বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : দেশে প্রথমবারের মতো উদ্বোধন করা হয়েছে বৈদ্যুতিক চার্জিং স্টেশন। এর মাধ্যমে যোগাযোগ খাতের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের শুভ সূচনা হলো। পর্যায়ক্রমে দেশের সব ফিলিং স্টেশনকেই বৈদ্যুতিক চার্জিং স্টেশনে রূপান্তর করার প্রক্রিয়া রয়েছে চলমান। এই কর্মযজ্ঞের অন্যতম কারণ দেশের রাজপথে চলবে বৈদ্যুতিক গাড়ি। ইতোমধ্যে এই গাড়ি নিবন্ধনের অনুমোদন পেয়েছে। আগামী অক্টোবরের শেষে ভারত থেকে অন্তত ১০০টি বৈদ্যুতিক গাড়ি আসবে বাংলাদেশে। দেশটি থেকে পূর্বের লাইন অব ক্রেডিট (এলওসি) অনুযায়ী আরও ২০০টি গাড়ি আসার পাশাপাশি কোরিয়া থেকেও বৈদ্যুতিক গাড়ি আনার চেষ্টা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এতে করে দেশের যোগাযোগ খাতে আসতে যাচ্ছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ হ্রাসের লক্ষ্যে দেশের সব গাড়িই বিদ্যুৎচালিত করার লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার। ডিজেল, পেট্রোলের পরিবর্তে এসব বৈদ্যুতিক গাড়ি হবে পরিবেশবান্ধব। সঙ্গে সাশ্রয় হবে জ্বালানিও। কারণ মাত্র ৪০ থেকে ৪৫ মিনিটের চার্জেই একেকটি গাড়ি চলবে অন্তত ৫০০ কিলোমিটার পর্যন্ত।
জানা যায়, ২০১৭ সালের দিকে লন্ডন থেকে টেসলা কার কিনে দেশে এনেছিলেন এক শিল্পপতি পরিবার। কিন্তু অনুমোদন না থাকায় বিলাসবহুল এ গাড়িটি এতদিন চালাতে পারেননি। কয়েকবার সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ বিআরটিএতে নিয়ে গিয়েও ফেরত আনতে হয়েছে। কারণ হিসেবে বিআরটিএ বলে আসছিল, ইঞ্জিন ছাড়া ইলেকট্রিক মাধ্যমে চলে এমন কোনো গাড়ির অনুমোদনই তারা দেয় না। শুধু ইলেকট্রিক কার নয়, ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সা বা ইজিবাইকেরও অনুমোদন নেই। একইভাবে ইলেকট্রিক মোটরসাইকেলও দেশে আমদানি হলেও চলছে অনুমোদন ছাড়াই। তবে এ সংকট আর নেই জানিয়ে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এবিএম আমিন উল্লাহ নূরী জনকণ্ঠকে বলেন, এ সংক্রান্ত নীতিমালা গত কয়েক মাস আগে পাস হয়েছে। এখন আর এসব গাড়ির নিবন্ধন নিয়ে কোনো জটিলতা নেই। আমরা চেষ্টা করছি অক্টোবরের মধ্যেই ১০০টি বৈদ্যুতিক বাস ঢাকার পথে নামাতে। বৈদ্যুতিক গাড়ি নামানোর বিষয়ে ২০১৫ সালের জুন মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকালে ২০০ কোটি ডলারের সমঝোতা চুক্তি হয়, যা দ্বিতীয় লাইন অব ক্রেডিট (এলওসি) নামে পরিচিত। এই চুক্তির আওতায় বিআরটিসির জন্য ৩০০টি বৈদ্যুতিক দ্বিতল এসি বাস সংগ্রহ করা হচ্ছে। তারই প্রথম চালানের ১০০ বাস অক্টোবরে আসবে। তবে ভারত ছাড়াও আমরা কোরিয়ার সঙ্গে কথা বলছি বৈদ্যুতিক বাস আমদানির জন্য।
