পেনশন সুবিধার আওতায় আসবেন। বৃদ্ধ বয়সে কাউকে আর অন্যের মুখাপেক্ষী হতে হবে না। সবাই সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকতে পারবেন।
উল্লেখ্য, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছিলেন, চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাই থেকেই দেশে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করা হবে। তবে প্রস্তুতি গ্রহণে সময়ের কারণে এখন চলতি আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে দেশের এই যুগান্তকারী কর্মসূচিটি চালু হতে যাচ্ছে।
সার্বজনীন পেনশন কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এতে সবার জন্য পেনশন (ইউপেনশন) বিষয়ক সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করবেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ফাতিমা ইয়াসমিন।
প্রথমে দেশের আটটি জেলা এবং বিদেশের দুটি মিশন থেকে একযোগে ‘সমতা’ ছাড়া বাকি তিনটি স্কিম আনুষ্ঠানিকভাবে চালু করা হবে। এ লক্ষ্যে স্কিমগুলোর মডেল পেনশনার বাছাই করতে আগেই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অর্থ বিভাগ থেকে গোপালগঞ্জ, সিলেট, রংপুর, পাবনা, বাগেরহাট, ময়মনসিংহ, রাঙ্গামাটি, বরগুনাসহ আট জেলা প্রশাসককে চিঠি দেয়া হয়েছে।
একইভাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রবাসীদের পেনশন ব্যবস্থায় আনার জন্য মডেল পেনশনার নির্বাচিত করতে কুয়ালালামপুর ও জেদ্দা দূতাবাসেও চিঠি দেওয়া হয়েছে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সেই বাছাইকৃত মডেল পেনশনাররা অনলাইন নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পন্নের মাধ্যমে নাম তালিকাভুক্ত করে সরকারের সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচিতে যোগ দেবেন। আর এর মাধ্যমেই দেশে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হবে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার। একই সঙ্গে উদ্বোধনের দিন থেকেই দেশে ও দেশের বাইরে সব বাংলাদেশী নাগরিকের জন্য সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় যুক্ত হওয়ার পথ উন্মুক্ত হয়ে যাবে।
জানা যায়, বৃদ্ধ বয়সে দেশের সব নাগরিককে আর্থিক সুবিধার আওতায় আনতে চার শ্রেণির মানুষের জন্য প্রগতি, সুরক্ষা, সমতা ও প্রবাসী- এই চার নামে আলাদা স্কিমগুলো চূড়ান্ত করা হয়েছে। দেশে বসবাসরত বেসরকারি খাতের চাকরিজীবীদের রাখা হয়েছে ‘প্রগতি’ স্কিমের আওতায়। আর সব ধরনের স্বকর্মে নিয়োজিত অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কর্মীরা অন্তর্ভুক্ত হবেন ‘সুরক্ষা’ স্কিমে। আর প্রবাসী বাংলাদেশী বা অনাবাসী নাগরিকরা যুক্ত হবেন ‘প্রবাসী’ স্কিমে। সবশেষ বিবেচিত স্কিমটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘সমতা’।
এর মাধ্যমে দেশের সব দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে পর্যায়ক্রমে পেনশন সুবিধায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে। তবে আপাতত, সরকারি এবং স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এ পেনশন স্কিমের আওতা-বহির্ভূত থাকবেন। এছাড়া সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের অন্তর্ভুক্ত নাগরিকদের এ ব্যবস্থায় রাখা হবে না। তবে সর্বজনীন নিরাপত্তা বলয়ের সুবিধাভোগী কেউ তার সব সুবিধা সমর্পণ করে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন।