এসব বিষয়কে সামনে রেখে সম্প্রতি দেশে প্রথমবারের মতো বৈদ্যুতিক চার্জিং স্টেশনের (ইভি চার্জিং) যাত্রা শুরু হয়। এই চার্জিং স্টেশন থেকে ফাস্ট চার্জিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে একটি বৈদ্যুতিক গাড়ি ৪০ থেকে ৪৫ মিনিটে পুরোপুরি চার্জ করা সম্ভব। এবং অন্তত ৫০০ কিলোমিটার রাস্তা এই চার্জে চালানো যাবে জানিয়ে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকাশ দেওয়ান জনকণ্ঠকে বলেন, ডিপিডিসির সহায়তায় অডি বাংলাদেশ-প্রোগ্রেস মোটর ইমপোর্টস লিমিটেড তেজগাঁওয়ে তাদের কার্যালয়ে দেশে প্রথম ফাস্ট চার্জিং স্টেশন চালু হয়েছে। এতে করে দেশের যোগাযোগ খাতের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে প্রত্যেকটি ফিলিং স্টেশনের মালিকদের আমরা ইভি চার্জিং স্টেশন করার জন্য বলব। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে এখন বৈদ্যুতিক গাড়ি ব্যবহার করে। আমাদেরও ক্রমান্বয়ে সেদিকে যেতে হবে। ইলেকট্রিক্যাল ভেহিক্যাল চার্জিং গাইড লাইন অনুমোদন হয়েছে। আশা করছি সারাদেশে ইভি চার্জিং স্টেশন চালু হয়ে যাবে। ২০৩৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশের সব জায়গায় ইলেকট্রিক গাড়ি চলবে। তিনি বলেন, বর্তমানে দেশে ৩৪টির মতো ইভি গাড়ি রেজিস্ট্রেশন করেছে। তবে এই সংখ্যা ক্রমেই বাড়বে বলে আমরা আশা করছি। তিনি বলেন, স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে ইলেকট্রিক ভেহিক্যাল (ইভি) চার্জিং বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে। সারাদেশে ইভি চার্জিং স্টেশন স্থাপন হলে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলা ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে সহায়ক হবে। এই চার্জিং স্টেশনগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় বাড়তি বিদ্যুৎ কিভাবে সরবরাহ করা হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের মহাপরিকল্পনায় এ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা করা হয়েছে। বৈদ্যুতিক গাড়ি রাস্তায় নামলে স্বাভাবিকভাবেই তেলের চাহিদা কমবে। এতে করে আমাদের জ্বালানি চাহিদাও কমবে। তখন বিদ্যুৎ উৎপাদনও বাড়ানো সম্ভব হবে।
প্রথম ইভি চার্জিং স্টেশন বিষয়ে অডি গাড়ির আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান প্রগ্রেস মোটরস ইমপোর্ট লিমিটেডের পরিচালক (অর্থ) মো. হাসিব উদ্দিন ২০২৪ সালের মধ্যে সারাদেশে ১১টি চার্জিং স্টেশন স্থাপনের পরিকল্পনা করেছেন জানিয়ে বলেন, এই স্টেশনে ২০-৩০ মিনিটে গাড়ির চার্জ ১০ শতাংশ থেকে ১০০ শতাংশ হবে যাবে। ১০০ শতাংশ চার্জে একটি গাড়ি চলবে প্রায় ৫০০ কিলোমিটার। বাংলাদেশ এ ধরনের ব্যাটারিচালিত গাড়ির জন্য আদর্শ জায়গা। কারণ, এখানে ৫০০ কিলোমিটারের রাস্তা খুব কমই আছে। একবার চার্জ দিয়েই আমরা আমাদের গন্তব্যে পৌঁছতে পারব। ইভি চার্জিংয়ে ‘এখন চার্জ’ অ্যাপও চালু হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই অ্যাপের মাধ্যমে চার্জের টাকা পরিশোধ, এমনকি যাত্রাপথে গাড়ি চার্জের জন্য নির্দিষ্ট সময় বরাদ্দ করা যাবে। বর্তমানে চার্জিং স্টেশনের যন্ত্রপাতি বিদেশ থেকে আমদানি করলেও আগামী বছর থেকে এগুলো দেশেই সংযোজন কারখানা স্থাপন করা হবে। হাসিব উদ্দিন বলেন, ডিজেলে এক লিটারে গাড়ি চলে ১০ কিলোমিটার। প্রতি কিলোমিটার খরচ পড়ে ১৩ টাকা। কিন্তু বৈদ্যুতিক গাড়িতে প্রতি কিলোমিটার আড়াই টাকার থেকে দুই টাকা ৯০ পয়সা খরচ পড়বে।