উল্লেখ্য, বর্তমানে চীন তার সব নাগরিককে পেনশন সুবিধা দিতে তিন ধরনের এবং ভারত সাত ধরনের স্কিম চালু রেখেছে। দেশের ১৮-৫০ বছর বয়সী সব বাংলাদেশী নাগরিক সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় যুক্ত হতে পারবেন। ৬০ বছর বয়স থেকে আজীবন পেনশন সুবিধা পাবেন। ৫০ বছরের অধিক বয়সীরাও সর্বজনীন পেনশন সুবিধায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন। তবে অন্যদের মতো ৬০ বছর বয়স থেকে নয়, তারা পেনশন সুবিধা পাবেন ১০ বছর চাঁদা পরিশোধের পর। যদি পেনশনভোগী ৭৫ বছরের আগে মারা যান, তাহলে তার নমিনি সেই বয়স (৭৫) পর্যন্ত একই হারে পেনশন পাবেন।
চূড়ান্ত হওয়া প্রগতি এবং সুরক্ষা স্কিমের আওতায় অন্তর্ভুক্ত প্রত্যেক পেনশনারের সর্বনিম্ন চাঁদার হার নির্ধারণ করা হয়েছে মাসিক ১ হাজার এবং সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা। অন্যদিকে ‘প্রবাসী’ স্কিমের অন্তর্ভুক্ত প্রবাসী বাংলাদেশীদের জন্য সর্বনিম্ন চাঁদার হার নির্ধারণ করা হয় ৫ হাজার টাকা।
এ ছাড়া ৭ হাজার ৫০০ এবং ১০ হাজার টাকা জমা করার সুযোগও রাখা হচ্ছে প্রবাসীদের জন্য। তবে প্রবাসীদের বিদেশী মুদ্রায় এই চাঁদা দিতে হবে। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় যুক্ত হলে ২.৫ শতাংশ হারে প্রণোদনা পাবেন তারা। অর্থাৎ কোনো প্রবাসী যদি ৫ হাজার টাকার স্কিমে যোগ দেন, তাহলে তার প্রকৃত চাঁদা হবে ৪ হাজার ৮৭৫ টাকা। আর ‘সমতা’ স্কিমে অন্তর্ভুক্তদের চাঁদার হার ধরা হয়েছে ৫০০ টাকা। এই স্কিমে সমপরিমাণ চাঁদা দেবে সরকার। অবশ্য সর্বজনীন পেনশন স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর চাঁদার হার এবং পছন্দকৃত স্কিম পরিবর্তন করার সুযোগ থাকবে।
চাঁদাদাতারা আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তার জমা করা অর্থের ৫০ শতাংশ ঋণ হিসেবে নিতে পারবেন। পেনশনের জন্য নির্ধারিত চাঁদা বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য করে কর রেয়াত পাওয়া যাবে এবং মাসিক পেনশন বাবদ পাওয়া অর্থও করমুক্ত থাকবে। চাঁদাদাতা কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা দেওয়ার আগেই মারা গেলে, তার জমা করা অর্থ মুনাফাসহ তার নমিনিকে ফেরত দেওয়া হবে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসেব অনুযায়ী, ১৮ বছর বয়সে এ স্কিমে যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে বেসরকারি খাতের কর্মচারী বা প্রবাসীরা তাদের ৪২ বছরের চাঁদার তুলনায় ১২ গুণ বেশি লাভবান হতে পারবেন। যেমন- একজন প্রবাসী যদি প্রবাস স্কিমের অধীনে প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা চাঁদা দিতে শুরু করেন, তাহলে ৬০ বছর বয়সের পর তিনি সরকারি তহবিলে মোট ৫০ লাখ ৪০ হাজার টাকা চাঁদা দেবেন। এরপর ৬০ বছর থেকে ন্যূনতম ৭৫ বছর পর্যন্ত মাসিক তিন লাখ ৪৪ হাজার ৬৫৫ টাকা করে পাবেন। ফলে তার মোট পাওয়া পেনশনের পরিমাণ দাঁড়াবে ছয় কোটি ২০ লাখ ৩৭ হাজার ৯০০ টাকায়, যা তাদের দেওয়া মোট চাঁদার প্রায় ১২.৩১ গুণ।
অন্যদিকে প্রগতি স্কিমের আওতায় বেসরকারি খাতের একজন কর্মচারী প্রতি মাসে পাঁচ হাজার টাকা চাঁদা দিলে মোট ২৫ লাখ ২০ হাজার টাকা চাঁদা দেবেন। ৭৫ বছর বয়সে তার মোট সরকারি পেনশনের পরিমাণ হবে মোট দেওয়া চাঁদার ১২.৩১ গুণ তথা তিন কোটি ১০ লাখ ১৮ হাজার ৮৬০ টাকা।