ইলেকট্রিক মোটরযানের বৈশিষ্ট্যের বিষয়ে নীতিমালায় বলা হয়েছে, যানবাহনের বডি বা ফ্রেমে ইন্টারন্যাশনাল ভেহিক্যাল আইডেটিফিকেশন নম্বর (আইভিআইএন) অনুযায়ী তৈরি ও নির্ধারিত ডিজিটের চেসিস নম্বর থাকতে হবে। ইলেকট্রিক মোটরযানের চার্জিং সিস্টেম বাংলাদেশে প্রচলিত বিদ্যুৎ ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। ইলেট্রিক মোটরযানের ব্রেকিং, স্টিয়ারিং, লাইটিং, সাসপেনশন সিস্টেম ইঞ্জিনচালিত মোটরযানের মতো হবে। মোটরযানের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতাসহ যাবতীয় বিদ্যমান আইনে নিয়ন্ত্রণ করা হবে। রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতির বিষয়ে বলা হয়েছে, প্রচলিত রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতিতে ইলেকট্রিক যানবাহন ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য হবে। প্রস্তুত, আমদানি ও সংযোজন সব ক্ষেত্রেই মডেলভিত্তিক টাইপ বিআরটিএ থেকে অনুমোদন নিতে হবে। বিআরটিএ’র রেজিস্ট্রেশন ছাড়া কোনো ডিলার, এজেন্ট, আমদানিকারক ও প্রস্তুতকারকরা কোনো ইলেকট্রিক থ্রি হুইলার বা মোটরসাইকেল ক্রেতার কাছে হস্তান্তর করতে পারবে না। এখন ইঞ্জিনচালিত মোটরযান বিআরটিএ’এর রেজিস্ট্রেশন ছাড়াই ক্রেতার হাতে তুলে দিচ্ছেন বিক্রেতারা। ইলেকট্রিক মোটরযানের ক্ষেত্রে সিলিন্ডার সংখ্যা, কিউবিক ক্যাপাসিটি, অশ্বশক্তি, ইঞ্জিন নম্বর, জ্বালানির পরিবর্তে ব্যাটারির সংখ্যা, মোটরের ক্ষমতা, ব্যাটারির ক্যাপাসিটি, মোটরের নম্বর এবং ইলেকট্রিসিটি প্রযোজ্য হবে।
সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে পরিবহন খাত থেকে ৩.৪ মিলিয়ন টন কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ শর্তহীনভাবে হ্রাস করার অঙ্গীকার করেছে জানিয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. হাবিবুর রহমান বলেন, বিদেশে কয়েক কিলোমিটার পরপরই ফিলিং স্টেশনের পাশাপাশি ইভি চার্জিং স্টেশনের দেখা মেলে। ২০৩০ থেকে ২০৩৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশেও জ্বালানি তেলচালিত কোনো পরিবহন থাকবে না। সরকার এই পরিকল্পনাতেই এগুচ্ছে। তার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে চার্জিং স্টেশন স্থাপন করা হয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের চার্জিং স্টেশন নীতিমালা করা হয়েছে অনেক আগে। প্রথম স্টেশন স্থাপনে সে তুলনায় একটু বেশি সময় লেগেছে। তবে এটি শুরু, খুব দ্রুত সবাই মিলে আমরা ইলেকট্রিক যানবাহনে যাওয়ার চেষ্টা করব। ভবিষ্যতে এ ধরনের চার্জিং পয়েন্ট সারাদেশের আনাচে কানাচেও গড়ে উঠবে।