যারা সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত হতে চান, তাদের অবশ্যই নিবন্ধন করতে হবে। ঘরে বসে সবাই যাতে রেজিস্ট্রেশন করতে পারেন, সেজন্য একটি অ্যাপ থাকবে। ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে গিয়েও নিবন্ধন করা যাবে। প্রবাসীরা বিদেশ থেকে অ্যাপ ব্যবহার করে রেজিস্ট্রেশন করতে পারবেন। রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন হলে প্রত্যেকে একটি ইউনিক আইডেন্টিফিকেশন নম্বর পাবেন। সেটাই তাদের পেনশন সুবিধাভোগীর পরিচিতি দেবে। সরকার আশা করছে, ১০ কোটি নাগরিক সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। সেজন্য ১৮ সংখ্যার ইউনিক আইডেন্টিফিকেশন নম্বর দেওয়া হতে পারে।
সর্বজনীন পেনশন কর্তৃপক্ষ রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলবে। অংশগ্রহণকারীদের প্রত্যেককে তার নির্দিষ্ট অ্যাকাউন্ট নম্বরে মাসিক চাঁদা দিতে হবে। প্রবাসীরা বিদেশ থেকে চাঁদা দিতে পারবেন। আর নিবাসীরা সরাসরি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে কিংবা বিকাশ, নগদসহ যে কোনো মোবাইলে আর্থিক সেবা (এমএফএস) দাতার মাধ্যমে ওই অ্যাকাউন্টে চাঁদা দিতে পারবেন। পেনশন ব্যবস্থায় নগদ টাকায় কোনো লেনদেন হবে না। আর সব কর্মকা-ই হবে অনলাইনে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ে কর্মকর্তারা জানান, ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সী সকল নাগরিক তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় যোগ দিতে পারবেন। তবে যেসব প্রবাসী বাংলাদেশীর এনআইডি নেই, তারা বৈধ পাসপোর্টের ভিত্তিতে ব্যাংকিং চ্যানেল, অনুমোদিত মোবাইল আর্থিক পরিষেবা এবং এক্সচেঞ্জ হাউসের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রায় চাঁদা দিয়ে যোগদান করতে পারবেন। সকল স্কিমের জন্য গ্রাহকরা মাসিক, ত্রৈমাসিক বা বার্ষিকভিত্তিতে চাঁদার কিস্তি পরিশোধ করতে পারবেন। তাছাড়া চাঁদাদাতা মাসের নামোল্লেখ করে পেনশন তহবিলে অগ্রিম চাঁদা জমা দিতে পারবেন।
প্রাথমিকভাবে পরীক্ষামূলক ভিত্তিতে এ কর্মসূচি চালু করতে যাচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়। তবে সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি বাস্তবায়িত হবে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে। পরবর্তীতে কর্তৃপক্ষের জন্য একটি স্বতন্ত্র অফিস প্রতিষ্ঠা করা হবে। গত ৩ জুলাই অর্থ বিভাগের বাজেট ও ব্যয় ব্যবস্থাপনা শাখার অতিরিক্ত সচিব কবিরুল ইজদানী খানকে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ও প্রবিধি, বাস্তবায়ন এবং রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান শাখার অতিরিক্ত সচিব মো. গোলাম মোস্তফাকে সদস্য নিয়োগ করা হয়। তারা পরবর্তী সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত নিজ নিজ কাজের অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে সর্বজনীন পেনশন কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব পালন করবেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে পেনশন ব্যবস্থার প্রতিশ্রুতি ছিল। সেই প্রতিশ্রুতিই সরকার বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে। বরং নির্বাচনকে সামনে রেখে ‘সবার জন্য পেনশন’ সুবিধা চালুর বিষয়ে জনসচেতনতা বাড়াতে চায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এজন্য জনগণের ব্যাপক অন্তর্ভুক্তিকে উৎসাহিত করতে দেশব্যাপী সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার প্রচারণা চালানোর পরিকল্পনা করছে সরকার। এর আওতায় টেলিভিশনে এবং অন্যান্য গণমাধ্যমের মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দেওয়া হবে।
সরকারি পেনশন ব্যবস্থা সরকারি রাজস্বের উৎস হিসেবে কাজ করবে, কারণ সরকার প্রাথমিক ১০ বছরের জন্য একটি প্রিমিয়াম পাবে। এ সময়ের মধ্যে কোনো পেনশন দেওয়া হবে না। সরকার এ অর্থ লাভজনক বিভিন্ন উদ্যোগে বিনিয়োগ করবে। এছাড়া প্রবাসীদের ক্ষেত্রে প্রিমিয়াম বৈদেশিক মুদ্রায় নেওয়া হবে এবং পেনশন স্থানীয় মুদ্রায় দেওয়া হবে। এতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়বে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু হলে সরকার সহজে অর্থ নেওয়ার সুযোগ পাবে। কারণ এই ব্যবস্থায় প্রচুর অর্থ জমা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে সেটা দুই-এক বছরের মধ্যে হবে না। ব্যবস্থাটা দাঁড়াতেই তিন থেকে পাঁচ বছর লেগে যাবে। এই ব্যবস্থা শুরু হলে জমা হওয়া অর্থ দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করতে হবে। তাই শুরুতেই প্রতিষ্ঠান দাঁড় করাতে কঠোর বিধি-বিধান তৈরি করতে হবে। যাতে পেনশন ফান্ডে জমা হওয়া অর্থের কোনো ধরনের অপব্যবহার বা অপচয় না হয়।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, সবার জন্য পেনশন একটি ভালো উদ্যোগ। বিশেষ করে সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশ যারা ৫০০ টাকা মাসিক চাঁদা দিয়ে পেনশন সুবিধা নিতে পারবেন। উদ্যোগটি ভালো, তবে নিয়ম ও সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে যাতে এই কর্মসূচিটি বাস্তবায়ন হতে পারে সেদিকে সবচেয়ে বেশি নজর দেওয়া প্রয়োজন। অনেক ভালো উদ্যোগই অতীতে ব্যর্থ হয়ে গেছে কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের কারণে। এটি যেহেতু বড় ধরনের একটি আর্থিক খাত হবে তাই এখানে সৎ, যোগ্য এবং কর্মঠ কর্মকর্তাদের নিয়োগ দিয়ে পুরো কর্মসূচিটি বাস্তবায়নে শুরুতেই উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
প্রবাস স্কিম ॥ প্রবাস স্কিমে মাসিক চাঁদা ধরা হয়েছে ৫,০০০ টাকা, ৭,৫০০ টাকা এবং ১০ হাজার টাকা। বিদেশে কর্মরত বা অবস্থানরত যে কোনো বাংলাদেশী নাগরিক বৈদেশিক মুদ্রায় উল্লিখিত যে কোনো পরিমাণ চাঁদা প্রদান করে এ স্কিমে যোগ দিতে পারবেন। বিদেশ থেকে এ স্কিমে যোগদানের পর দেশে ফিরলে তারা দেশীয় মুদ্রায় চাঁদা পরিশোধ করতে পারবেন অথবা স্কিম পরিবর্তন করতে পারবেন। পেনশন স্কিমের মেয়াদ শেষে সরকার স্থানীয় মুদ্রায় পেনশন প্রদান করবে।
যদি কেউ ১৮ বছর বয়সে প্রবাস স্কিমে যোগ দিয়ে ৪২ বছর ধরে প্রতি মাসে পাঁচ হাজার টাকা চাঁদা দেন, তাহলে তিনি ৬০ বছর বয়স থেকে প্রতি মাসে এক লাখ ৭২ হাজার ৩২৭ টাকা পেনশন পাবেন। ৪২ বছর ধরে প্রতি মাসে ৭,৫০০ টাকা চাঁদা দিলে প্রবাসীরা মাসিক দুই লাখ ৫৮ হাজার ৪৯১ টাকা এবং ১০ হাজার টাকা চাঁদা দিলে মাসিক তিন লাখ ৪৪ হাজার ৬৫৫ টাকা আজীবন পেনশন পাবেন।
প্রগতি স্কিম ॥ বেসরকারি কর্মচারীরা মাসিক দুই হাজার, তিন হাজার ও পাঁচ হাজার টাকা চাঁদা দিয়ে প্রগতি স্কিমে যুক্ত হতে পারবেন। কোনো বেসরকারি কোম্পানির এ স্কিমে অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে চাঁদার ৫০ শতাংশ কর্মীরা এবং বাকি ৫০ শতাংশ কোম্পানি পরিশোধ করতে পারবে। এমনকি কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সর্বজনীন পেনশন স্কিমে অংশগ্রহণ না করলেও এর কর্মীরা স্ব-উদ্যোগে এ স্কিমে অংশ নিতে পারবেন।
১৮ বছর বয়সে স্কিমে যোগ দিয়ে ৪২ বছর ধরে মাসিক দুই হাজার টাকা চাঁদা দিলে ব্যক্তি ৬০ বছর বয়স থেকে মাসে ৬৮ হাজার ৯৩১ টাকা পেনশন পাবেন। একইভাবে, তিন হাজার টাকা মাসিক চাঁদায় এক লাখ তিন হাজার ৩৯৬ টাকা মাসিক পেনশন এবং পাঁচ হাজার টাকা মাসিক চাঁদায় এক লাখ ৭২ হাজার ৩২৭ টাকা মাসিক পেনশন আজীবনের জন্য পাওয়া যাবে।
সুরক্ষা স্কিম ॥ অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত বা স্বকর্মে নিয়োজিত ব্যক্তিদের জন্য ‘সুরক্ষা’ নামে স্কিম থাকছে। কৃষক, রিক্সাচালক, শ্রমিক, কামার, কুমার, জেলে, তাঁতিসহ সব ধরনের অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত ব্যক্তিরা এ স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন। এ স্কিমে মাসিক চাঁদার পরিমাণ এক হাজার টাকা, দুই হাজার টাকা, তিন হাজার টাকা এবং পাঁচ হাজার টাকা। সুরক্ষা স্কিমে ৪২ বছর ধরে প্রতি মাসে এক হাজার টাকা করে চাঁদা দিয়ে ৬০ বছর বয়স থেকে মাসে ৩৪ হাজার ৪৬৫ টাকা করে পেনশন পাওয়া যাবে।
আর ১৮ বছর বয়সে অন্তর্ভুক্ত হয়ে ৪২ বছর ধরে মাসে দুই হাজার টাকা চাঁদা দিলে ৬০ বছর বয়স থেকে প্রতি মাসে ৬৮ হাজার ৯৩১ টাকা পেনশন পাওয়া যাবে। একইভাবে প্রতি মাসে তিন হাজার টাকা চাঁদা দিলে আজীবন মাসিক এক লাখ তিন হাজার ৩৯৬ টাকা এবং প্রতি মাসে পাঁচ হাজার টাকা চাঁদা দিলে আজীবন মাসিক এক লাখ ৭২ হাজার ৩২৭ টাকা করে পেনশন পাবেন।
সমতা স্কিম ॥ এই স্কিমে চাঁদার পরিমাণ মাসে এক হাজার টাকা। এর মধ্যে চাঁদাদাতা প্রতি মাসে ৫০০ টাকা করে দেবেন। বাকি ৫০০ টাকা সরকার পরিশোধ করবে। সময়ে সময়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো পরিচালিত খানা আয় ও ব্যয় জরিপ অনুযায়ী অতিদারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার ভিত্তিতে যাদের নিজস্ব আয় দ্বারা জীবনধারণের ন্যূনতম উপকরণ জোগাড় করা সম্ভব নয়, তারা এ স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন।
এ স্কিমের আওতায় ১৮ বছর বয়সে অন্তর্ভুক্ত হয়ে মাসে ৫০০ টাকা চাঁদা দিলে ৬০ বছর বয়স থেকে মাসিক ৩৪ হাজার ৪৬৫ টাকা পেনশন পাওয়া যাবে। আর ৫০ বা তদূর্ধ্ব বয়সীরা অন্তত ১০ বছর ধরে মাসে ৫০০ টাকা চাঁদা দিয়ে, ৬০ বছর বয়স থেকে মাসিক এক হাজার ৫৩০ টাকা করে পেনশন পাবেন।
গত জানুয়ারি মাসে দেশের সর্বস্তরের জনগণকে টেকসই পেনশন কাঠামোয় অন্তর্ভুক্তির লক্ষ্যে ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইন ২০২৩’ প্রণয়ন করে সরকার। গত ৩১ জানুয়ারি আইনটিতে সম্মতি দেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।
আইন অনুযায়ী, অর্থমন্ত্রীর নেতৃত্বে ১৬ সদস্যবিশিষ্ট একটি পেনশন পরিচালনা পর্ষদও গঠন করা হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর, অর্থসচিব, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সচিব, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যান, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব, এফবিসিসিআই সভাপতি, বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের সভাপতি, বাংলাদেশ উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি প্রমুখ এর সদস্য হবেন।